শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সাঁতার শেখানোর ব্যাতিক্রমী সময়োচিত উদ্যোগ ও দৃষ্টান্ত

| প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে অনেক শিশু-কিশোর-যুবক শুধুই সাঁতার না জানার কারণে
বিশেষ সংবাদদাতা, চট্টগ্রাম ব্যুরো : চৌধুরী তাহমিদ জসীম আপন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুলের ৮ম শ্রেণির এই মেধাবী ছাত্রটি পবিত্র ঈদে সাতকানিয়ায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে পুকুর ঘাটে পা পিছলে পানিতে পড়ে যায়। পাড়ে উঠতে পারেনি সে। উদ্ধার করা হয় ফুটফুটে কিশোরের নিথর মৃতদেহ। পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজনের বুকফাটা কান্নায় গ্রামজুড়ে মুহূর্তেই ঈদের আনন্দ পরিণত হয় করুণ বিষাদের আখ্যানে। তাহমিদে সাঁতার জানা ছিল না! মাত্র ক’দিন আগে (১৬ আগস্ট) সীতাকুন্ডের সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র নাকিব মোহাম্মদ খাব্বাব। পানিতে নেমে ডুবে যান তিনি এবং নিখোঁজের ২০ ঘণ্টা পর সাগরে জেলেদের জালে নাকিবের লাশ পাওয়া যায়। সাঁতার জানতেন না খাব্বাবও। তাহমিদ, খাব্বাবেই শেষ নয়; পুকুর-দীঘি, খাল-নদী-হাওর কিংবা সাগরের পানিতে মনের আনন্দে নেমে এমনকি গোসল করতে গিয়েও মর্মন্তুদভাবেই ডুবে মারা যাচ্ছে অনেক শিশু-কিশোর-কিশোরী, যুবক-তরুণ-তরুণী। এর প্রধান কারণটি হলো সাঁতার না জানা। আগের প্রজন্মের মানুষের সাঁতারের শখ আর অভ্যাস দুইই ছিল। কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে তা বলতে গেলে অজানা ও ভয়ের বিষয়ই রয়ে গেছে। এতে করে বেঘোরে অনেকেরই মৃত্যু ঘটতে পানিতে ডুবে গিয়ে।
পাঠ্য-পুস্তকে সুকুমার রায়ের বিখ্যাত সেই ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতার শেষ স্তবকে সাঁতারের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে জীবন বাঁচানোর জরুরী শিক্ষণের অংশ হিসেবেই- ‘মূর্খ মাঝি শুধায় “সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু, মূর্খ মাঝি বলে, ‘মশাই এখন কেন কাবু? বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”
তবে আশার কথা ইদানীং সাঁতার জানা, শেখা ও শেখানোর দিকে ঝোঁক বেড়ে যাচ্ছে ক্রমেই। চট্টগ্রাম ইস্পাহানি স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির মেধাবী কিশোর রাওহা তাজওয়ার শারাফ ইনকিলাবকে জানায়, গতবছর তার পিতার সঙ্গে গিয়ে নগরীর চকবাজারে একটি পুকুরে বেশ কিছুদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে সাঁতার শিখেছে সে। রাওহা জানায়, তার অনেক বন্ধুও ও পরিচিতজন সাঁতার শিখে নিয়েছে। একের উৎসাহে আরেকজন এভাবে সাঁতার শেখার তাগিদ অনুভব করছে।
‘সাঁতার শিখুন জীবন বাঁচান’ এই আহ্বান তুলে ধরে চট্টগ্রামে সবেমাত্র শুরু হয়েছে সাঁতার শেখানোর ব্যাতিক্রমধর্মী এক কর্মসূচি। যা হয়ে উঠতে পারে সমগ্র দেশের জন্যই সময়োচিত এবং অনন্য দৃষ্টান্ত। গত ১৮ আগস্ট (শুক্রবার) রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিজ দায়িত্ববোধ থেকেই নিয়েছেন মহতি উদ্যোগ। স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন এবং উপজেলা স্কাউটস ও গার্ল গাইডসের সহযোগিতায় চালু হয়েছে এই কর্মসূচি। গতকাল (সোমবার) রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ শামীম হোসেন রেজা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ‘আমার তো ঘুম নেই! কারণ শুধুই আমার উপজেলাতেই গত ৬ মাসে পানিতে ডুবে মারা গেছে ৩৮ জন কচি শিশু-কিশোর, তরুণ। কারণ একটাই সাঁতার না জানা। কিন্তু সাঁতার না শিখে তো পানিতে নামা যায় না বা উচিৎ না!’ ঢাকার দোহার নিবাসী এই কর্মকর্তা নিজেও শিক্ষাজীবনে পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁতারু একথা জানিয়ে বলেন, উপজেলা প্রশাসনের কাজ শুধু ‘শাসন’ করা নয়; সমাজ, দেশের প্রতি ভালো অনেক কাজই করার রয়েছে। সেই তাগিদ থেকেই আমার নিজের সরকারি বাংলোর ‘ফুলঝুরি’ নামক পুকুরটিকে সুইমিং পুল হিসেবে কাজে লাগিয়ে শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানোর কাজটি হাতে তুলে নিলাম। এখন থেকে প্র্রতি শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অর্ধেক সময় ছেলেদের জন্য এবং বাকি অর্ধেকটা সময় মেয়ে তথা কিশোরী বিশেষত ছাত্রীদের সাঁতার শেখানোর জন্য সবরকম ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সামনের শুক্রবারে (২৫ আগস্ট) চলবে সাঁতার শেখা ও শেখানোর কার্যক্রম।
ইউএনও মোঃ শামীম হোসেন রেজা আরো জানান, সাঁতার শিখতে শিশু-কিশোর, তরুণদের সবাইকে আগ্রহী করে তোলার নানামুখী উদ্বুদ্ধকরণ তৎপরতা চলছে। আমি ঘোষণা দিয়েছি এভাবে, ‘আপনার সন্তানকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে আসুন। আমি নিজেই সুইমিং পুলে থেকে বিনামূল্যে শেখাবো, কোর্স শেষ হলে সার্টিফিকেট দেবো এমনকি পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে। হবু সাঁতারুরা সকালের নাশতাও পাবে। আমি শিশু-কিশোরদের সাথে বন্ধুসুলভ সবসময়ই। তাই আমার জোরালো প্রত্যাশা ভালো সাড়া পাবো, মিশন সফল হবে। সাঁতার শেখানোর জন্য সুইমিং পুলে রূপান্তরিত সেই পুকুরে প্রাথমিক পর্যায়ে ৭টি টিউব, ১০টি লাইফ জ্যাকেট, রশিসহ হরেক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে। ইউএনওসহ ফায়ার সার্ভিসের দক্ষ সাঁতার প্রশিক্ষক যেমন আছেন তার সঙ্গে পুকুরটিকে বাঁশ ও রশি দিয়ে লাল-সবুজ রঙে চিহ্নিত করে তিনটি সারি করা হয়েছে। পুকুর ও আশপাশের এলাকা সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে নিরাপত্তার খাতিরে।
স্কাউটস এবং গার্লস গাইডস (মেয়ে শিশু-কিশোরীদের জন্য), ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা থাকছেন সাঁতার শেখানোর পুরো সময়েই। দিনে দিনে সবার আগ্রহ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে এমনকি উদ্যোগটি দেশময় ছড়িয়ে পড়তে পারে এমনটি প্রত্যাশা প্রশাসনের। এই ব্যাতিক্রমী উদ্যোগটি নিয়ে এখন মুখে মুখে উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনাও হচ্ছে এখানে-সেখানে! শামীম রেজা আরো জানালেন, তার এলাকায় মাদক, সন্ত্রাস, ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ আর অপরিচ্ছন্নতার কোন চিহ্ন খুব শিগিগিরই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই লক্ষ্য নিয়েই এগুচ্ছেন তিনি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী এবং সর্বস্তরের এলাকাবাসীর কাছ থেকে উৎসাহ-উদ্দীপনাও পাচ্ছেন বলে জানান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন