বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

শিল্পী বঙ্গবন্ধু

| প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার ; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন শিল্পী, তার শৈল্পিক চেতনার বাস্তবায়ন ঘটেছে প্রতিটি পদক্ষেপে। প্রতিটি কর্মে। বঙ্গবন্ধুর শৈল্পিক চেতনার বিভিন্ন দিক খুঁজে পাওয়া যায় তার ‘অসমাপ্ত আÍজীবনী’ গ্রন্থটি বিশ্লেষণ করে। এখানে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ও অন্যান্য ঘটনা স্থান পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উদার পরিবেশ, মননশীল পারিবরিক মূল্যবোধ, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আবহে বেড়ে উঠেছেন। আÍজীবনীতে বলেছেন- ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতি, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকেই আমি সব কাগজই পড়তাম’ (আত্মজীবনী, পৃ-১০)।
বাঙালির ভাষা-সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল একাগ্রচিত্ততা। বাংলার নদী, বাংলার জল, বাঙালির খাবার, গান, বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাকে সর্বদা মুগ্ধ করতো। শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শুনে তিনি লিখেছিলেন: ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতে ছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তার গান শুনছে’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১১১)।
১৯৭৩ সালে ফরাসি দার্শনিক আর্দে মার্লো ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন- ‘তাকে আর শুধুমাত্র একজন সাধারণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভাবা যায় না। তাকে দেখা যায় বাংলার প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বত, বৃক্ষরাজি, শস্যক্ষেত্রের মাঝে।’ বঙ্গবন্ধুর আÍজীবনীতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার, কার কী ভ‚মিকা, নিজের বিশদ ও পুঙ্খানুঙ্খভাবে স্থান পেয়েছে (পৃ. ৯১-১০০, ১৯৬-২০৭)।
বঙ্গবন্ধুর শৈল্পিক চেতনার সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন হচ্ছে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি যে একজন শ্রেষ্ঠ বাকশিল্পী তা প্রমাণ করলেন এ ভাষণে। দীর্ঘদেহী শেখ মুজিব (উচ্চতায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি), কাঁচা পাকা চুল, ভাবগম্ভীর মুখশ্রী, ভাবগরিমায় সমৃদ্ধ চকচকে দুটো চোখ, এক ব্যাখ্যাহীন কারিশমাটিক আকর্ষণে কেড়ে নিতো শতকোটি জনতার আকর্ষণ। ৭ মার্চের ভাষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে সারা বিশ্বে এখনো গবেষণা চলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈল্পিক ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশের সংবিধানের নান্দনিক উপস্থাপনার মধ্যে। দেশের প্রখ্যাত সব শিল্পীদের দায়িত্ব দেন মূল সংবিধানটি হাতে লিখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আÍত্যাগের শৈল্পিক প্রতিফলন ঘটাতে। হস্তলিখিত সংবিধানটির মূল লেখক ছিলেন শিল্পী আবদুর রউফ। সংবিধানটির অঙ্গসজ্জা করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। সংবিধানকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করার এই আগ্রহ থেকেও অনুমান করা যায় কী গভীর ছিল তার নন্দনপ্রীতি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রেরণার উৎস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীত, কবিতা, সাহিত্য প্রভৃতি নিষিদ্ধ করে। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানি দোসরদের বিরুদ্ধে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র জš§-শতবার্ষিকী উদযাপিত হয়। একই বছর প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। এসব প্রতিবাদী আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন এবং জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শিল্প সাহিত্য নিয়ে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেন। তার ভাষায়: ‘মানবাÍার সুদক্ষ প্রকৌশলী হচ্ছেন দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী। জনগণ হলো সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন কোনো সৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।’ (দৈনিক বাংলা, ১৫ ফেব্রæয়ারি ১৯৭৪)।
কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। তিনি তার সব সাংগঠনিক কার্যক্রমে শিল্পী-সাহিত্যিকদের যুক্ত করার চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনিই প্রথম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। বঙ্গবন্ধু শিল্প-সংস্কৃতির চেতনাসম্পন্ন উপযুক্ত নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সর্বজনীন শিক্ষা প্রসারে ‘কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু দেশের সৃজনশীল শিল্পী ও তাদের পোষ্যদের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতিসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কবিগুরুর সোনার বাংলাকে পবিত্রতায়, ¯িœগ্ধতায় অপরূপ করাই বঙ্গবন্ধুর জীবনের পরম প্রার্থনা, আর এই জন্যই তিনি নেমেছিলেন সংগ্রামে। ১৯৬৬ সালের ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি দিয়ে, গানটির প্রতি ছিল তার আলাদা আবেগ। এই গানটিকেই যে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করবেন সেটি বহু আগেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তার ৭৩তম জš§বার্ষিকীতে ঢাকায় নিয়ে আসার সমস্ত ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। কবি ও বঙ্গবন্ধুর মাঝে এক হƒদয়স্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল তখন। বাঙালির এই দুই বিদ্রোহীর মিলনক্ষণটি ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল এক অধ্যায় হিসেবে এরই মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু গভীর শ্রদ্ধাভরে পুষ্পমালা পরিয়ে দিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এবং সম্মানিত করলেন ‘জাতীয় কবি’ মর্যাদায় ভ‚ষিত করে। বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে নিয়ে যে সব স্বপ্ন দেখতেন, সবকিছুতেই তার শৈল্পিক বা নান্দনিক ভাবনার ছাপ থাকত।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন