শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

রক্তদান ক্ষতি নেই

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
রক্ত বলতে আমরা লাল রঙের যে তরল পদার্থকে বুঝি, তা আসলে পানি, বিভিন্ন রকম কোষ, নানা রকম প্রোটিন পদার্থ ও কয়েক প্রকার রাসায়নিক লবণের সংমিশ্রণে তৈরি একটি যৌগ। পঞ্চান্ন শতাংশই কিন্তু পানি। কোষ প্রধানত তিন রকমের লোহিত কণিকা (জইঈ) , শ্বেতকণিকা (ডইঈ) এবং অনুচক্রিকা (চষধঃবষবঃ)। অ্যালবুমিন, গেøাবিউলিন, ফাইব্রিনোজেন প্রভৃতি প্রেটিন পদার্থও থাকে রক্তে। এই সব কিছুই দেহে ঘুরে বেড়ায় বড়-ছোট রক্ত নালীগুলোর ভেতর দিয়ে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে হৃদপিন্ড আমাদের দেহের মধ্যে ধুকধুক করতে থাকে ওই হৃদপিন্ড (ঐবধৎঃ) এই রক্তকে পায়ের গোড়ালি থেকে মাথার চুলের গোড়া পর্যন্ত দৌড়াতে থাকে। আমাদের দেহটি অসংখ্য (কয়েকশ’ কোটি) কোষ দিয়ে তৈরি। এই কোষগুলো বেঁচে থাকে অক্সিজেনের মাধ্যমে আর পুষ্টি লাভ করে প্রোটিনের মাধ্যমে। অক্সিজেন আর প্রোটিন-এই দু’টা বস্তুই প্রতিনিয়ত যোগান দিয়ে যাচ্ছে রক্ত। ফুসফুস থেকে অক্সিজেন কণায় সমৃদ্ধ হয়ে লোহিত কনিকাগুলো ছুটে যায় দেহের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, সঙ্গে থাকে প্রোটিন, ভিটামিন ইত্যাদি। আবার ফিরে আসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বয়ে নিয়ে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে প্রতিনিয়তÑএমনকি আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখনও। এ জন্যই আমরা বেঁচে আছি। পাঁচ থেকে ছ’মিনিট সময় এই প্রক্রিয়া কোনও কারণে বন্ধ হয়ে গেলে মত্যু অবধারিত।
আমাদের দেহটি প্রকৃতির দ্বারা নির্মিত। বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ স্থাপন করার আধুনিক পদ্ধতি আবি®কৃত হলেও এসবের কোনটাই প্রাকৃতিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বিকল্প হতে পারে না। কৃত্রিম রক্তও আজ অবধি আবি®কৃত হয়নি। তাই কোনও কারণে কোনও প্রাণীর দেহ থেকে খুববেশি পরিমাণে রক্তপাত হলে অথবা রক্তের কোনও প্রকরণের ব্যাপক ঘাটতি হলে রক্ত দিয়েই তার চিকিৎসা করতে হয় এবং সে ক্ষেত্রে আরেকজন সুস্থ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হয়। রক্তদান করতে। কিন্তু সমস্যা হল, সবাই রক্তদান করতে পারেন না। রক্তদান করার কিছু শর্ত রয়েছে। প্রথম শর্ত হচ্ছেÑরক্তদাতার বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, তার ওজন হতে হবে ৪৫ কেজি বা আরও বেশি। তৃতীয় শর্ত হল, ইচ্ছুক দাতার রক্তে হিমোগেøাবিন বা লোহিত কলিকার পরিমাণ হতে হবে প্রতি ডেসিলিটারে ১২ মিলিগ্রাম বা তার বেশি। এই প্রাথমিক শর্তগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয় দাতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বর্পর্ণ। কুকুরের কামড়ের ইঞ্জেকশন নিয়ে থাকলে এক বছর রক্তদান করা অনুচিত। জন্ডিস বা ম্যালেরিয়া থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ছয় মাস রক্তদান করা যাবে না। বড় অপারেশন হয়ে থাকলেও এক বছর পর্যন্ত রক্তদান করা যাবে না। অ্যান্টিবায়োটিক ঔষুধ গ্রহণকালে রক্তদান করা যাবে না। এই নিয়মগুলো মেনে চললে মহিলাদের রক্তদানে কোনও অসুবিধা নেই। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে আরও তিনটি শর্ত থাকবে। গর্ভবতী মহিলারা কখনই রক্ত দেয়া ঠিক নয়। দুপোষ্য শিশুর মায়েরাও রক্ত দিতে পারবে না। তাছাড়া, ঋতুস্রাব চলার দিনগুলোতে মহিলাদের রক্তদান করা উচিৎ নয়। লো প্রেসারে যারা ভোগেন তারা রক্তদানে অক্ষম। হাইপ্রেসার, বøাড সুগার, থাইরয়েড ইত্যাদি সমস্যার জন্য যারা প্রতিদিন ঔষুধ খেতে বাধ্য, তারা কখনই রক্তদান করা উচিৎ নয়। রক্তদান তারাই করবে, যারা উপরে উল্লিখিত সমস্যাবলি থেকে মুক্ত। কিন্তু এ রকম সুস্থ মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
আমাদের দেশে সারা বছরে বড়জোর ৮ লক্ষ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়। আর আমাদের জনসংখ্যা এখন ১৫ কোটির এদিক-ওদিক। অর্থাৎ ১৬ জনের মধ্যে মাত্র একজন যদি বছরে একবার মাত্র রক্তদান করে, তা হলে আর রক্তের অভাব থাকবে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিজন মানুষ তার সারা জীবনে যদি একবার রক্তদান করে, তবে এই দেশের হাসপাতালগুলোকে রক্তের অভাব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তা তো হচ্ছেই না,বরং স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের প্রয়োজনীয় রক্তের একটা বৃহৎ অংশ সংগৃহীত হয় পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। রোগীকে বাঁচানোর তাগিদে তার আত্মীয়স্বজনেরা পয়সা দিয়ে রক্ত কেনে। তারা জানে না, পেশাদার মারাত্মক সংক্রমণযোগ্য অসুখ-বিসুখের কথা লুকিয়ে রেখে রক্ত বিক্রয় করে থাকে। ফলে ওই রক্ত পেয়ে রোগী সুস্থ হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো নতুন নতুন অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা পয়সা দিয়ে মৃত্যু কিনে আনার সামিল।
অনেকেই জিজ্ঞেস করে, রক্তদান করলে দুর্বল কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়ব না তো ? রক্ত সম্পর্কিত বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান-ধারণার ব্যাপক অভাবের ফলেই আমাদের মধ্যে এই ভুল ধারণা বিরাজ করছে। একজন মানুষের দেহে কত পরিমাণ রক্ত থাকবে সেটা নির্ভর করে তার দেহের ওজনের ওপর। পুরুষ মানুষের দেহে প্রতি কেজি ওজনে রক্ত থাকে ৭০ থেকে ৭৬ মিলিলিটার। মহিলাদের থাকে ৬৬ থেকে ৭০ মিলিলিটার। অথচ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে কেজি প্রতি ৫০ মিলিলিটার রক্তই যথেষ্ট। তা সত্তে¡ও প্রত্যেক কেজিতে আমাদের দেহে গড়ে প্রায় কুড়ি মিলিলিটার রক্ত বেশি থাকে, যাতে ছোটখাটো দুর্ঘটনায় অল্পবিস্তর রক্তপাত হলেও ওই অতিরিক্ত রক্ত থেকে দেহের প্রয়োজন মিটে যায়।আমরা যখন রক্তদান করি, তখন ওই অতিরিক্ত রক্তের তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র দান করি।
তাছাড়া আরেকটা তথ্য আমাদের জেনে রাখা দরকার। মানবদেহের যে স্বাভাবিক হজম এবং জারণ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, তাতে আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য থেকেই প্রতিদিন প্রায় চারশ’ মিলিলিটার রক্ত প্রস্তুত হয়ে যেতে পারে। তার জন্য মাছ-মাংস-ডিম-দুধের কোন প্রয়োজন নেই, পেট ভরা ডাল-ভাত-সবজি যথেষ্ট। আসলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা শ্রেণীবিভক্ত হওয়ায় আমাদের বিত্ত-বৈভবে যতই আকাশ-পাতাল ফারাক থাকুক না কেন, প্রকৃতির নিয়মে কোন ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ নেই। তাই খাদ্যের সস্তা-দামি তফাতে রক্ত তৈরির কোন কম-বেশি নেই। রোজ রোজ দামি দামি খাবার খাওয়া মানুষের দেহে যতটা রক্ত রয়েছে, নুন-ভাত খাওয়া একজন গরিব মানুষের দেহে তার চেয়ে এক ফোঁটা রক্তও কম নেই। অতএব ভাল-মন্দ খেতে পাই না বলে রক্তদানে দুর্বল হয়ে পড়ব- এ একেবারে ভুল ধারণা। দান করা রক্তের পরিমাণটা তো ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পূরণ হয়ে যায়, কাজেই রক্তদানের ফলে অসুস্থ হওয়ার কোন আশংকা নেই।
রক্ত সংগ্রহের ব্যাগ/প্যাকেটগুলোতে প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা সূঁচ লাগানো থাকে এবং একজন দাতার শরীরে ব্যবহার করার পর সেটা নষ্ট করে ফেলা হয় আগুনে পুড়িয়ে। কাজেই সেদিক থেকেও সংক্রমণ হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তা সত্তে¡ও কেউ কেউ যে মাথা ঘোরানোর কথা বলে, বা বমি করে ফেলে, তার দুটো কারণ রয়েছে। প্রথম এবং প্রধান কারণটি হচ্ছে ভয়। মনের মধ্যে রক্তদান সম্পর্কে ভয় থাকলে তা থেকে মাথা ঘোরাতে পারে, বমি হতে পারে। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে রক্তদানের আগে-পরে মেনে চলার নির্দেশিকা মান্য না করা। রক্তদানের আগে মনে রাখতে হবে, খালি পেটে রক্ত দিতে নেই। আবার ভরপেট খেয়ে উঠেই রক্তদান করা উচিত নয়। কমপক্ষে এক ঘন্টা অপেক্ষা করা দারকার। আর রক্তদানের পর পাঁচ-সাত মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নেওয়া এবং এক গøাস পানি খাওয়া খুবই প্রয়োজনীয়। তাছাড়া রক্তদানের পর এক ঘন্টা ড্রাইভিং করা অথবা সিঁড়ি বেয়ে দোতলা-তিনতলায় ওঠা নিষেধ। বিজ্ঞান নির্দেশিত এই নিয়মগুলো মেনে চললে রক্তদান সম্পূর্ণ নিরাপদ।
রক্তদান করলে দাতাও কিন্তু পরোক্ষ লাভবান হয়। তাঁর রক্তের নানা রকম পরীক্ষা বিনা পয়সাতেই হয়ে যায়। কোনও রোগ ব্যাধির জীবাণু রক্তে ধরা পড়লে সময়মতো চিকিৎসা করানো যায়। শরীরে যে নতুন রক্তকণিকা জন্মায় সেগুলো দাতার শরীরকে সতেজ সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। নিজের বা আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজন হলে বিনা এক্সচেঞ্জে এক প্যাকেট রক্ত পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে পেরে এক নির্মল স্বর্গীয় প্রশান্তি আসে মনে। চোখ দান, দেহ দান এই সবই করা যায় মৃত্যুর পর, কিন্তু জীবিতাবস্থায়ই দেড়শ’বারেরও বেশি রক্তদান করার তৃপ্তি একজন মানুষকে এক মহান উচ্চতায় স্থাপিত করে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন