শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সুদ দুনিয়ার সকল ধর্মেই নিষিদ্ধ

প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ শেষ কিস্তি ॥
প্রাথমিক যুগ থেকেই মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ ‘রিবা’কে সর্বসম্মতভাবে এই অর্থেই বুঝে আসছেন। আধুনিককালে ইসলামী আইনবেত্তাদের বেশ কয়কটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তম্মধ্যে, মুতামার আল-ফিকহ আল-ইসলামীর উদ্যোগে ১৯৫১ সালে প্যারিসে এবং ১৯৬৫ সালে কায়রোতে, ওআইসি ও রাবেতা ফিকহ কমিটির উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে কায়রোতে এবং ১৯৮৬ সালে মক্কায় উল্লেখযোগ্য। এসব সম্মেলনসহ ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠার আগে ইসলামী বিশ্বের ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে বিশেষ বৈঠক, মিটিং, কনফারেন্স, সেমিনার ও সম্মেলন করা হয়েছে। সব সম্মেলনেই ‘রিবা’ সম্পর্কে উক্ত রূপ রায় দেয়া হয়েছে এবং ব্যাংকের মুনাফা হারাম হওয়ার ব্যাপারে সকলের অকাট্যভাবে ঐক্যমত পেশ করা হয়েছে। সুতরাং একথাও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, যে ব্যাংকের মুনাফাই হারাম ঘোষিত সুদ। এ প্রসঙ্গে ড. ইউসুফ আল-ক্বারযাভী বলেন, ‘সব সময় আমার একথাও স্মরণ হয় যে, কিভাবে শাহ আব্দুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে তিনশ’ও বেশি অর্থনীতি ও আইন শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ স্কলার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হতে মক্কা মুকাররমায় অনুষ্ঠিত ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ও ব্যাংকের মুনাফা হারামে দ্বিমত পোষণ করেননি; বরং সকলেই এ থেকে রক্ষা পাওয়ার আবশ্যিকতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে সুদমুক্ত ব্যাংকিংয়ের পরিকল্পনা পেশ করেন। এরই বরকতময় পরিণতি হলো ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুদি ব্যাংকের শরয়ী বিকল্প আবিষ্কার’।
বর্তমানে সুদের বৈধতার জন্য যেসব যুক্তি উপস্থাপন করা হচ্ছে তন্মধ্যে বলা হয়ে থাকে কুরআনুল কারীম যে সুদকে হারাম করেছে তা হলো- চক্রবৃদ্ধি সুদ। স্বল্প পরিমাণ সুদ যেমন ৮% বা ১০% এগুলো নিষিদ্ধ সুদের আওতায় পড়ে না। এটা মূলত গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে উত্থাপিত সন্দেহ, কুরআনুল কারীমের সুরা আলে-ইমরানে বর্ণিত আয়াতে এর সামান্যতম মুনাফা বাদ দেয়ার দাবি করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না, আল্লাহকে ভয় কর, যেন সফল হতে পার (সূরা আল-ইমরান : ১৩০)।
আরবী ভাষার প্রয়োগ পদ্ধতি এবং আরবী ভাষা সম্বন্ধে যাদের কিঞ্চিৎ ধারণা রয়েছে তারা জানে যে ‘রিবা’ শব্দটির বিশ্লেষণ (চক্রবৃদ্ধি হারে) শুধুমাত্র বাস্তবতা ও এর ভয়াবহতার বিভৎস চিত্র তুলে ধরার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ সেকালের আরব উচ্চহারে চক্রবৃদ্ধি সুদ গ্রহণের শেষ সীমায় উপনীত হয়েছিল। এ ধরনের বিশ্লেষণ শর্ত হিসেবে ধর্তব্য হবে না সুতরাং চক্রবৃদ্ধি না হলে যে তা বৈধ হবে এমনটি নয়।
এটার উদাহরণ হলো যেমন আজকাল বলা হয়ে থাকে বিনাশী মাদকের মোকাবেলা কর যা মানুষকে সমূলে ধ্বংস করছে। এখানে মাদকের বিশ্লেষণ ‘বিনাশী’ বাস্তবতার বর্ণনা যা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং সমগ্র ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে, এ কথা বলার কারণে নিষেধাজ্ঞা ও প্রতিরোধ হতে কোন প্রকার মাদককে বাদ রাখা উদ্দেশ্য নয়। বরং হতাশাব্যঞ্জক বাস্তবতার বিভৎস চিত্র ও ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছে, যেন সকলে মিলে সর্বপ্রকার মাদকতার মোকাবেলা ও প্রতিরোধ করার জন্য কাজ করে। ইসলামে কোন বস্তু হারাম ঘোষিত হওয়ার পদ্ধতি হলো বেশিতে পতিত হওয়ার আশঙ্কার কারণে কম হতে নিষেধ করা এবং বিপর্যয়ের হাওয়া প্রবাহিত হতে পারে সে সন্দেহে দরজাই বন্ধ করে দেয়া।
সমগ্র মানবতার উপর ইসলামের অনুগ্রহ হলো যে ইসলাম সুদকে সাবলীল ভাষায় হারাম করেছে। বিকৃত তৌরাতের মত বলেনি, যে ইহুদীদের পারস্পারিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে সুদ গ্রহণ হারাম তবে অ-ইহুদীদের সাথে লেন-দেনে সুদ দেয়া-নেয়া বৈধ। ইসলাম, মুসলিম-অমুসলিম সকলের সাথে লেন-দেনে সুদ দেয়া-নেয়া উভয়টাকেই হারাম করেছে। ইসলাম দ্বিমুখী কথা ও দ্বৈত রীতি অবলন্বন করার সুযোগ দেয়নি। সুদ কার্পণ্য, স্বার্থন্ধতা, হৃদয়হীনতা, নিষ্ঠুরতা প্রভৃতি অসৎ গুণাবলী মানুষের মাঝে সৃষ্টি করে। সুদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে শত্রুতার বীজ বপন করে। মানুষের মধ্যকার সহানুভূতি ও পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইমাম রাযী তার তাফসিরে লিখেছেন, ‘কোনরূপ বিনিময় ছাড়াই সুদ লোকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। সুদের মাধ্যমে অর্থাগমনের উপর নির্ভরশীলতা মানুষকে পরিশ্রম করে উপার্জন করা থেকে বিমুখ ও অনুৎসাহী বানিয়ে দেয়’।
সুদের বিকল্প হচ্ছে অধুনা ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইনান্স। ইসলামী ব্যাংকিং এমন একটি সুদের কারবারহীন কৌশল ও পরিচালনা, যা ব্যবসায়িক উদ্যোগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ইসলামী শরীয়াহ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এ ব্যাংকের সকল লেনদেন সুদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত এবং সেই সাথে আর্থ-সামাজিক সুবিচার ও মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এ ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য। এ ব্যাংকব্যবস্থায় পরিচালিত প্রকল্পগুলো সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাই চিন্তা করে না; বরং সামাজিক এবং নৈতিক উন্নয়নের উপরও গুরুত্বারোপ করে।
গত বছরের ২৬-২৭ অক্টোবর মালয়েশিয়ার ‘কুয়ালালামপুর কনভেনশনাল সেন্টারে’ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ব্যাংকিং কনফারেন্স’ (আইআইবিসি-২০১৪)। মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রী আহমদ হুসনি মুহাম্মদ হানাযিলাহ উক্ত সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘গধষধুংরধদং ংঁপপবংং রহ ঃযব ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ধহফ বীঢ়ধহংরড়হ ড়ভ ওংষধসরপ ঋরহধহপব রং ঁহফরংঢ়ঁঃবফ. ডব ধৎব ঢ়ৎড়ঁফ ঃড় যধাব নববহ ধ ঢ়রড়হববৎ রহ সধহু ধৎবধং ড়ভ ওংষধসরপ ঋরহধহপব.’ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ধর্মের চার শতাধিকেরও অধিক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও শরীয়াহ স্কলার উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন। মালয়েশিয়ার ‘ব্যাংক রাকাত’ কর্তৃপক্ষ তাদের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সম্মেলনটির আয়োজন করেন।
বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং এবং ফাইনান্সের উত্তোরত্তর সমৃদ্ধি এবং সম্ভাবনা উপস্থিত স্কলারগণ একবাক্যে স্বীকার করেন, উক্ত অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ায় অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সম্মেলনের অর্থমন্ত্রীর চমৎকার বক্তৃতা, ইসলামী ফাইনান্স এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে তার অগাধ পা-িত্য, আমাদের প্রতি তার অকৃত্রিম আন্তরিকতা সর্বোপরি বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং প্রশাংসা, সত্যিই অতুলনীয়।
ইসলামিক ফাইনান্স মানবজীবনের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় দিককে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আজকের ‘মালয়েশিয়া’। সামগ্রিক ব্যাংকিংয়ের ১৮ শতাংশ ধারণ করে মালয়েশিয়ার ইসলামী ব্যাংকিং দুনিয়াব্যাপী শরীয়াহ ব্যাংকিংয়ের অন্যতম কেন্দ্রভূমির (ঐঁন) পরিচিতি লাভ করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরো ২% এগিয়ে রয়েছে। অপার সম্ভাবনাময় এ দেশ অগ্রগামী পাঁচ স্বল্পোন্নত দেশের একটিতে পরিণত হয়েছে। অন্তর্ভুক্ত হয়েছে উদিয়মান এগার দেশের কাতারে। হতে যাচ্ছে মাধ্যম আয়ের দেশে।
এমতাবস্থায় মালয়েশিয়ার মতো আমরাও যদি আলাদা ইসলামী ব্যাংকিং আইন, শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামী ফাইনান্স বিশ্ববিদ্যালয়, সুকুক গবেষণা, উচ্চমানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, গবেষকদের যথার্থ মূলায়ন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্স-মাস্টার্স, এমফিল-পিএইচডি, কিংবা ডিপ্লোমা পর্যায়ে ইসলামিক ব্যাংকিং/ফাইনান্স/ইন্স্যুরেন্স সাবজেক্ট চালু প্রভৃতির মাধ্যমে আমাদের সম্ভাবনাময় বাজারকে সমৃদ্ধ করতে পারি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা আশাবাদী যে আমাদের অর্থমন্ত্রী সুদের সাফাই গাওয়া ও ইসলামী ব্যাংকের পরিবর্তে সংসদে কিংবা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দাঁড়িয়ে মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রীর মতো বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন ‘ইসলামিক ফাইনান্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সফলতা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আমরা ইসলামিক ফাইনান্সের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগামী হওয়ায় গর্ববোধ করছি’।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন