শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

শরণার্থী থেকে নায়করাজ

কিংবদন্তী অভিনেতা রাজ্জাকের ইন্তেকাল

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:১৬ এএম, ২২ আগস্ট, ২০১৭

ভারত থেকে শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে নায়ক রাজ রাজ্জাক। কারণ, কলকাতায় মুসলিম ঘরে জন্ম নেয়ায় মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমা এবং টালিগঞ্জের বাংলা সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রচন্ডভাবে হন উপেক্ষিত; সেখানে সবকিছুতেই হিন্দুদের প্রাধান্য দেয়া হয়। খ্যাতির প্রত্যাশায় জন্মগত মুসলিম নাম ঢেকে দিয়ে মোহাম্মদ ইউসুফ খান হিন্দু নাম দীলিপ কুমার ধারণ করলেও সে পথে হাঁটেননি রাজ্জাক। ভারতের সাংস্কৃতি পরিমন্ডলে ধর্মগত কারণে প্রতিভাবান মুসলমানদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য কিশোর রাজ্জাকের মনে দাগ কাটে। মাথায় মস্তবড় অভিনেতা হওয়ার নেশা। সংসারে বাবা-মা নেই। এক সময় শরণার্থীর তালিকায় নাম লিখিয়ে চলে আসেন মুসলমানের বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। অতপরের ইতিহাস মহা-নায়ক রাজ নায়ক...।
বাংলা সিনেমার রাজপুত্তুর, কিংবদন্তী, রাজ নায়ক সব উপাধিই তার নামের সঙ্গে মানানসই। দেশের সাংস্কৃতি অঙ্গনের সবার প্রিয় রাজ্জাক ভাই। হ্যাঁ! ঢাকার সিনেমা জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র রাজ নায়ক রাজ্জাকের কথাই বলছি!! বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে দাপুটে-শক্তিশালী, কিংবদন্তী অভিনেতা নায়ক রাজ রাজ্জাক আর নেই। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী খায়রুন নেসা ল²ী, তিন ছেলে বাপ্পারাজ, বাপ্পি ও সম্রাট এবং দুই মেয়ে শম্পা ও ময়নাকে রেখে গেছেন। তার ছেলেরা সবাই চলচ্চিত্রে অভিনয় এবং ব্যবসায় জড়িত।
হঠাৎ করে গতকাল সন্ধ্যায় যেন এফডিসিসহ ঢাকার শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে অন্ধকার নেমে আসে। এক রাশ আঁধারে ঢেকে যায় রঙিন শহর ঢাকা। কিছুদিন ধরে নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগে নায়ক রাজ রাজ্জাক ইন্তেকাল করেছেন। খবর পেয়ে দেশের তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে সাংস্কৃতি অঙ্গনের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা ছুঁটে যান হাসপাতালে। সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। খবর সংগ্রহের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন টিভি মিডিয়ার ক্যামেরা পারসনরা। তার মৃত্যুতে চলচিত্র অঙ্গনে তিন দিনের কর্মবিরতির ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি ও শিল্পী সমিতি। মরহুমের পুত্র সম্রাট জানান, আজ বাদ জোহর গুলশানের আজাদ জামে মসজিদে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
পাঁচ শ’র বেশি সিনেমার নায়ক-অভিনেতা রাজ্জাক বাংলাদেশের মানুষের কাছে নায়করাজ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সাদা-কালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে ছিল তার উপস্থিতি। ঢাকার চলচিত্র অঙ্গনের অনেকেই ব্যক্তি সুবিধা এবং কিছু প্রাপ্তির আশায় সিনেমার পরিচিতির সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক ভোল পাল্টিয়েছেন, রাজনৈতিক দলের জার্সি পড়ে বিরোধ-বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ে কিছু কামিয়েছেন; প্রগতিশীলতার দোহাই দিয়ে হিন্দুত্ববাদী এবং অপসংস্কৃতির চর্চার নামে দিল্লি-কলকাতাকে খুশি করতে ব্যস্ত হয়েছেন; কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন রাজ্জাক। কলকাতায় জন্ম নিয়েও তিনি বাংলাদেশের মা-মাটি মানুষের কৃষ্টি-সংস্কৃতির বাইরে নিজেকে শঁপে দেননি। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রক্ষপুত্র-তিস্তা ছিল তার ঠিকানা। সংস্কৃতি চর্চার নামে প্রগতিশীলতার নামে কখনো ভনিতা করেননি। তার মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক পৃথকভাবে শোক প্রকাশ করেছেন। আলাদা বিবৃতিতে তারা মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।
রাজ্জাক বিবিসির এক সাক্ষাৎকার তার ঢাকায় আগমনের গল্প তুলে ধরেছিলেন। তিনি ১৯৬৪ সালে শরণার্থী হিসেবে ঢাকায় আসেন। রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। শৈশবেই তিনি বাবা-মাকে হারান। কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করেন। অতপর নাট্যাঙ্গনে নিজেকে জড়ান। অভিনেতা হওয়ার মানসে ১৯৬১ সালে কলকাতা থেকে হিন্দি ছবির রাজধানী খ্যাত মুম্বাই পাড়ি দেন; ধর্মে মুসলমান হওয়ায় সেখানে সফল হতে না পেরে ফিরে আসেন কলকাতার টালিগঞ্জে। মুসলমান হওয়ায় কলকাতার বাংলা সিনেমায়ও সুবিধা করতে না পারায় ১৯৬৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন রাজ্জাক। ঢাকায় প্রথম দিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। নানা প্রতিক‚লতা পেরিয়ে তিনি আবদুুল জব্বার খানের সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সিনেমায় প্রথমে কাজ শুরু করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ সিনেমায় ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ‘ডাকবাবু’, উর্দু ছবি ‘আখেরি স্টেশন’সহ কয়েকটি সিনেমায় ছোট ছোট ভ‚মিকায় অভিনয় করেন তিনি। এক সময় প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও পরিচালক জহির রায়হানের নজরে পড়েন রাজ্জাক। তিনি ‘বেহুলা’য় লখিন্দরের ভ‚মিকায় অভিনয়ের সুযোগ দেন রাজ্জাককে। নায়িকা জনপ্রিয় নায়িকা সুচন্দা। ‘বেহুলা’ ব্যবসাসফল হওয়ায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে।
দারুণ অভিনয় শৈলীর অধিকারী সুদর্শন রাজ্জাক নায়িকা সুচন্দার পর কবরী, ববিতা, শাবানা, সুজাতা, অলিভিয়াসহ তখনকার প্রায় সব অভিনেত্রীকে নিয়ে একের পর এক ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দেন ঢাকার সিনেমা অঙ্গনকে। তবে কলকাতার উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতোই ঢাকায় রাজ্জাক-কবরী জুটি ছিল ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
রাজ্জাক ঢাকাই সিনেমার ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’, ‘দুই ভাই’, ‘মনের মতো বউ’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, বেঈমান’, ‘আলোর মিছিল’, ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘স্বরলিপি’, ‘কি যে করি’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘আনারকলি’, ‘বাজিমাত’, ‘লাইলি-মজনু’, ‘নাতবউ’, ‘মধুমিলন’, ‘অবুঝ মন’, ‘সাধু শয়তান’, ‘মাটির ঘর’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘কালো গোলাপ’, ‘নাজমা’সহ অসংখ্য ব্যবসাসফল সিনেমার নায়ক ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’ দিয়ে বাংলাদেশে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের সূচনাও ঘটান রাজ্জাক। অভিনয়ের পাশাপাশি এক সময় পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি বদনাম, সৎ ভাই, চাপা ডাঙ্গার বউসহ ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় সম্মাননা বাংলাদেশের লাখ লাখ সিনেমাপ্রেমীর ভালোবাসা। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেন তিনি। রাজ্জাকের মৃত্যু যেন ঢাকার বাংলা সিনেমার একটি যুগের অবসান হলো।

বিএফডিসিতে নেয়া হবে সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে ১২টায় আজাদ মসজিদে জানাযা বেলা আড়াইটা বনানী কবরস্থানে দাফন আজ বাদ আসর  

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
Md.Ismail ২২ আগস্ট, ২০১৭, ৮:০৩ এএম says : 0
May Allah bless her departed soul!!!
Total Reply(0)
Sudhir Sarker ২২ আগস্ট, ২০১৭, ১১:৩৬ এএম says : 0
তার আত্মার শান্তি কামনা করছি
Total Reply(0)
Md Parvez ২২ আগস্ট, ২০১৭, ১১:৩৭ এএম says : 0
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন।।
Total Reply(0)
M D Rezaul Karim ২২ আগস্ট, ২০১৭, ১১:৩৭ এএম says : 0
So....Sad
Total Reply(0)
আজিজ ২২ আগস্ট, ২০১৭, ১১:৪১ এএম says : 0
বাংলা সিনেমার রাজপুত্তুর, কিংবদন্তী, রাজ নায়ক সব উপাধিই তার নামের সঙ্গে মানানসই।
Total Reply(0)
Mohd. Motaleb Bhuiyan (Swapan) ২২ আগস্ট, ২০১৭, ৫:১৬ পিএম says : 0
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি
Total Reply(0)
azmal hossain ২২ আগস্ট, ২০১৭, ৫:৩৭ পিএম says : 0
Innalillahe wo innailahe raziun
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন