স্টাফ রিপোর্টার : যুদ্ধের কৌশল হিসেবেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি বলে মন্তব্য করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির দাবি, ৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময় না পেলে আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারতাম না। ৭ মার্চের পর থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে জাতি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে সময় পেয়েছে। এটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের যুদ্ধের কৌশল।
গতকাল সোমবার বিকেলে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ কথা বলেন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সংসদের উপ নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নাই। ৭ তারিখ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত সময় না পেলে আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারতাম না। এই সময়ের মধ্যে আমরা প্রশিক্ষণ নিলাম। ইপিআরের লোকজন আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। গ্রাম থেকে যুবকরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলো। ২৬ মার্চের মধ্যেই আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। এটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের যুদ্ধের কৌশল।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু নেতা ছিলেন না। আমি জানি না উনার কোনো সামরিক প্রশিক্ষণ ছিলো কি না। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের যে কৌশল জাতির সামনে উপস্থিত করেছিলেন, তা বিস্ময়কর। পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া।
তিনি বলেন, আমরা ছোট দেশ, কিন্তু আমাদের নেতা কিন্তু ছোট ছিলেন না। আর কিছু দিন বেঁচে থাকলে তিনি বিশ্বের এক নম্বর রাজনীতিবিদ হতেন।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শুধু নেতাই ছিলেন না, যুদ্ধের কৌশলও তিনি জানতেন। তার রণকৌশল, তার যে অফুরান্ত প্রাণ শক্তি ছিল, যেটা খুব কম বাঙালিরই ছিল। আজ পর্যন্ত তার মতো একজন মানুষ খুঁজে পাইনি। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর মাত্র সাড়ে ১৭ মিনিটের ভাষণ আজ বিশ্ব মানতার অমূল্য সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল কৌশলী। বঙ্গবন্ধু বললেন, ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ৭১ এর আজকের দিনেই এসেছিল স্বাধীনতার ডাক। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে সেদিন পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল জাতির জনকের নির্দেশে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন মনে হয়েছিল তিনি যেন এই দিনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সেদিন জনসভা ছিল না, ছিল জনসমুদ্র।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু জানতেন কোন সময় কি বলতে হবে। কেউ যেন তাকে বিচ্ছিন্নতাদী না বলতে পারেন সেজন্য তিনি কৌশলী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে তা ফুটে ওঠে। তিনি নিরস্ত্র বাঙ্গালি জাতিকে সাগরের একই মোহনায় ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।
তোফায়েল বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর নিরস্ত্র বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। যারা এখনও স্বাধীনতার বিরোধিতা করে তারাই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যেসব দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছিল, আজ তারাই বলছেন বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই আজ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিচার চেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া পাকিস্তানপন্থি। কারণ তিনি চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী জানজুয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় শোক প্রকাশ করেছিলেন। অথচ এই জানজুয়া ছিল চিহ্নিত পাকিস্তানের ১৯৫ যুদ্ধাপরীদের মধ্যে একজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খালেদা জিয়াসহ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিচার চেয়ে শেখ সেলিম বলেন, খালেদা জিয়া পাকিস্তানপ্রীতির কারণেই মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে ও দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেন, তারা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। তাদের বাংলাদেশে থাকার কোনো অধিকার নাই। তাদের বিচার করে কঠোর শাস্তি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের সম্মান দেখাতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে শেখ সেলিম বলেন, বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো ত্যাগী নেতা আর কোনো দিন হবে না। আজ থেকে ৪৫ বছর আগের কথা। তখন ঢাকা শহরে লোক সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তখনকার রেসকোর্স জনতায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। ওইদিন তিনি পুরো জাতিকে স্বাধীকার ও মুক্তি সংগ্রামের দিকনির্দেশনা দিলেন।
দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি গত নির্বাচনে অংশ নেননি। অথচ এখন ইউপি নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে ২০১৯ সালের নির্বাচনেও আপনি অংশ নেবেন এবং সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনা আবারও নির্বাচিত হবেন।
তিনি বলেন, যে গণতন্ত্র মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়, আমরা সে গণতন্ত্র বিশ্বাস করি না। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের মানুষ আজ শেখ হাসিনাকে সমর্থন করছে বলে জানান তিনি।
জনসভায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ১/১১-ঘটনায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন বিএনপি এবং বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ১/১১ ঘটনা সৃষ্টি হলেও এর সবচেয়ে সুবিধা নিয়েছে বিএনপি। বিএনপি দুর্নীতি-অনিয়মের মধ্য দিয়ে দেশকে নরকে পরিণত করলেও তারা রক্ষা পেয়েছিল।
তিনি বলেন, ভুল সংবাদ ছাপিয়ে যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল তাদের কোনো ক্ষমা নেই। ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য রাখেন গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র আনিসুল হক, দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন প্রমুখ। পরিচালনা করেন প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ।
এর আগে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেলা পৌণে ৩টা থেকে। পৌনে তিনটার দিকে ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের জনসভা শুরু হয়। বিকাল তিনটা ৩৫ মিনিটে জনসভার প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঞ্চে উপস্থিত হন।
আগের রাতের বৃষ্টিতে মাঠ কাঁদাযুক্ত হয়ে গেলেও তা শুকিয়ে সমাবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়। কিছু জায়গায় বিছানো হয়েছে পাটের চট। দুপুর ১২টার পর থেকেই সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করে নেতাকর্মীরা। জনসভায় লোকসমাগমের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় ক্ষমতাসীন দল। মঞ্চ তৈরি করা হয় উদ্যাণের পূর্ব পাশে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের পাশ ঘেঁষে। প্রধানমন্ত্রী ও ভিআইপিরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করেন মূলগেট (শিশুপার্কের পাশ) দিয়ে। নেতাকর্মীরা প্রবেশ কওে রমনা কালী মন্দির গেট এবং টিএসসির পাশের গেট দিয়ে। জনসভায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছাড়াও মাইক লাগানো হয় টিএসসি দোয়েল চত্বর সড়ক ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ছেড়ে মৎস্যভবন মোড় পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে রাজধানীতে র্যালি করবে আওয়ামী লীগ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে আগামী ১৭ মার্চ রাজধানীতে র্যালি করার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। সোমবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলটি আয়োজিত এক জনসভায় এ ঘোষণা দেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।
জনসভায় মায়া বলেন, ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের অবস্থিত বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পর্যন্ত র্যালি করবে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ।
জনসভাকে কেন্দ্র করে গণপরিবহণ শূন্য রাজধানী, পথেপথে মানুষের ভোগান্তি
আওয়ামী লীগের জনসভাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ গণপরিবহণ শুন্য হয়ে পড়ে রাজধানী। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন কর্মব্যস্ত নগরীর সাধারণ মানুষ। গন্তব্যে যেতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করেও বাসের দেখা না পেয়ে অনেকেই পায়ে হেঁটে বা বাড়তি টাকা দিয়ে সিএনজিতে করে রওনা হতে দেখা যায়।
সোমবার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। তাই সকাল থেকে বাস রিজার্ভ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জনসভায় যোগ দিতে যেতে দেখা যায়। এসময় রাস্তা গণপরিবহন শুন্য হয়ে পরে। বিভিন্ন গন্ত্যব্যে যেতে সাধারণ মানুষকে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতেও দেখা যায়। বিশেষ করে মতিঝিলের অফিস ফেরত হাজার হাজার কর্মজীবী নারী-পুরুষকে পায়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে দেখা যায়।
ফার্মগেটের ট্রাফিক সিগনালে কথা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা ইব্রাহিমের সঙ্গে। তিনি বিজয় সরণি থেকে মতিঝিল যাওয়ার জন্য প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশী সময় অপেক্ষা করেও কোনো বাসের দেখা পাননি। পরে ৪শ’ টাকা চুক্তিতে একটি সিএনজি ঠিক করে রওনা হন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘জনসভার দিনগুলোতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেই হয়।’
মহাখালী মোড়েও ব্যাপক জনসমাগম দেখা যায়। কথা বলে জানা যায়, অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য লেগুনার অপেক্ষা করছেন বেশিরভাগ মানুষ। বাসের পরিবর্তে যেই লেগুনাই থাকে শেষ ভরসা, সেই লেগুনারও দেখা মিলছে না আজ। যা-ও দু’একটি লেগুনা কালে-ভদ্রে দেখা মিলছে, সেগুলো জনসভার রিজার্ভ যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক মৎস্য ভবনের মোড় থেকে গতকাল দুপুরের আগেই পুলিশ ব্যারিকেড বসিয়ে সকল যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে শাহবাগ এলাকা থেকেও ব্যারিকেডের কারণে কোনো যান চলাচল করতে পারেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন