স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষকে বেআইনিভাবে আটক করে গোপন স্থানে আটকে রেখেছে বলে এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠন গতকাল বৃহস্পতিবার ৮২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলেছে, কেবল ২০১৬ সালেই অন্তত ৯০ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আর ২০১৭ সালের প্রথম ৫ মাসে একইভাবে ৪৮ জনের নিখোঁজ হওয়ার খবর এসেছে। গোপন স্থানে আটকে রাখার সময় নির্যাতনও করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়ার কথা বলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে সৃনিদৃষ্ট কোনো তথ্য নেই। বাংলাদেশে গুম এবং গুপ্ত বন্দিশালা-সংক্রান্ত এইচআরডবিøউর প্রতিবেদন বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা আছে। তারা এসব নিয়ে কিছু বলে না। এইচআরডবিøউ এত গায়ে পড়ে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসে কেন?
এই প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে নিখোঁজদের স্বজন, প্রত্যক্ষদর্শীসহ মোট ১০০ জনের বক্তব্য নেওয়ার এবং অভিযোগের বিষয়ে নথিপত্র সংগ্রহ করার কথা জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাদের অভিযোগ, তুলে নিয়ে গুমের ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা দিতেও বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
এইচআরডবিøউ এশিয়া বিভাগের পরিচালক ব্র্যড অ্যাডামস বলেন, নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাগুলো নিয়ে যথেষ্ট তথ্য থাকার পরও বাংলাদেশের সরকার আইনের শাসনের তোয়াক্কা না করে ওই ভয়ঙ্কর চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে আটক করে তারা অপরাধী কি না- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া, শাস্তি নির্ধারণ করা, এমনকি বেঁচে থাকার অধিকার তাদের আছে কি না- তা ঠিক করার স্বাধীনতাও যেন বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের কর্মকান্ড অবিলম্বে বন্ধ করে দ্রুত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি নিখোঁজদের পরিবারকে ব্যাখ্যা দিতে এবং এসব ঘটনায় জড়িত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
এইচআরডবিøউর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে যাদের তুলে নেওয়া হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস গোপন স্থানে আটকে রাখার পর তাদের আদালতে হাজির করা হয়েছে। তবে অন্তত ২১টি ঘটনায় আটক হওয়া ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে; আর ৯জনের সর্বশেষ অবস্থা জানা যায়নি। গত বছর নিখোঁজের ওই ৯০টি ঘটনার মধ্যে ৩ যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম ও মীর কাসেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে যথাক্রমে আমান আজমী, মীর আহমেদ বিন কাসেম ও হুম্মাম কাদের চৌধুরীর কথাও রয়েছে। এর মধ্যে হুম্মাম ‘নিখোঁজ হওয়ার’ ৭ মাস পর গত মার্চে বাড়ি ফেরেন, যাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে পরিবারের অভিযোগ। এছাড়া বিএনপির ১৯ কর্মীর নিখোঁজ হওয়ার কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। যাদের ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য।
নিখোঁজদের স্বজনদের বরাত দিয়ে মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, অধিকাংশ ঘটনার পেছনে ছিলেন র্যাব বা গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। বিএনপির যে ১৯ জনের কথা প্রতিবেদনে এসেছে, তাদের মধ্যে ৮জনকে র্যাব, ৬জনকে ডিবি এবং বাকিদের ‘অজ্ঞাত’ কোনো বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানিয়েছে সংগঠনটি। সাজেদুল ইসলাম সুমন নামে এক বিএনপি কর্মীর কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে; যিনি ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, একজন জ্যেষ্ঠ র্যাব কর্মকর্তা পরে পরিবারের কাছে স্বীকার করেন যে সুমনসহ ৬জন তার হেফাজতে ছিল। কিন্তু তাদের হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানানোয় পরে তার কাছ থেকে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
২০০৯ সাল থেকে টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলে আসছে। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো তখন থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩শ ২০ জনের নিখোঁজ বা গুম হওয়ার তথ্য নথিভুক্ত করেছে। যাদের মধ্যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, যারা নিখোঁজ হয়, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে বারবার দাবি করা হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের ওই দাবিতে সমর্থন দেওয়া হয়। এমনকি এও বলা হয়, নিখোঁজ ব্যক্তিরা হয়তো স্বেচ্ছায় গোপনে লুকিয়ে আছেন। এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে পুলিশ তা নেয় না।
মানবাধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন ও সনদগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার অফিসকে বাংলাদেশে এসে তদন্তের আমন্ত্রণ জানানো উচিত বাংলাদেশ সরকারের। এইচআরডবিøউ এশিয়া বিভাগের পরিচালক ব্র্যড অ্যাডামস বলেন, বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার, মানুষের জীবন ও আইনের তোয়াক্কা না করাকে অভ্যাসে পরিণত করেছে। এমনকি এসব অভিযোগ অস্বীকার করারও প্রয়োজন বোধ করছে না। তারা নীরব থাকছে এবং আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের কাছ থেকেও একই প্রত্যাশা করছে। এই নীরবতার অবসান ঘটা প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন