শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

গ্যাসের জন্য হাহাকার

প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৪ এএম, ১২ মার্চ, ২০১৬

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : গ্যাস নেই, চুলা জ্বলে না। গ্যাসের জন্য চলছে হাহাকার। ঢাকা ও এর আশপাশে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, ধামরাই, কালিয়াকৈরে গ্যাস না থাকায় আবাসিক গ্রাহকদের অনেকেই হোটেল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন। গ্যাসের এই দূরবস্থা এসব এলাকার শিল্পাঞ্চলেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট আরও বেশি। গ্যাস সঙ্কটকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গতকাল (শুক্রবার) মিছিল হয়েছে। ঢাকায় এলাকাভেদে সকাল থেকে দুপুর, এমনকি বিকাল পর্যন্ত গ্যাসের দেখা মেলে না। সন্ধ্যার পর গ্যাস আসে এবং রাত গভীর হলে গ্যাসের প্রেসার বাড়ে।   
এদিকে, গ্যাস সঙ্কটের কারণে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় আকস্মাৎ বেড়ে গেছে। এসব পরিবারকে প্রতিদিন অন্তত এক বেলার খাবার হোটেল থেকে কিনে আনতে হচ্ছে চড়া দামে। এতে করে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছেন গৃহিণীরা। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানায়, গ্যাসের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম হওয়ায় এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তবে গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেকেই কেরোসিন, কাঠের চুলা, রাইস কুকার ও ইনডাকশন ওভেনে রান্না করছেন।
অন্যদিকে, গ্যাস-সংকটের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে অনেক সিএনজি স্টেশন। নারায়ণগঞ্জ, সাভার, টঙ্গী, কালিয়াকৈর, চন্দ্রা, গাজীপুরসহ রাজধানীর চারপাশের অনেক সিএনজি স্টেশনে দিনে-রাতে বেশিরভাগ সময়ই গ্যাস থাকে না। তেজগাঁও, ডেমরা, শ্যামপুর, টঙ্গী, কালিয়াকৈর, গাজীপুর, সাভার, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্প-কারখানার উৎপাদনও বিঘিœত হচ্ছে গ্যাসের চাপ ঠিক না থাকায়।
শীতকালে গ্যাসের সঙ্কট দেখা দিলেও গ্রীষ্মে কেন এমন দূরবস্থা-এ ব্যাপারে জ্বালানি বিভাগ জানায়, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের উৎপাদন কম। সেচ মৌসুম শুরু হওয়ায় গৃহস্থালী, সার কারখানা এবং সিএনজি থেকে শুরু করে বেশ কিছু শিল্প-কারখানার গ্যাস কমিয়ে বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এতে করে এসব খাতে সাময়িক সঙ্কট চলছে। তবে এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চলছে। অবশ্য পেট্রোবাংলা জানায়, গ্যাস সঙ্কটের বড় একটি কারণ অবৈধ সংযোগ। তবে সঙ্কট সমাধানে তিতাস কর্তৃপক্ষ রেশনিং পদ্ধতিতে গ্যাস সরবরাহের চিন্তা-ভাবনা করছে।
আবাসিক খাতে গ্যাসের সঙ্কট দেখা দেয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ গৃহিণীরা। রান্নার গ্যাস না পাওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইব্রাহিমপুরের বাসিন্দা ঝরনা বেগম। তার বাসায় সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এতে করে তার পরিবারের সদস্যদের দুই বেলার খাবার হোটেল থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। এমন দুর্ভোগের কারণে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে তিনি জানান।
পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা আকলিমা হোসেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সকাল ৭টার মধ্যে তাকে বের হতে হয় কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে তার পরিবারের সদস্যরা সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার বৈদ্যুতিক চুল্লিতে রান্না করছে। রাতে গ্যাস আসে ৯টার পর। তখন রাতের খাবার গ্যাসের চুলায় রান্না হয়।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শিখা রানী বলেন, আমাদের এলাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্যাসের চুলা জ্বলে না। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, শীতের মধ্যে গভীর রাতে পরদিনের রান্না করে রাখতে হয়। এটা অসহনীয়। দুর্ভোগ কমাতে তিনি কখনো বৈদ্যুতিক চুলায় আবার কখনো কেরোসিনের চুলা ব্যবহার করছেন।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছেÑ রামপুরা, বনশ্রী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী ও পুরানো ঢাকার কিছু এলাকায় গ্যাস সংকট ছিল সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকার অনেক স্থানে সকালেই গ্যাস উধাও। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক হতে হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। কোথাও বা রাত। এছাড়া পশ্চিম ও পূর্ব দোলাইরপাড় মতিঝিলের কিছু অংশসহ পূর্বাঞ্চলীয় অনেক এলাকায় শীতকাল থেকে টানা গ্যাস সংকট চলছে। এতে করে কয়েক হাজার পরিবার দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। বিশেষ করে সকাল ৭টার পর গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। বিকালেও অনেক এলাকায় চুলা জ্বলে না। এসব এলাকার সমস্যার জন্য অবৈধ গ্যাস সংযোগকে দায়ী করেছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান।
তিতাস গ্যাস কোম্পানির পরিচালক (উৎপাদন) মীর মশিউর রহমান সমস্যার বিষয় স্বীকার করে বলেন, ১৮শ’ থেকে প্রায় ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। এই ঘাটতির কারণে আবাসিকখাতে গ্যাসের সমস্যা দেখা দিয়েছে। তার মতে, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত সিএনজি স্টেশনগুলো যখন বন্ধ থাকে, তখন স্থানীয় আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের সমস্যা হয় না। সিএনজি স্টেশন চালু হলেই আবাসিক খাতে গ্যাসের প্রেসার কমে যায়। তখন এই সমস্যা দেখা দেয়। তিনি গ্যাস সঙ্কটের জন্য অবৈধ গ্যাস সংযোগকে দায়ি করে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ পাইপলাইন বসানোর সময় এলাকার একটি হিসাব অনুযায়ী পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু যত্রতত্র অবৈধ সংযোগের কারণে সরবরাহ লাইন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়েই গ্যাসের এই সঙ্কট।
গ্যাসের অবৈধ সঙ্কট প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলা জানায়, বর্তমানে অবৈধ গ্রাহকের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই এসব গ্রাহকরা অবৈধভাবে শিল্প ও আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ নিয়েছে এবং ব্যবহারও করছে।
চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট
চট্টগ্রাম কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বর্তমানে ৪৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে সরবরাহ মিলছে মাত্র ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার তুলনায় অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ পাওয়ায় চট্টগ্রাম মহানগরীতে তীব্র গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
কেজিডিসিএল কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের ভারী শিল্প-কারখানায় দৈনিক মাত্র ১২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। একইভাবে সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে প্রতিদিন দুপুর ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এরপরও যে সময় সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাস পাওয়ার কথা সে সময় গ্যাসের চাপ না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে শত শত যানবহনকে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেক যানবাহন মালিক এখন গ্যাসের পরিবর্তে অকটেনে গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
গ্যাস সরবরাহ অর্ধেকেরও কম হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিদিন গ্যাসের জন্য হাহাকার করছে জনগণ। নগরীর বাকলিয়া, চকবাজার, চাক্তাই, বহদ্দারহাট, জামালখান, কাজীর দেউড়ি, আন্দরকিল্লা এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় জনগণকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এছাড়া নগরীর নাসিরাবাদ, খুলশী, জাকির হোসেন রোড, ষোলশহর, চকবাজার, কাপাসগোলা, বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, অক্সিজেন, বায়েজিদ, হামজারবাগ, আগ্রাবাদ, মাদারবাড়ি, মোমিন রোড, আসকারদীঘির পাড়, আন্দরকিল্লা, আগ্রাবাদ, চান্দগাঁও, বায়েজিদসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ একেবারেই কম। এত করে এসব এলাকার চুলা জ্বলে নিভু নিভু করে। এসব এলাকায় হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোরও একই অবস্থা।
অ্যাক্ট আছে, প্রয়োগ নেই
অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা বিষয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর অভিমত হচ্ছে, গ্যাস অ্যাক্ট থাকলেও তা কাজে আসছে না। স্থায়ীভাবে তাদের সংস্থায় কোনো ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় এ সংক্রান্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের কাছে বার বার চিঠি লেখার পরেও সাড়া মিলছে না। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অনেক সময় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে পাওয়া যায় না। হুমকির মুখে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করেই কোনো কোনো সময় টাস্কফোর্সকে অভিযান গুটিয়ে ফিরে আসতে হয়।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাসিকসংযোগ রয়েছেÑ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির। সেখানে মোট বৈধ আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এরপর কর্ণফুলী এবং বাখরাবাদ কোম্পানির অবস্থান। স্বাভাবিকভাবে তিতাস, কর্ণফুলী ও বাখরাবাদেই অবৈধ সংযোগের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে কোন কোন এলাকায় কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ সেটা চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, আবাসিকখাতে গ্যাস সংযোগ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার কথা ভাবছে সরকার। তিনি বলেন, আমাদের গ্যাসের আধার ফুরিয়ে আসছে। চাহিদার তুলনায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে কম। এ অবস্থায় তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস-এলপিজি ব্যবহার বাড়াতে হবে। এলপিজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে কিনা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলপিজি ব্যবহার শুরু হলে চাহিদা মোতাবেক অবশ্যই সরবরাহ করা যাবে।
অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে? জানতে চাইলে নসরুল হামিদ বলেন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সঙ্কট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেচ মৌসুমের কারণে এই সমস্যা সাময়িক। এটি উত্তোরণের চেষ্টা চলছে।












































 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন