কামরুল হাসান দর্পণ
বাজেট কি সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসে? এ প্রশ্ন যদি করা হয় তবে, নিশ্চিতভাবেই জবাব আসবে বাজেটের কথা শুনলে মানুষ আঁৎকে উঠে। কত ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে, তার এক লম্বা ফিরিস্তি তুলে ধরা যাবে। বাজেট তাদের উপর বিরাট এক বোঝা হয়ে আসে। পকেট থেকে পয়সা খসানোর বাধ্যতামূলক একটি প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে। সরকার তাদের আয় বাড়াতে পারুক না পারুক, ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় করতে এক পা-ও পিছু হটে না। এ প্রশ্নও আসতে পারে, তাহলে কি মানুষ সরকারকে ট্যাক্স দেবে না? নিশ্চয়ই দেবে। তবে তা এমন হবে না, যা তার সাধ্যের অতীত। কারণ হচ্ছে, বাজেটে যেসব ভ্যাট-ট্যাক্স ধরা হয়, তার বহুমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ প্রতিক্রিয়া এতটাই তীব্র হয় যে, মানুষের জীবনযাত্রাকে সংকুচিত করে ফেলে। তবে ভ্যাট-ট্যাক্স যে তারা দিতে চায় না, তা নয়। দিতে চায়। সমস্যা হচ্ছে, সরকারের আচরণ নিয়ে। সরকার এমনভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স ধরে যা সামন্তযুগের মতো হয়ে দাঁড়ায়। প্রজা না খেয়ে থাকলেও ঘাড় ধরে খাজনা আদায় করার মতো হয়ে যায়। আধুনিক যুগে এসে ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের প্রক্রিয়াটি ভিন্নরূপ লাভ করেছে। কৌশল বদলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা থেকে শুরু করে ব্যাংকিং লেনদেন এবং বেতন-ভাতা উত্তোলন করতে গিয়েই মানুষ ভ্যাট-ট্যাক্সের বেড়াজালে আটকে পড়ে। এর আওতা প্রতি বছরই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পায়। আর বাজেট মানেই সাধারণ মানুষের কাছে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসা। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাজেট আসছে কাজেই জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। এমনও দেখা যায়, বাজেটে যেসব জিনিসের দাম বৃদ্ধি করা হয় না, সেগুলোরও দাম বেড়ে যায়। এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এ বিস্ময়ের মধ্যেই সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে টানাপড়েন চলে, নাভিশ্বাস উঠে। সাধারণ মানুষ যখন টানাপড়েনের এক বিস্ময়কর ঘোরের মধ্যে রয়েছে, তখন নতুন অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চির পরিচিত ব্রিফকেস হাতে তিনি সংসদে উপস্থিত হন এবং প্যান্ডোরার বাক্সের মতো তা খুলে বিশাল এক বাজেট উপস্থাপন করেন। সর্বকালের সর্ব বৃহৎ বাজেট। অর্থন্ত্রীর ভাষায়, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট। বাজেটের আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এত বড় বাজেট দেশের মানুষ আর কখনো দেখেনি। স্বাধীনতার পর ৭২-৭৩ অর্থ বছরে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়েছিল। তা এখন বহু গুণ বেড়ে লাখ লাখ কোটিতে ঠেকেছে। এটা নিশ্চয়ই আমাদের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি ও মজবুত ভিত্তির ইঙ্গিত দেয়। তবে তা যদি কেবল বাড়ানোর জন্য বাড়ানো হয় বা লোক দেখানোতে পরিণত হয়, তা নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিকর। অর্থনীতিকে একটু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর প্রবণতা আমাদের সরকারের মধ্যে যে রয়েছে, তা মোটামুটি সবাই জানেন। অর্থনীতি যতটা না এগিয়েছে, তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ দেখিয়ে ক্রেডিট নেয়া একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতির সূচকগুলোই এমন যে, তা বাড়িয়ে দেখালেও কেউ হিসাব করতে যায় না। তর্ক-বিতর্ক করতে পারে, তবে সরকারের ঘোষণা বদলাতে পারে না। যেমন এক জিডিপি নিয়ে সরকার বলে একরকম, বিদেশি সংস্থা ও দেশের অর্থনীতিবিদরা বলেন আরেক রকম। তাতে সাধারণ মানুষের কী আসে যায়! তারা তো জানে, তারা কোন ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে!
দুই.
অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেট দেখে যে কারো মনে হতে পারে, এটা অনেকটা ‘খাইখাই’ বাজেট। কারণ বাজেটের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণের পকেট থেকে অর্থ বের করা। এজন্য যত ধরনের প্রক্রিয়া আছে, তার সবই অবলম্বন করা হয়েছে। অর্থনীতির আকার বড় দেখানোর জন্য বাজেট বড় করা হয়েছে, অথচ মানুষের আয়কর দেয়ার সীমা বাড়ায়নি। সেই আড়াই লাখ টাকার মধ্যেই রেখে দেয়া হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে, মানুষের আয় বাড়েনি। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির যে হিসাব দেখানো হচ্ছে, তার সত্যতা বলতে কিছু নেই। যদি মানুষের আয় বৃদ্ধি পেত, তবে আয়করের সীমা নিশ্চয়ই আড়াই লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেত। দেশের অর্থনীতির এ দিকটি বিবেচনা করলে বলতে হয়, অর্থনীতি স্থবির হয়ে আছে। এ স্থবিরতার মধ্যে বিশাল অংকের বাজেট ঘোষণার অর্থ মরুভূমিতে বৃষ্টি ঝরানোর চেষ্টা। মানুষকে দেখানো, আমরা কত বড় হয়েছি! কত উন্নতি করেছি! অথচ মানুষের জীবন যে কত কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে, তা কেবল তারাই জানে। পকেট থেকে অর্থ বের হয়ে যায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা যায় না। যে দিন অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণা করলেন সেদিনই গ্যাসের দাম এক লাফে বেড়ে ৯৫০ টাকা হয়ে গেছে। বাজেট বক্তৃতায় আরও জোর দিয়ে বললেন গ্যাসের দাম আরও বাড়ানো হবে। বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে। অর্থাৎ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ যত ধরনের সেবা খাত রয়েছে সেগুলোর দাম কেবল বাড়ছেই বাড়ছে। তাও এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। মানুষকে সওয়ার মতো সময় দেয়া হয় না। তাদের সাথে এ ধরনের আচরণ কোনো জনবান্ধব সরকার করতে পারে কিনা জানা নেই। বর্তমান সরকারের এবারের বাজেটকে জনবান্ধব বললে জনগণের সাথে অবিচারই করা হবে। কারণ শুধু জনগণের কথা যদি ধরা হয়, তবে জনগণের জন্য এ বাজেটে কি সুবিধা রাখা হয়েছে, এ প্রশ্ন করলে দেখা যাবে প্রাপ্তির খাতা শূন্য। বরং জনগণের কাছ থেকে সরকার কীভাবে পয়সা আদায় করবে তার বিস্তৃত একটা প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছে। এই যেমন ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাট আরোপ। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই ভ্যাট আরোপে নাকি পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে না। অথচ কে না জানে ভ্যাট আরোপ মানেই পণ্যমূল্যের অবধারিত বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ বিল দিতে গিয়ে যখন গ্রাহক দেখবে তার বিলের সাথে ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাট যুক্ত হয়েছে, তখন এই বাড়তি টাকা কি তাকে দিতে হবে না? এই বাড়তি বিদ্যুৎ বিল যখন উৎপাদন খরচের সাথে যুক্ত হবে, তখন কি পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে না? অর্থমন্ত্রী এসব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে না বলে প্রকারন্তরে তিনি সাধারণ মানুষকে সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অথচ অর্থমন্ত্রী যদি সাধারণ মানুষের টানাপড়েনের জীবন উপলব্ধি করতেন, তবে এভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করে কাটা গায়ে নুনের ছিঁটা দিতেন না। শুধু তাই নয়, বাজেটে ব্যাংক আমানতের উপর আবগারি শুল্ক প্রায় দ্বিগুণ করে আমানতকারীদের এক বিরাট ধাক্কাও দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখান থেকেও তাকে বাজেটের অর্থ যোগাতে হবে। কোনো আমানতকারীর অ্যাকাউন্টে যদি এক লাখ বা তার বেশি অর্থ থাকে তবে বছর শেষে তাকে আবগারি শুল্ক হিসেবে ৮০০ টাকা দিতে হবে। এছাড়া ব্যাংকের দেয়া মুনাফার ওপর ১৫ ভাগ হারে ইনকাম ট্যাক্স ও ব্যাংকের অন্যান্য সার্ভিস চার্জ যুক্ত হবে। এতে দেখা যাবে, আমানতকারীর লাভ দূরে থাক, তার আসল টাকাই অক্ষত থাকবে না। এক লাখ টাকা নেমে আসবে সাড়ে ৯৬ হাজারে। এ পরিস্থিতি হলে মানুষ কেন ব্যাংকে টাকা রাখবে। ব্যাংকে টাকা রেখে যদি কমেই যায়, তবে তা ঘরে রেখে দেয়াই ভাল। এতে ব্যাংকগুলোর কি কোনো লাভ হবে? যে আমানতকারীর অর্থই ব্যাংকগুলোর মূল পুঁজি, সেই আমানতকারীরা যদি ব্যাংকে অর্থ না রাখে, তবে তার উপায় হবে কি? অর্থমন্ত্রীর এদিকে ভ্রæক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। ভ্রæক্ষেপ থাকারও কথা নয়, কারণ তার দরকার টাকা, সেটা যেভাবেই হোক। এবারের বাজেটের মূল ধারাটি যদি ধরা হয়, তবে দেখা যাবে পাবলিককে দৌড়ের উপর রাখাই এর মূল লক্ষ্য। ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার মূল অংশই আদায় করা হবে ভ্যাট-ট্যাক্সের মাধ্যমে। অর্থাৎ ২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা এ খাত থেকে আদায় করা হবে। বলা বাহুল্য, এই পুরো অর্থই আদায় করা হবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। ইতোমধ্যে আদায় করার সকল বন্দোবস্তও করা হয়েছে। প্রতি পদে পদে সাধারণ মানুষকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হবে। বলা যায়, ভ্যাট-ট্যাক্সের খাত সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থ আদায় করার জন্য অর্থমন্ত্রী একটা বিরাট জাল ফেলেছেন। এ জালে আটকে সাধারণ মানুষের যে টানাপড়েন তীব্র হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তিন.
এবারের বাজেটকে বলা হয়েছে উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা অব্যাহত রাখার স্বপ্ন। মহাসড়কে চলতে হলে তো মহা ধরনের বাজেট দিতেই হবে। তা নাহলে মহাসড়কের ইজ্জত আর থাকে না। মহাসড়কে যদি সুদৃশ্য বড় বড় বাস, গাড়ির পরিবর্তে নসিমন, করিমন, ভটভটি চলে তবে তা ভাল দেখায় না। আমরা দেখছি, সরকারের মধ্যে কাজে বড় না হয়ে কথায় বড় হওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। সবকিছুতেই বাড়িয়ে বলার একটু অভ্যাস আছে। বিশেষ করে উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশি। অতীতের বিভিন্ন সরকারের মধ্যেও এ প্রবণতা ছিল। তবে এ সরকারের মধ্যে একটু বেশি এজন্য যে, সরকারটি পরপর দুই মেয়াদ বা দশ বছর ক্ষমতায় রয়েছে। এই দশ বছরে কি উন্নয়ন করেছে, এমন প্রশ্নের মুখোমুখি তো তাকে হতেই হবে। আর উত্তর দিতে গেলেও বেশি বেশিই বলতে হবে। তা নাহলে যে সরকারের দশ বছরের শাসনামল বৃথা চলে যায়। এরশাদের নয় বছরের স্বৈর শাসনের কাছে হার মেনে যায়। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই এরশাদের সময় রাস্তা-ঘাটের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল হয়েছে। এরশাদের এ কাজের সাথে বর্তমান সরকারেরও বেশ মিল রয়েছে। সরকার সড়ক, মহাড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, ফ্লাইওভার ইত্যাদি নির্মাণের দিকে বেশি জোর দিয়েছে। বাজেটে এসব ক্ষেত্রে বরাদ্দও বেশি রাখা হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পও রয়েছে। যেমন পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্র বন্দর ইত্যাদি। আমাদের দেশে একটি কথা আছে, যত বড় প্রকল্প তত বেশি অর্থ এবং দুর্নীতি। কারণ বড় প্রকল্পে বিভিন্ন ছুতোনাতায় সময় বৃদ্ধি, ব্যয় বৃদ্ধি দেখানো যায়। এসব বৃদ্ধি মানেই দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। আমরা ইতোমধ্যে এ ধরনের প্রকল্পগুলোতে কীভাবে সময় ক্ষেপণ ও ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। বলা হয়, আমাদের দেশে রাস্তা ও ব্রিজ নির্মাণে যে ব্যয় হয়, পৃথিবীর কোনো দেশে এত ব্যয় হয় না। এই যে সম্প্রতি ভারতের আসাম থেকে অরুণাচল প্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টির জন্য ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছে, তার নির্মাণ ব্যয় পদ্মা সেতুর খরচের তিন-চার ভাগেরও কম। আমাদের এক পদ্মা সেতু করতেই ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা লেগে যাচ্ছে। আবার ভারতে এক কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশে তার চার-পাঁচ গুণ বেশি খরচ হয়। এসব উদাহরণ দেয়ার অর্থ হচ্ছে, আমাদের দেশে এসব অবকাঠামোগত খাতে বেশি অর্থ বরাদ্দ এবং সময়ক্ষেপণ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে দুর্নীতির উৎস সৃষ্টি করা। একটি প্রকল্প একশ্রেণীর লোকের কোটিপতি হওয়ার প্রকল্প হয়ে দাঁড়ায়। সরকারও এসব প্রকল্পের জন্য বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখে। এবারও রাখা হয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, জনগণের পকেটের পয়সা দিয়েই এসব প্রকল্প তৈরি এবং কিছু লোককে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হতে সহায়তা করা হয়। সাধারণ মানুষের এ থেকে তেমন কোনো উপকার পায় না। এবারের বাজেটে সরকার যে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, এ অর্থ সাধারণ মানুষের দেয়ার সামর্থ্য আছে কিনা, তা একবারও ভাবেনি। অর্থমন্ত্রীর এমন বাজেট দেয়া দেখে যে কারও মনে হতে পারে, আমার টাকার দরকার, তোমরা কোত্থেকে দেবে তা আমার জানার দরকার নেই। আমার টাকা চাই, তোমাদের দিতে হবে। এজন্য তিনি বড় অংকের বাজেট দিয়ে বড় ধরনের জাল ফেলেছেন। এ জাল থেকে দরিদ্র মানুষেরও বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। তাদের দিন আনা দিন খাওয়া থেকেই পয়সা দিতে হবে। কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে। তার দারিদ্র আরও বৃদ্ধি পাবে। অথচ সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। অথচ বাজেটের মাধ্যমে সেই দরিদ্রদের পকেট থেকেই অর্থ নিয়ে নেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় দারিদ্র্যবিমোচন করা কি সম্ভব? বরং যেসব মানুষ দরিদ্র অবস্থায় জীবনযাপন করছে এবং যারা টানাপড়েনের মধ্যেও জীবন চালিয়ে নিচ্ছে, তারা আরও দরিদ্র হবে এবং আরও নিচের দিকে ধাবিত হবে। ব্যয় সংকোচ করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকবে না। উন্নতির দিকে এগুনো দূরে থাক, বর্তমান অবস্থানই ধরে রাখা দায় হয়ে পড়বে। যারা কর্মজীবী তারা এই কষ্টের মধ্যে নিপতিত হলে, বেকারদের কি অবস্থা হবে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। বাজেটে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে তার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, যে বিনিয়োগ কর্মসংস্থানের মূল উৎস, সে বিনিয়োগের ব্যাপারে কোনো কথা নেই। অর্থনীতির ব্যাপারে যারা খোঁজ-খবর রাখেন তারা ভাল করেই জানেন, বিগত কয়েক বছরে বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায়। অথচ আমরা অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি বলে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানায় যদি নতুন নতুন বিনিয়োগ না থাকে, তাহলে মধ্যম আয়ের দেশে কীভাবে পরিণত হবো? বিনিয়োগ বিহীন এবং কোটি কোটি বেকারকে নিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া কি সম্ভব? অর্থাৎ উন্নয়ন ও অর্থনীতি নিয়ে সরকারের যে কথাবার্তা তা যে ফাঁপা ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ তা সাধারণ মানুষের বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না।
চার.
এবারের বাজেট নিয়ে একমাত্র সরকারি দল ছাড়া আর কারো কাছ থেকে ইতিবাচক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রীর জীবনের ‘শ্রেষ্ঠতম’ বাজেট নিয়ে এত নেতিবাচক আলোচনা হবে, তা ভাবা যায় না। তার অর্থ হচ্ছে, এবারের বাজেট অর্থমন্ত্রীর কাছে শ্রেষ্ঠ হলেও অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের কাছে তা সবচেয়ে নিন্দনীয় বাজেটে পরিণত হয়েছে। এখন যিনি বাজেট দেন তার কাছে তো নিজেরটা শ্রেষ্ঠই মনে হবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে বাজেটের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যতই নিন্দা হোক না কেন অর্থমন্ত্রী ও সরকার তাদের এই শ্রেষ্ঠ বাজেট কখনোই বদলায় না। প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বাজেটকে যে লুটপাটের বাজেট বলেছেন, তার এ বক্তব্য একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তার বক্তব্য রাজনৈতিক হলেও, অর্থনীতিবিদদের যেসব অ্যানালাইসিস ও বক্তব্য তাতে বাজেটে সরকারের অর্থ আহরণই যে মূল কাজ, এ বিষয়টি উঠে এসেছে। জনগণকে কষ্ট দিয়ে আহরিত এসব অর্থ বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে এবং সেখান থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লোপাট হবে, এ বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। কারণ এবারের বাজেট এক অর্থে সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। সাধারণত সরকারের মেয়াদের শেষ বাজেট এমনভাবে করা হয়, যাতে সরকারের লোকজন বিশেষ সুবিধা পেতে পারে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্নভাবে দলীয় লোকজনকে সুবিধা দেয়ার প্রবণতা থাকে। এবারের বাজেটে এ ধরনের সুবিধা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে স্বস্তিতে রাখা। দুঃখের বিষয়, বাজেটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ মোটেও স্বস্তিবোধ করেনি। বরং সরকারের প্রতি তারা অসন্তোষ প্রকাশ করছে। কারণ দুর্ভোগটা তাদের পোহাতে হচ্ছে। তারাই ভাল জানে সরকার কোনটা ভাল করছে, কোনটা করছে না। সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা সরকার যে জানে না বা খোঁজ নেয় না, তা এবারের বাজেটের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন