শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী বিশ্ব

আফগানিস্তানে হতাশ মার্কিন সিল কমান্ডারের আত্মহত্যার ঘটনা-২

প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক (পূর্বপ্রকাশিতের পর) : প্রাইসের সিল টিমকে ৭ মাসের জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল যে এ সময়টা তুলনামূলকভাবে ভালোই কাটবে এ কারণে যে এর বড় সময়টাই হবে শীতকাল, আর শীতকাল লড়াইয়ের সময় নয়।
অক্টোবরের শেষদিকে এক আফগান পুলিশ অফিসার টাস্কফোর্সের দু’জন সৈনিক সার্জেন্ট ক্লিন্টন কে. রুইজ ও স্টাফ সার্জেন্ট কাশিফ এম. মেমনকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যকারী ছিল ওরুজগান প্রদেশের ছড়া জেলার যেখানে কয়েক মাস আগে নির্যাতন চালিয়ে এক আফগানবন্দিকে হত্যা করা হয়। অবশ্য এ হত্যাকা-ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
এর এক সপ্তাহ পর কান্দাহারে পুবে জাবুল প্রদেশে জঙ্গিরা একটি সিল টহল দলের উপর হামলা চালায়। পেটি অফিসার দ্বিতীয় শ্রেণি ২২ বছর বয়স্ক ম্যাথু জে. ক্যান্টর তার সহ-সৈনিকদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মেশিনগান চালাতে থাকে ও গুরুতর আহত হয়ে নিহত হয়। বন্ধু ও পরিবারের সদস্যরা জানান, তার মৃত্যুতে কমান্ডার প্রাইস ভীষণ শোকাহত হন।
তিনি জানতেন যে তার পূর্বসূরি কমান্ডার হায়েসের সময় কেউ মারা যায়নি। কিন্তু তার সময়ে দু’মাসেরও কম সময়ে ৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই শরতে এক উদ্ধার অভিযানে সিল টিম ৬-এর এক সদস্য নিহত হওয়া ছাড়া আফগানিস্তানে শুধু তার টিমের সদস্যরাই নিহত হয়েছিল। তার আত্মহত্যা নিয়ে এক দশকে সিল নিহতের সংখ্যা ছিল ৪৯।
থ্যাংকস গিভিং ডে’র দু’দিন পর ২৪ নভেম্বর সিল ৪ টিমের কয়েকজন সদস্য আফগান কমান্ডোরা ওরুজগান প্রদেশে সকালের টহলে বের হয়েছিল। পেটি অফিসার ফার্স্ট ক্লাস ৩২ বছর বযস্ক কেভিন আর. এবার্ট ছিলেন নেতৃত্বে। তিনি একটি শৈলশিরার উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় তার পিছনে বিস্ফোরণ ঘটে। শ্র্যাপনেল তার গায়ে আঘাত হানে। একজন তালিবান সম্ভবত গ্রেনেড লাঞ্চার থেকে একটি .৩৮ মিমি গ্রেনেড ছুঁড়েছিল। তারপর ছোট অস্ত্রের গুলি ছোঁড়ে। তিনি নিহত হন।
এক সামরিক তদন্তে দেখা যায়, মিশনটি যথাযথভাবেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে রিপোর্টে বলা হয়, টার্গেট এলাকার ছবি দেখে ঐ এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা বোঝা যায় না। কমান্ডার প্রাইস এ মন্তব্যকে সমালোচনা হিসেবে নেন। তিনি সহকর্মীদের বলেন, তার মনে হচ্ছে যে তদন্ত অফিসার তাকে বাসের নিচে ছুঁড়ে দিয়েছেন।
পেটি অফিসার এবার্ট সৈন্যদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। অন্যরা প্রাইসের বিরদ্ধে অসন্তোষ ব্যক্ত করলে তিনি তার পক্ষেই কথা বলতেন। ২০০৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি সিলে যোগ দেন। তার বাবাও সিল সদস্য ছিলেন ও ভিয়েতনামে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি একজন চিকিৎসা কর্মীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি পরিবারকে জানিয়েছিলেন যে মেডিক্যাল স্কুলে তিনি ভর্তি হয়েছেন এবং তার কমান্ডার (প্রাইস) নৌবাহিনী থেকে তার আগাম অবসর নিশ্চিত করতে সাহায্য করছেন। মধ্য জানুয়ারি নাগাদ তিনি বাড়ি ফিরবেন।
কিছু সিল সদস্য এবার্টের মৃত্যুকে এক মোড় ঘোরানো ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেন। উপজাতীয় উপদেষ্টা তদন্তকারীদের বলেন, মনে হচ্ছিল যে প্রত্যেকের মনোবল শেষ হয়ে গেছে , আর সবাই বলাবলি করছিল যে এটা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ জায়গায় মোতায়েন ও বাজে নেতৃত্ব।
কমান্ডার প্রাইসের শরীর ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছিল। তিনি প্রতিদিন সকালে উঠে সরেজমিনে সৈন্যদের দেখতে যেতেন। তার লোকদের মৃত্যু ঘটনা নিয়ে তদন্ত ও লেখালেখি চলছিল। একই সাথে তিনি সেনা ফাঁড়িগুলোর অধিকাংশ বন্ধ করাসহ উপর থেকে নির্দেশের পর নির্দেশ পেতে থাকেন বলে উপজাতীয় উপদেষ্টা তদন্তকারীদের বলেন।   
কমান্ডার প্রাইসের নির্বাহী অফিসার তদন্তকারীদের বলেন, ইরাক ও আগানিস্তানে তিনি ৮ জন কমান্ডারের অধীনে কাজ করেছেন। তাদের সবার মধ্যেই যুদ্ধের সময় একই ধরনের চাপের সম্মুখীন হওয়ার লক্ষণ দেখা গেছে।
অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন শ্যাবি বলেন, একজন সিল কমান্ডার হিসেবে তিনি স্লিপ লগ রাখতেন। ৭ মাস তিনি রাতে গড়ে ২ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট ঘুমিয়েছিলেন। তিনি বলেন, প্রাইস আমার চেয়ে কম ঘুমাতেন।
তার নির্বাহী অফিসার বলেন, আমি গভীর রাতে তার রুমে যেতাম এবং দেখতাম যে তিনি পোশাক পরে শুয়ে রয়েছেন। শেষের চার সপ্তাহে আমি প্রতি রাতে তাকে জিজ্ঞেস করতাম, কি ব্যাপার বস? এমন কি ব্যাপার যা আমার দেখা বা জানা নেই? তিনি বলতেন, না, কোনো সমস্যা নেই।    
ডিসেম্বরের প্রথমদিকে নির্বাহী অফিসার এবং আরো ৪ জন ঊর্ধ্বতন অফিসার ও সৈনিক কমান্ডার প্রাইসকে
ধরে বসেন। তিনি তখন স্বীকার করেন যে এবার্টের মৃত্যু তাকে বড় রকম ধাক্কা দিয়েছে। সেখানে কোনো মনস্তত্ত্ববিদ না থাকায় তারা সবাই মিলে তাকে বেশি করে ঘুমাতে সাহায্য করেন। তারা তার লড়াই সংক্রান্ত প্রাত্যহিক ব্রিফিং-এর সময় সকাল ৯টার পরিবর্তে ১১টা করেন এবং সকল সমস্যায় তাকে সাহায্য করার আশ^াস দেন।
ইস্ট কোস্টভিত্তিক সকল সিল টিমের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন স্মিথ ও তখন শীর্ষ সিল এডমিরাল ও বর্তমানে মার্কিন স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার সিন এ.পাইবাস ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর আফগানিস্তান সফর করেন। তারা প্রাইসের সাথে কিছু সিল ফাঁড়ি পরিদর্শন করেন। ক্যাপ্টেন অ্যামি ডেরিক নামে নৌবাহিনীর এক মহিলা মুখপাত্র বলেন, ক্যাপ্টেন স্মিথ বলেন যে তিনি কমান্ডার প্রাইসের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি। তা সত্ত্বেও তিনি প্রাইসকে মনে করিযে দেন যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ঘুম, পুষ্টি ও ব্যায়াম উপকারী।
তারা যেদিন চলে যান, সেদিন কমান্ডার প্রাইসের শ^াস-প্রশ^াসের সংক্রমণ দেখা যায় যা তার ঘুমের সমস্যাসহ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে। ১৩ ডিসেম্বর দুশ্চিন্তা ও চাপমুক্ত থাকার জন্য তাকে ১৫টি ভ্যালিয়াম দেয়া হয়। ৪ দিন পর তিনি ক্লিনিকে  গিয়ে পানি শূন্যতা সমস্যার কথা জানান। তাকে ৫শ’ মিলিলিটার ব্যাগের ২ ব্যাগ স্যালাইন দেয়া হয়। তিনি এ চিকিৎসা রেকর্ডভুক্ত না করার জন্য চিকিৎসা কর্মীদের অনুরোধ জানান।
সামরিক বাহিনী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা চিহ্নিত ও চিকিৎসার জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করলেও বহু সিল সদস্রই বলেন চাকরিতে অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে আশংকায় এ ধরনের সমস্যার কথা জানাতে ভয় পেতেন। বর্তমান ও সাবেক সিলদের মধ্যে আত্মহত্যার কোনো পরিসংখ্যান নেই যদিও প্রকাশ্যে ৩ জনের আত্মহত্যার কথা স্বীকার করা হয়।  
কমান্ডার প্রাইস আত্মহত্যা করার এক মাসে কিছু বেশি সময় আগে তা স্ত্রী স্টেফানি সাবেক সিল সদস্য ৩৩ বছর বয়স্ক রবাট গুজ্জোর আত্মহত্যার ব্যাপার তাকে ইমেইলে জানান। তিনি বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে প্রাইসের কাছে মন্তব্য করেন।
১৬ ডিসেম্বর একটি বিস্ফোরণে ওরুজগানের একটি উপত্যকা কেঁপে ওঠে। আফগান বিশেষ বাহিনীর সৈন্যদের একটি দল ঘটনাস্থলে ছোট একটি আফগান মেয়ে লাশ পায়। ঘটনাস্থলটি কমান্ডার প্রাইসের আওতাধীন একটি ফাঁড়ির কাছে ছিল। স্থানটি মার্কিন সৈন্যদের মর্টারের গোলাবর্ষণের জন্য ব্যবহৃত হত। তবে মার্কিন সামরিক রিপোর্টে বলা হয়, সেখানে কোনো অবিস্ফোরিত গোলা ছিল না। পরে এ বিস্ফোরণের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি।
মিসেস প্রাইস পরে তদন্তকারীদের বলেন, আই.ই.ডি ও নির্বিচার গোলাগুলিতে আহত স্থানীয় শিশুদের চিকিৎসার জন্য ঘাঁটিতে আনা হত। তা দেখে তার স্বামী মর্মাহত ছিলেন।
তা স্টাফ জানান, ২১ ডিসেম্বর কমান্ডার প্রাইসকে শান্ত, হাসিখুশি ও অন্যদের সাথে হাসি-ঠাট্টা করতে দেখা যায়। তিনি জানান, যে অবশেষে তিনি ঘুমাতে পারছেন ও ভালো বোধ করছেন। তার বাবা-মার কাছ খেকে ক্রিসমাস কার্ড আসে। তিনি তার স্ত্রীর সাথে সিল টিম ৪-এর সদস্যদের স্ত্রীদের কাছে বড়দিনের বার্তা পাঠানোর জন্য কাজ করেন।
পরদিন এক আপগান জেনারেলের সাথেতার বৈঠক ছিল। কিন্তু তিনি সেখানে না যাওয়ায় তার এক সহকর্মী তাকে ডাকতে আসেন। তিনি তার রুমে দু’বার টোকা দেন। সাড়া পাননি। দরজা বন্ধ না থাকায় ভিতরে ঢোকেন তিনি। তবে বিছানার কাছে যাবার আগেই মেঝেতে রক্তের ধারা দেখতে পান। তার কব্জি পরীক্ষা করে প্রাণের স্পন্দন পাননি।
কমান্ডার প্রাইসের ডেস্কে ছিল তার মেয়ের ছবি। তিনি কাজের সময যে ট্রাউজারটি ব্যবহার করতেন সেটি পাশেই একটি কাউচের সাথে ঝোলানো ছিল। তার পকেটে পাওয়া যায় নিহত আফগান বালিকার মৃত্যু সংক্রান্ত রিপোর্ট।
কমান্ডার প্রাইসের আত্মহত্যার তিন বছর পরও কিছু প্রশ্ন তার পরিবারের সদস্যদের মনে জীবন্ত হয়ে আছে। তার মৃত্যুর পর তার খুব অল্পসংখ্যক সহকর্মী তাদের সাথে দেখা করেছেন। সামরিক বাহিনী কাছ থেকে তার মৃত্যু সংক্রান্ত কাগজপত্র পেতে তাদের রীতিমত লড়াই করতে হয়েছে। তাদের কাছে আশ্চর্য মনে হয় যে তার কোনো সহকর্মীই গুলির শব্দ শোনেননিÑ কেউ কেউ বলেছেন তারা অস্পষ্ট শব্দ শুনেছেন। অন্যদিকে তাকে কবরস্থ করার আগে তার সকল ফরেনসিক সাক্ষ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করা হয়েছিল কিনা।
তার বোন ব্রনউইন ডি ম্যাসো বলেন, আমার ভাইয়ের মৃত্যু এক গোপন বিষয় এবং কেউ এ নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে চায় না। তিনি কিভাবে মারা গেছেন সেটা বিষয় নয়। তিনি নিজের জীবন নিয়ে থাকলেও তিনি যুদ্ধের বলি। সূত্র নিউইয়র্ক টাইমস। (শেষ)                     

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন