শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস

| প্রকাশের সময় : ৩১ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


আইন মানছে না কোম্পানিগুলো
হাসান সোহেল ঃ তামাক নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কিছুটা অগ্রগতি হলেও আইন মানছেনা বিক্রয় ও বিপণন কোম্পানীগুলো। বিশেষ করে ছবিসহ সতর্কবার্তা প্রদানে বিভিন্ন তামাক কোম্পানি এটি লঙ্ঘন করছে। এসব দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপণ সরবরাহ করে আইন লঙ্ঘনে ক্রেতাদের উৎসাহী করছে তারা। আর কোম্পানিগুলোর প্রধান লক্ষ্য উঠতি তরুনদের মধ্যে তামাকের আকর্ষণ বাড়ানো। অভিযোগ রয়েছে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও নজরদারির অভাব রয়েছে। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘তামাক উন্নয়নের অন্তরায়’। এ উপলক্ষ্যে দেশের ৬৪টি জেলায়ই দিবসটি উদযাপন করা হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সরকার। এ বিষয়ে দৃষ্টিগোচর করতে তামাক পণ্যের প্যাকেট ও কৌটার গায়ে ছবি সহ সতর্কবার্তার পরিধি আরো বাড়ানো হবে। ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে এসব অবৈধ বিজ্ঞাপণ অপসারণ করতে উদ্যোগ নেয়া হবে। তামাক জাত দ্রব্যের উপর ‘স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ’ আদায়ে নীতিমালার কাজ চলছে। খুব শীঘ্রই এই নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে। যদিও সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তামাকমুক্ত হলেও খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই তামাক মুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন এখানকার একাধিক কর্মকর্তা। তাদের মতে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নামেই তামাক মুক্ত। এখানকার অনেক কর্মকর্তা তার কক্ষে ধূমপান করেন। এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রীর অফিস কক্ষের সামনে সিগারেটের ধোয়া ও গন্ধে ওই এলাকায় থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীসহ দেশের প্রায় সকল জেলা ও উপজেলা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিগারেট তথা তামাক কোম্পানীগুলোর প্রচারণা। তাদের প্রচারণার মূল টার্গেট বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার, বাস, ট্রেন, লঞ্চ স্টেশন ও জনসমাগম স্থলকে কেন্দ্র করে। এছাড়া ভ্রাম্যমান পান, বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুল বিক্রেতার সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসব ক্ষেত্রে মূলত তরুনদের পাশাপাশি উঠতি বয়স্ক তরুনীদেরকেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
রাজধানীর গাবতলি, মহাখালী বাসস্টেশন ও সদরঘাট নৌ-বন্দর এলাকাসহ বেশকিছু স্থান ঘুরে এরকম জাকজমকপূর্ণ ক্যাম্পেইন লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে কিছু সংখ্যক তরুণ তামাক পণের‌্য স্টল সাজিয়ে ক্যম্পেইনের পাশাপাশি বিনামূল্যে সিগারেট বিতরণ করে মান যাচাইয়ের তালিকা করছে। কথা বলে জানা যায়, তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী পার্টটাইম চুক্তিতে কাজ করছে। কতটা ভ্রাম্যমান বিক্রয় সেন্টার আছে জানতে চাইলে ক্যাম্পেইনার সোহাগ জানান, সব মিলে শুধু ঢাকা শহরেই এই প্রচারণা অভিযানে এক হাজার স্টল রয়েছে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও কার্যক্রম চলছে।
গবেষণার তথ্য মতে-বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী তরুন-তরুনীদের মধ্যে ৭ শতাংশ তামাক সেবন করে থাকে। আর প্রতি বছর এ হার ১০ থেকে ১২ শতাংশ  আকারে বেড়ে চলছে। বর্তমানে ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ ৪ কোটি ১৩ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ প্রতক্ষ্যভাবে তামাক ব্যবহার করছে। এছাড়া ৫৮ ভাগ পুরুষ ও ২৯ ভাগ নারী বিড়ি-সিগারেট তামাক সেবন করে থাকে। আর নারীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ এবং ২৬ শতাংশ পুরুষ প্রতিদিন পান, জর্দা, গুলের মাধ্যমে ধোয়াহীন তামাক সেবন করে। অন্যদিকে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টারা বলছেন, প্রতি বছর প্রায় ৯৬ হাজার মানুষ তামাক ব্যবহার জনিত কারনে মৃত্যু বরণ করে থাকে। এর অন্যতম কারণ হল এসব দ্রব্যের সহজলভ্যতা ও মূল্য কম হওয়া। ক্যান্সার হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, ২০০৪ সালে ডাবিøওএইচও এর গবেষণার বলা হয়, তামাক খাতে বাংলাদেশ সরকারের বছরে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় হয়। আর তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা, অকাল মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এতে করে বছরে নীট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এটা ৯ বছর পূর্বের কথা কিন্তু এখন চলছে ২০১৭ সাল। এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, গত ২০ বছরে বিড়ি সিগারেটের দাম যে হারে বেড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য (যেমন চাল, ডাল, তৈল, আটা) দাম তার চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে নেশা জাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতা ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলেই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়।
মাদক দ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) সভাপতি প্রফেসর ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, দেশে যে হারে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। মাদক সেবন ও বিক্রিতে ছিন্নমূল মানুষ ছাড়াও উচ্চবিত্ত নারীরা ইয়াবাসহ নানা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। এভাবে কোমলমতি শিশু ও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকেও জড়ানো হচ্ছে এ পেশায়।
তামাক বিরোধী সংগঠন মানবিকের টেকনিক্যাল এডভাইজার এবং বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের বোর্ড অব ট্রাস্টি এম রফিকুল ইসলাম মিলন বলেন, তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে করারোপ ও তামাকের বর্তমান স্তর প্রথা বাতিল করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্ক নীতি গ্রহণের পাশাপাশি সিগারেটের প্যাকেটের প্রতি ১০ শলাকার সর্বনি¤œ মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন। যাতেও তামাকের ব্যবহার অনেকটা কমবে বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ৪৩ শতাংশ তামাকে আসক্ত, এদের মধ্যে আবার ২৯ ভাগই নারী। এছাড়া পরোক্ষভাবেও অনেক নারী তামাকের ধোঁয়ার শিকার হচ্ছেন। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী মাদক নেয়ার ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী সাধারণ ধূমপান এবং ৪৩ শতাংশ নারী শুধু ইয়াবার মাধ্যমে মাদক সেবন করে থাকে। মাদক দ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) ‘তামাক, মাদক ও নারী-বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ্য প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়- দেশে ৩০ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে এবং ২১ শতাংশ জনসমাগম স্থলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।
আহসানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্ত ও পূর্নবাসন কেন্দ্রের (আমিক) ডেপুটি ডিরেক্টর এন্ড হেড অফ হেলথ সেক্টর, ইকবাল মাসুদ বলেন, ২০০৫ সালে দেশে প্রথম তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শুরু হয়। পরে ২০১৩ সালে সংশোধন আইন ও ২০১৫ সালে এসে তামাক, জর্দা, গুলের পরোক্ষ বিজ্ঞাপণ, স্মোকিং প্লেস বা পরিধি বাড়ানোসহ তামাক সেবনের ক্ষেত্রে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বিষয়ে বিধি প্রণোয়ন হয়। তবে মাঠ পর্যায়ে এর সঠিক বাস্তবায়ন নাই। তামাক পণ্যের উপর আরোপিত কর খুবই সস্তা ও তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ হচ্ছেনা। তাই চাষাবাদ ও উৎপাদন নীতিমালা করার কথা বলেন তিনি।
এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে এলজিআরডি ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মো. মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ বলেছেন, বর্তমান বিশ্বে অকাল মৃত্যু ও প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। বাংলাদেশে ৪৩.৩ শতাংশ অর্থাৎ ৪ কোটি ১৩ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে প্রায় ১২ লাখ মানুষ হৃদরোগ, ফুসফুস ও মুখগহŸবরের ক্যান্সার, স্ট্রোক, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী রোগসহ প্রাণঘাতী ৮টি রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রতিবছর ৩ লক্ষ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে, যার চিকিৎসা ব্যয় তামাক থেকে আহরিত রাজস্বের দ্বিগুনেরও বেশি। ধানমন্ডিতে ঢাকা আহ্্ছানিয়া মিশনের নিজস্ব মিলনায়তনে আয়োজিত তামাক- উন্নয়নের অন্তরায় বিষয়ক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। মিশনের সভাপতি কাজী রফিকুল আলম এর সভাপতিত্বে এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জে. শেখ সালাহ্্উদ্দিন, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. শাহ আলমগীর ও ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডসের গ্রান্টস ম্যানেজার ডা. মাহফুজুর রহমান ভ‚ঁইয়া। মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা আহ্্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য খাত প্রধান ইকবাল মাসুদ। প্রতিমন্ত্রী বলেন, তামাক বিরোধী আন্দোলনে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন