আফজাল বারী : বিএনপিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বিস্তৃত হচ্ছে। এই পদের কাজ সুনির্দিষ্ট করতে দলের গঠনতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার প্রস্তাব আনা হয়েছে। সুপারিশ আকারে গেছে সংশ্লিষ্ট কমিটিতে। তবে তা বাস্তবায়নে আসন্ন কাউন্সিলের অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ইনকিলাবকে জানিয়েছেন দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের প্রভাবশালী ও প্রবীণ ৮ জন নেতা। বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করছে কাউন্সিলের ড্রাফটিং কমিটি। তারা রেজুলেশনে প্রস্তাবনাটি তুলে ধরবেন। এ তথ্য জানিয়েছেন কমিটিরই একজন।
একই সূত্র জানায়, মহাসচিবের দায়িত্ব কিছুটা সাংগঠনিক। সিদ্ধান্ত সরাসরি নেয়ার ক্ষমতা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের ওপর অর্পণ করার দাবি উঠেছে। অতিরিক্ত আরেকটি মহাসচিবের পদ সৃষ্টি করার প্রস্তাব ও সুপারিশ এসেছে সংশ্লিষ্ট কাউন্সিল উপ-কমিটিতে।
এদিকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থাকছে প্রায় চেয়ারপারসনের সমানই। বাড়তি হিসেবে থাকছে সাংগঠনিক বিষয়াদি দেখাশোনারও। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের কর্মের পরিধি বাড়ানো হলে এবং অতিরিক্ত মহাসচিব পদ সৃষ্টি করা হলে দলের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা হবেন মহাসচিব। কাজের পরিধিও ছোট হবে। তবে বিষয়গুলো নির্ভর করছে আসন্ন কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের মতামতের ওপর।
সূত্রমতে, ২৪ বছর ধরে রাজনীতি সঙ্গে জড়িত জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে তারেক রহমান। প্রথম দিকে তিনি পর্দার অন্তরালে অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপিকে সরকারে আনার বিষয়ে একাডেমিক কাজ থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয়ে রিসার্চ সেলের মতো করে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীকালে ২০০১ সালে সক্রিয়ভাবে তিনি জনগণের সামনে আসেন রাজনীতিতে। বাবার আদর্শকে সামনে রেখে তারেক রহমানও জনগণের পাশে যেতেন। তিনি তৃণমূলে জোয়ার ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু প্রতিপক্ষ এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। পরিকল্পিতভাবে তাকে নানাভাবে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ১/১১-এর নিপীড়নের শিকার হয়ে তিনি দীর্ঘ ৯ বছর প্রবাসে চিকিৎসাধীন। দেশে ফেরার পথে পাহাড়সম বাধা।
দলীয় সর্বশেষ গঠনতন্ত্র থেকে জানা গেছে, বিএনপির সর্বশেষ সংশোধিত গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যান ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও মহাসচিবের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ নেই। আসন্ন কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে মহাসচিবের কর্তব্য, ক্ষমতা দায়িত্বের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ থাকছে না। তবে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিষয়ে সাংগঠনিক কিছু বিষয় সংযোজন করা হবে। এতদিন পদধিকার বলে মহাসচিবের ওপর যেসব সাংগঠনিক দায়িত্ব ছিল এর বেশ কিছু দায়িত্ব যাচ্ছে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্বে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়নের কারণে বিগত সময়ে মহাসচিবকে বারবার কারাগারে যেতে হয়েছে। ফলে সাংগঠনিক কাজে ব্যাপক ধাক্কা লাগে। বারবার উদ্যোগ নিয়েও সফল হওয়া যায়নি। এবার সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে এমন ক্ষমতা দেয়ার কথা প্রস্তাব আনা হয়েছে যাতে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।
বর্তমান গঠনতন্ত্রমতে, দলের সর্বময় ক্ষমতা চেয়ারপারসনের হাতে ন্যস্ত আছে। তিনি কাল-পাত্র বুঝে মহাসচিব পরিবর্তনসহ দলের যে কোনো নেতার অপসারণ, পদায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। এমনকি কাউন্সিল ছাড়াই নির্বাহী কমিটিও গঠন করে দিতে পারেন। এবার এসব বিষয়ে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। পাশাপাশি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগ আরো বাড়াতে কিছু সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। মোদ্দা কথা, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদের দায়িত্বটা এমন করার চিন্তা আছে যে, প্রয়োজনে চেয়ারম্যানের এবং সময়ের প্রয়োজনে মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করতে যেন গঠনতান্ত্রিক বাধার সৃষ্টি না হয়। এখন গঠনতন্ত্রে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব হচ্ছে Ñ (ক) সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালনে চেয়ারম্যানকে সহযোগিতা করবেন এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক অর্পিত যে কোনো দায়িত্ব পালন করবেন। (খ) চেয়ারম্যানের সাময়িক অনুপস্থিতিতে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। (গ) যে কোনো কারণে চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান চেয়ারম্যানের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
এদিকে বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল সামনে রেখে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে একটি উপ-কমিটি করা হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের প্রায় ৫৫টি সংশোধনী প্রস্তাবনাসহ উপকমিটির সদস্যদের প্রস্তাব নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়। এরপর চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি সাবজেক্ট কমিটি গঠন করা হয়। উপকমিটির নির্দেশনার আলোকে এই সাবজেক্ট কমিটি গঠনতন্ত্র সংশোধনের লক্ষ্যে এ চূড়ান্ত সুপারিশ পত্র তৈরি করেছে। প্রস্তাবনা ও সুপারিশ পত্রে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, চেয়ারপারসনের পদ শূন্য হলে ওই পদে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করার কথা বলা হয়েছে। এ অবস্থায় পরবর্তী কাউন্সিলের আগ পর্যন্ত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানই চেয়ারপারসনের সব কর্তব্য ও ক্ষমতা ভোগ করবেন। এই প্রস্তাবনার বাইরে দলের স্থায়ী কমিটি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের ক্ষমতায় সাংগঠনিক কয়েকটি ইস্যু সংযোজন করবেন বলে জানা গেছে। গতকাল এক সভায় অনানুষ্ঠানিক প্রস্তাব বিষয়ে খোলাসা করেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি জানান, ‘সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান’ পদের কাজ সুনির্দিষ্ট করতে দলীয় গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা নিজেরাই কিন্তু সাংগঠনিকভাবে তারেক রহমানকে অনেকটা নিষ্ক্রিয় করে রেখেছি। সঠিকভাবে তার কাছে কোনো দায়িত্ব নেই।
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবেন। তাহলে ‘চেয়ারপারসন যতক্ষণ উপস্থিত থাকবেন, তারেক রহমান নিষ্ক্রিয় থাকবেন?’ গয়েশ্বর বলেন, তারা এখন ওই পদের দায়িত্ব আরও বিস্তৃত করতে চান। যেমন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সার্বক্ষণিক দপ্তরের দায়িত্ব পালন করেন। তেমনি স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ থাকে না, পার্টির চেয়ারম্যান যখন নির্দেশ দেন, সেখানে কাজ করতে পারি। আমরা জানি না, তারেক রহমানের দায়িত্ব কী? তিনি কথা বলতে চেষ্টা করেন। সেই কথা বলাটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেই কারণেই তারেক রহমানকে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে নেতা-কর্মীরা জানতে পারবেন, এই দায়িত্বটা উনার (তারেক) ওপর আছে, তারা সেভাবে যোগাযোগ করে কথা বলে সেভাবে কাজ করতে পারবেন।
সম্প্রতি চেয়ারপারসন পদে মায়ের (খালেদা জিয়া) পাশাপাশি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে তারেক রহমান ইতোমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী ১৯ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে তা অনুমোদন পাবে। বিভিন্ন মামলায় হুলিয়া নিয়ে লন্ডনে অবস্থানের মধ্যে গত কাউন্সিলে ওই পদে নির্বাচিত হন তিনি। এবারো পুনর্র্নির্বাচিত হলেন। এক দশক আগে মহাসচিবের পর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের একটি পদ সৃষ্টি করে রাজনীতিতে আনা হয়েছিল তারেক রহমানকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন