শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতার জন্য ধর্মকে দায়ী করে সরকারগুলোকে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে

| প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দি নিউ আরব : ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আঞ্চলিক প্রকল্পটি ধীরগতিতে অথচ অপ্রতিরোধ্য ভাবে শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এদিকে হোয়াইট হাউস উগ্রপন্থী জঙ্গি ইসলামের উত্থান ও তা বিস্তারের দায়িত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে বিদেশী যোদ্ধা এবং এ বিষয়ক রহস্যের ব্যাপারে আরো একবার দ্বৈত ব্যাখ্যার পথ অবলম্বন করেছে।
গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ব্রেট ম্যাকগার্ক প্রকাশ করেন যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট আইএসের পক্ষে লড়াইকারী বিদেশী যোদ্ধাদের একটি ডাটাবেস তৈরি করছে। তিনি ইঙ্গিত দেন যে হোয়াইট হাউস ইরাক ও সিরিয়ার চলমান যোদ্ধা সংগ্রহের কেন্দ্রগুলোতে অভিযান চালানো থেকে উগ্রপন্থী জঙ্গি ইসলামের বিশ^ভিত্তিক অবৈধ ধর্মীয় লড়াইয়ের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারে। একই ভাবে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের উপ সহকারী সেবাস্টিয়ান গোরকা এ বছরের গোড়ার দিকে বলেন যে আইএস প্রচার করছে যে কিয়ামত বা শেষ বিচারের দিন নিকটে এবং এখন জিহাদে লিপ্ত হওয়ার ও বেহেশত লাভের শেষ সুযোগ।
উগ্রপন্থী জঙ্গি ইসলামের উত্থান ও তার বিদ্যমানতার ব্যাপারে সরকারী ব্যাখ্যা হিসেবে এ ধরনের যুক্তি শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, তা সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী ও মারাত্মকও বটে। অনুমিত ধর্মীয় মতবাদ থেকে সরে আসার বহু রকম জাগতিক কারণ রয়েছে।
বস্তুত আইএস ও আল কায়েদার মত সংগঠনের সাথে বহু পশ্চিমা যোদ্ধা যোগ দিয়েছে, তারা ইরাক বা সিরিয়ায় লড়ছে বা লোন উল্ফ’ হামলা চালাচ্ছে যাদের অনেকেই সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণকারী যাদের রয়েছে অপরাধের পুরনো রেকর্ড এবং যাদের ইসলামে বিশ^াসের গভীরতা কম।
প্রথমত, বিদেশী যোদ্ধাদের উপস্থিতি খুব একটা অভিনব বিষয় নয়। ইতিহাসে তার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন স্পেনের গৃহযুদ্ধ যেখানে তরুণরা একটি বিদেশী ভূখন্ডে গিয়ে আদর্শের লড়াইয়ে মৃত্যুবরণ করে। কবি লর্ড বায়রন অটোম্যান শাসনের বিরুদ্ধে গ্রীকদের স্বাধীনতার যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন।
স্মরণ করা গুরুত্বপূর্ণ যে আইএস নিজেদেরকে স্বৈরাচার, বিদেশী দখল, সা¤্রাজ্যবাদ ও অবিচারের বিরদ্ধে লড়াইকারী হিসেবে প্রদর্শন করেছিল। পরিহাস যে বিভিন্ন পশ্চিমা নেতা প্রথম দিকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশারকে এক অশুভ শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে লোকজনকে সিরিয়ায় জিহাদিদের পক্ষে যোাগ দিতে উৎসাহিত করায় সহায়তা করেন। সম্প্রতি হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র সিন স্পাইসারকে (বর্তমানে সাবেক) বলতে শোনা গিয়েছিল যে আসাদ হিটলারের চেয়েও খারাাপ।
এভাবে দেখা যায় যে পশ্চিমা সরকারগুলো না বুঝেই আসাদ সরকারের মত অশুভ শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের দেশের বীতশ্রদ্ধ তরুণদের আইএস ও আল কায়েদার মত সংগঠনের সাথে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
আরো উল্লেখ্য যে বিদেশীরা শুধু আইএস ও আল কায়েদার পক্ষেই যুদ্ধ করছে না। পশ্চিমারা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সিরীয় কুর্দিদের সংগঠন পিপলস প্রটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি)-এর পক্ষেও লড়াই করছে। প্রশ্ন হচ্ছে Ñ কেন? এটাকে ফরাসি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যেতে পারে। ফরাসি পন্ডিত রয় অলিভার আধুনিক জীবনের সংকটের কথা উল্লেখ করেন যার বৈশিষ্ট্য বিষন্নতা, মোহমুক্তি, বিচ্ছিন্নতা বা মানসিক অবসাদ।
বেসরকারী বাহিনীসমূহ বিভিন্ন সরকারের হয়ে বিদেশী যোদ্ধা বা ভাড়াটে সৈন্যরা লড়াই করছে। যেমন ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে লড়াই করেছে মার্সেনারি কর্পোরেশন বø্যাক ওয়াটার, সিরিয়ায় রাশিয়ার পক্ষে লড়ছে চেচেনরা এবং ইরান সমর্থিত আফগান ও ইরাকি শিয়ারা এবং লেবাননের শিয়া হেজবুল্লাহ।
ভাড়াটেদের ক্ষেত্রে কোনো মতাদর্শ কাজ করে না, তারা যুদ্ধ করে অর্থের জন্য।
যদি বিভিন্ন সরকারের দেয়া বিদেশী যোদ্ধাদের সংখ্যা মেনে নেয়া হয় , সে অনুযায়ী আইএস যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার যাদের মধ্যে ৬ হাজার ছিল বিদেশী যোদ্ধা।
বিপুল সংখ্যক স্থানীয় যোদ্ধা আইএসের সাথে যোগদান করে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার, বিদেশী দখলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা পরিস্থিতিতে আকর্ষণীয় বেতন।
দ্বিতীয়ত দৃষ্টিভঙ্গি বিক্রেতারা এবং বিশেষ করে সমাজের উচ্চস্তরের লোকেরা যারা ইসলাম ও বাকিদের মধ্যে ধর্মীয় সংঘাতের কথা স্বীকার করেন তারা এ ব্যাপারে সচেতন কিনা যে এ ধরনের কথাবার্তা জিহাদিদের বক্তব্য প্রচার ও বাস্তবায়নে সহায়তা করে।
তৃতীয়ত, এ ধরনের ভোঁতা, সাধারণীকৃত ও অনৈতিহাসিক বিশ্লেষণ মুসলিম বিরোধী মনোভাবে বাতাস লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনীতি ও মিডিয়ার অসৎ লোকদের দ্বারা গৃহীত ও অপব্যহৃত হবে। পরিহাস যে তা পুনরায় ইসলামিক স্টেটের বাইরে মুসলমানদের কখনোই স্বাগত জানানো হবে না বলে আইএসের প্রচারণাকে বৈধতা প্রদান করবে।
আইএসের একটি পরিকল্পনা হচ্ছে পাশ্চাত্য ও অন্যত্র যেখানে মুসলিম ও অমুসলিমরা তুলনামূলক ভাবে সম্প্রীতির মধ্যে বাস করে, সহাবস্থানের সে ‘গ্রে জোন’কে নিশ্চিহ্ন করা। আইএস ইরাক, সিরিয়া, লন্ডন ও প্যারিসে তাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে বর্বরতার কাজ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার উস্কানি দিচ্ছে যা মুসলমানদের উপর নিপীড়ন ও অত্যাচারের তাদের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণমূূলক।
এভাবে যারা সুনির্দিষ্টভাবে আইএস, আল কয়েদা বা অন্যদের প্রচারিত সালাফি-জিহাদি বক্তব্যের নিন্দা না করে উচ্চকন্ঠে সামগ্রিক ইসলামের নিন্দা করে তারা আসলে বিচ্ছিন্নতা ও পার্থিবতা পরিত্যাগকেই উস্কে দিচ্ছে যা লোকজনের এ ধরনের আন্দোলনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণ সৃষ্টি করে।
চতুর্থত, ধর্মীয় মতবাদ ও বিদেশী যোদ্ধাদের উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করার লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যাপ্রাচ্য ও বিভিন্ন স্থানে সরকারগুলোকে সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়মুক্তি দেয়া যা আল কায়েদা ও আইএসকে লালনে সহায়তা করেছে।
আমরা যদি মেনেও নেই যে ধর্ম নিজেই এই সমস্যার মূলে তাহলে আমরা ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত সাইকস-পিকো চুক্তির কথা ভুলে যেতে পারি যার মাধ্যমে পতনোন্মুখ অটোম্যান সা¤্রাজ্যকে ভেঙ্গে কিছু কৃত্রিম রাষ্ট্র সৃষ্টি করে যা স্থানীয় স্বার্থে নয়, করা হয় সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থে।
এ দায়মুক্তি ২০০৩ সালে ইরাকে বিপর্যয়কর আগ্রাসন ও ধ্বংসসহ এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অনধিকার চর্চা এড়িয়ে যেতে সহায়তা করে যা নিরাপত্তা শূন্যতা সৃষ্টি করে ইরাকে প্রথমে আল কায়েদা ও তারপর আইএসের অভ্যুদয়ের সুযোগ এনে দেয়।
২০০৩-উত্তর সময়ে একটি কার্যকর রাষ্ট্র নির্মাণে ইরাক সরকারের ব্যর্থতা এবং গোষ্ঠিগত নীতিতে রাজনৈতিক এলিটদের নির্লজ্জ অনধিকার চর্চার এ দায়মুক্তি সুন্নী সম্প্রদায়কে এতটাই দূরে ঠেলে দেয় যে আইএস যোদ্ধাদের ২০১৪ সালে ফালুজা, মসুল ও রামাদির মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগত জানানো হয়।
এটা ২০১১ সালে গণ অভ্যুত্থানের সময় আসাদ সরকারের বেপরোয়া সামরিকীকরণের ব্যাপারে নীরবতা পালন করে যা উগ্রপন্থী ইসলামের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইয়ের দাবিকে স্ব-পূরণকৃত ভবিষ্যদ্বাণীতে পরিণত করে এবং এভাবে আলেপ্পোর মত ঘনজনবসতির এলাকায় পরবর্তীতে আসাদ সরকার ও রুশ মিত্রদের বর্বরতাকে বৈধতা প্রদান করে।
এটা এ সত্যকে উপেক্ষা করে যে সউদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো সুন্নী (সউদি) ও শিয়া (ইরান) সমর্থিত গ্রæপগুলোর মধ্যে প্রবল ছায়াযুদ্ধে সিরিয়ার উগ্রপন্থীদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছে। আর এভাবে ২০১১ সালের আরব গণঅভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ার ও সফল হওয়ার কোনো সুযোগকে নস্যাৎ করে দেয়।
বিদেশী যোদ্ধা এবং ধর্মীয় যুদ্ধের উপর জোর দেয়া ইরাক , সিরিয়া ও সার্বিকভাবে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের মূল কারণকে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। এর ফলে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে দুর্বল তথ্যপূর্ণ ও বিপরীতমুখী নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন সরকার মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যত্র আইএস ও আল কায়েদার মত গ্রæপগুলোর লালন ও টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে তাদের উত্থান ও সম্প্রসারণ ঘটার ক্ষেত্রে যে বাস্তব ভূমিকা পালন করেছে তা যদি স্বীকার না করি তাহলে আমরা আবারো একই ভুল করব আর বর্তমানের আন্তর্জাতিক সহিংসতার অনিঃশেষ পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।
*নিবন্ধকার ড. ট্রিস্টান ডানিং অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ^বিদ্যালয়ের স্কুল অব হিস্টরিক্যাল অ্যান্ড ফিলসফিক্যাল স্টাডিজ-এ সংযুক্ত রিসার্চ ফেলো। তিনি ‘হামাস, জিহাদ অ্যান্ড পপুলার লেজিটিমেসিঃ রিইন্টারপ্রিটিং রেজিস্ট্যান্স ইন প্যালেস্টাইন গ্রন্থের লেখক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন