শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাড়ছে সংঘাত-সহিংসতা

প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আজিবুল হক পার্থ : দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রত্যন্ত এলাকায় এ নির্বাচনের প্রচারকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সহিংসতা ততই বাড়ছে। এরই মধ্যে নির্বাচনী সহিংসতায় ৫ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে সহ¯্রাধিক। এর মধ্যে চেয়ারম্যান, মেম্বার ছাড়াও তার স্বজন ও সমর্থক রয়েছেন। সরকারি দলের প্রার্থী ও সমর্থকদের দ্বারা বিরোধী দলের প্রার্থী-সমর্থক এবং সরকারি দলের দুই গ্রুপের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বেশি। স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে বিএনপি অভিযোগ করলেও শেষ মুহূর্তে এসে অন্যান্য রাজনৈতিক দল স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং আওযামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইসিতে অভিযোগ দিয়েছেন। চলমান এই অবস্থায় আরো সহিংস ঘটনা বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের টার্গেটে ফেলা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার ভোটের আগেই প্রচার-প্রচারণা নিয়ে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতা হচ্ছে। তারা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরাই নিজেদের মধ্যে বেশি সংঘাত সৃষ্টি করছেন। দলীয় নির্বাচনের কারণে এমন সংঘাত-সহিংসতা বেড়ে গেছে। ভোটের দিন আরও বেশি সংঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।
অন্যদিকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নির্বাচন কমিশনকে আগেই বলেছিল দলীয়ভাবে এ নির্বাচন হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মাঠে রয়েছেন। ফলে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা বেশি রয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০০৭/০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ’১৪ সালের পর থেকে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলোতেই সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ইউপি নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়বে। সহিংসতার মূল কারণটিই হচ্ছে দলীয় প্রতীকে চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচন করা। আগে সহিংসতা হতো নির্বাচনের পর, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগেই সহিংসতা শুরু হয়েছে। তাছাড়া নির্বাচন হওয়ার আগেই প্রায় ১০ ভাগ চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার ঘটনাও নতুন চমক সৃষ্টি করেছে।
আগামী ২২ মার্চ দেশের ৭ শতাধিক ইউপিতে নির্বাচন। ভোটের দিন এগিয়ে আসার সাথে সাথে আতঙ্ক বেড়ে যাচ্ছে ভোটারদের মধ্যে। দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের সিদ্ধান্তের পর থেকেই ইউপিতে সংঘর্ষের আশঙ্কা করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। তারা ইসিকে সবার সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেবার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
শুক্রবার নির্বাচনী প্রচারণার নবম দিনে ভোলায় প্রতিপক্ষের হামলায় মেম্বার প্রার্থীর সমর্থক নিহত হয়েছে। চরসামাইয়া ইউনিয়নের বজলু মেম্বারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা শেষ করে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিপক্ষ মেম্বার প্রার্থী জাহাঙ্গীর সনির ছেলে শামিমের নেতৃত্বে সিরাজের ওপর হামলা করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় সিরাজকে ভোলা সদর হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার মৃত বলে ঘোষণা করেন। এছাড়া  নারায়ণগঞ্জে আ’লীগ ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে নারীসহ আহত হয়েছে ৩০ জন। লক্ষ্মীপুরে বিএনপি প্রার্থীর গণসংযোগে আওয়ামী লীগের হামলায় আহত ১০ জন। বাগেরহাটে আ’লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ১০ জন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে তফসিলের পর থেকে সারা বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলছে। গত সোমবার পটুয়াখালী জেলার বাউফলে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর উঠান বৈঠকে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আশ্রাফ ফকির (৩৫) নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয় আরো ৫ জন।
প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র জমা দানের শেষ দিন সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়। নৌকার প্রার্থীসহ অর্ধশত আহত হয়। এছাড়া পিরোজপুরের আওয়ামলীগের হামলায় নিহত হয় ছাত্রদল নেতা। লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী মোসলেহ উদ্দিনের গণসংযোগে হামলা করেছে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ফয়সাল আহমদ রতনের সমর্থকরা।এতে ২০জন আহত হয়েছে। এছাড়া সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর ওপর হামলা করেছেন বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ওপর হামলা করেছে যুবলীগের এক নেতার সমর্থকরা। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর ওপর হামলা করেছে স্থানীয় যুবলীগ।
প্রার্থীদের অভিযোগ ও আশঙ্কার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাবেদ আলী বলেন, ভোট সুষ্ঠুভাবে হবে কি না, তা নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে সবসময় আশঙ্কা থাকে, এবারো আছে। আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যেসব অভিযোগ ইসিতে এসেছে সেগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইসি সূত্র জানায়, ইউপি নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর থেকে প্রতিদিন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়ররাও নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারসহ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ছে ইসিতে। এসব অভিযোগ এসেছে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর কাছ থেকে। আর এসব অভিযোগের বিষয়ে কয়েকটি কমিটি গঠন করেই দায় সেরেছে ইসি। সব অভিযোগের তদন্ত ভার ইসি সচিবালয় ছেড়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপর। কিন্তু তারা এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না এমন অভিযোগও করেছেন প্রার্থীরা। আবার রিটার্নিং কর্মকর্তারা পর্যাপ্ত লোকবল ও পুলিশি সহায়তা পাচ্ছেন না এমন অভিযোগও করেছেন ইসি সচিবালয়ে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব সামসুল আলম বলেন, প্রার্থী, প্রতিপক্ষ ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়েও অনেকের অভিযোগ রয়েছে। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসছে তা কমিশনের নজরে আনতে ফাইলে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়েও নজর রাখা হচ্ছে। আমরা কোনো ছাড় দিচ্ছি না। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ না করতে কয়েকটি পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, তফসিল ঘোষণার ১ মাস পর গত ৮ মার্চ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ যাচাই ও নিষ্পত্তির জন্য কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কমিটি এখনো তাদের কাজ শুরু করতে পারেনি।
এদিকে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মঠ মন্দির ঘর-বাড়িতে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর এবং নারীদের ওপর নির্যাতন হওয়ার আশঙ্কা করেছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মুখপাত্র পলাশ কান্তি বলেন, দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছি সামনে দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হওয়ার কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলা হতে পারে। কারণ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন নিয়ে আমাদের আগের ঘটনা খুব একটা সুখকর নয়। নির্বাচন এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে নির্যাতন। নির্বাচনে হেরে গেলে সব দল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালায়। এবার যেহেতু দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হতে পারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন