শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

উপেক্ষিত রোগীর চিকিৎসা-পুনর্বাসন

| প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : প্রতিবছর লক্ষাধিক কর্মক্ষম জীবন কেড়ে নিচ্ছে তামাক। পঙ্গু করছে প্রায় ৪ লাখ মানুষকে। পরিবেশ-প্রতিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, জমির উর্বরতা, শিশুশ্রম, শিক্ষাসহ উন্নয়নের প্রায় প্রতিটি স্তরেই নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে তামাক। আর তাই তামাকবিরোধীদের নিয়মিত আন্দোলন ও দাবির প্রেক্ষিতে সরকার বিগত ২০১৪-১৫ বাজেটে তামাকপণ্যে ১ শতাংশ হারে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করে। গত তিন অর্থবছরে ৯০০ কোটি টাকা সারচার্জ জমা হয়েছে। সারচার্জ ব্যবস্থা চালুর সময় বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, সারচার্জ থেকে অর্জিত অর্থ ‘তামাক ব্যবহারজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে’ ব্যয় করা হবে। অথচ এই অর্থ ‘স্বাস্থ্য উন্নয়নে’ বিশেষ করে রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ে ব্যবহার না করে, কেবল হেলথ প্রমোশন বা অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে (সচেতনতা, গবেষণা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে) ব্যয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতি-২০১৬’র চূড়ান্ত খসড়ায়। যে কোন সময় মন্ত্রীপরিষদে এটি উঠবে। এটি পাস হলে হেলথ প্রমোশনের নামে অর্থ লুটপাটের আশঙ্কা করছেন তামাকবিরোধীরা।
তামাকবিরোধীদের মতে, তামাকের ভয়াবহ ক্ষতির শিকার যেসব রোগী মানবেতর জীবন-যাপন করছেন তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্যই সারচার্জ আদায়ের আন্দোলন হয়। সারচার্জের অর্থ চিকিৎসা সেবায় ব্যয় করতে হবে। কারণ ধূমপানের কারণে ৮টি ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এরমধ্যে ক্যান্সার, হৃদরোগ, যক্ষাসহ ব্যয়বহুল বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতিদিনই নিস্ব হচ্ছে মানুষ। ভিটে-বাড়ী খোয়াতে হচ্ছে। দেশের প্রায় ৭০শতাংশ মানুষ নিজ পকেট থেকে চিকিৎসা ব্যয় বহন করছে। আর তাই সারচার্জের অর্থ এসব ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসায় বরাদ্দ দেয়ার কথা বলছেন। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আদায় এবং আদায়কৃত অর্থ কার্যকরভাবে ব্যবহার না করতে পারলে তামাকের ছোবল-“তামাক মহামারি” থেকে জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তামাকবিরোধী আন্দোলনের নেতা ডা. অরুপ রতন চৌধুরী বলেন, তামাকের কারণে প্রতিদিনই বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তাই চিকিৎসা-পুনর্বাসনে এ টাকা ব্যবহার করা উচিত। তিনি বলেন, তামাকের ক্ষতি সম্পর্কে মানুষ এখন সচেতন। তাই চিকিৎসার দিকে অধিক গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। প্রস্তাবিত খসড়া পুনর্বিবেচনারও দাবি করেন তিনি।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে আরোপিত এক ধরনের শুল্ক-যা সাধারণত জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য যেমন- তামাক, অ্যালকোহল ইত্যাদির ওপর আরোপ করা হয়ে থাকে। এ ধরনের শুল্ককে ‘সিন ট্যাক্স’ নামেও অভিহিত করা হয়। মূলত ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার হ্রাস ও ব্যবহারজনিত অসুখের চিকিৎসা খরচ মেটাতেই সারচার্জ আরোপের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ করা হয়। বিশ্বজুড়ে সারচার্জ আরোপ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১১টি দেশে তামাকপণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক হিসেবে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আদায় করা হয়। দেশগুলো হচ্ছে- ভারত, থাইল্যান্ড, নেপাল, কাতার, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, আইসল্যান্ড ও এস্তনিয়া অন্যতম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সারচার্জ হিসেবে আদায় করা অর্থ সংশ্লিষ্ট রোগের চিকিৎসা, তামাক নিয়ন্ত্রণসহ নানাবিধ কাজে ব্যয় করছে। ভারতে এ অর্থ দিয়ে ‘বিড়ি ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে। এ ফান্ডের মাধ্যমে নিবন্ধিত বিড়ি শ্রমিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, সন্তানদের স্কুল ড্রেস, বৃত্তি ইত্যাদি প্রদান করা হয়ে থাকে। থাইল্যান্ডে এ অর্থ দিয়ে ‘থাই হেলথ ফাউন্ডেশন’ গঠন করা হয়েছে যা তামাকের ব্যবহার হ্রাসে নানাবিধ কর্মকান্ড যেমন- গবেষণা, মিডিয়া ক্যাম্পেইন ইত্যাদি পরিচালনা করা হয়। নেপালে এ সারচার্জের টাকায় গঠিত ‘হেলথ ট্যাক্স ফান্ড’ থেকে বিপি কৈরালা মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল, নেপাল ক্যান্সার রিলিফ সোসাইটিসহ অন্যান্য কমিউনিটি হাসপাতালে সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। অস্ট্রিয়া, কোরিয়া, ব্রæনাই, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কিছু দেশ তাদের জাতীয় বাজেটের রাজস্ব আয় থেকেই হেলথ প্রমোশন ফান্ড গঠনের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন-২০১৬’র তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর ৬৪ লাখ মানুষ চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে দরিদ্রতার শিকার হচ্ছে। চিকিৎসা সেবায় এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান শর্ত ইউনির্ভাসেল হেলথ কাভারেজ বাস্তবায়ন। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও তা মাত্র টাঙ্গাইলের দুটি থানায় পাইলটিং পর্যায়ে রয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও বীনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত দেশের ৬০ ভাগের বেশি মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে ধূমপানের কারণে ৯২ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। পঙ্গু হয় প্রায় ৪ লাখ মানুষ। এছাড়া স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্যান্সার, ব²ব্যাধি, ডায়াবেটিকসহ প্রাণঘাতী সব রোগের প্রধান উৎস তামাক।
তাই তামাকের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ব্যয়ে ব্যবহারের পাশাপাশি সারচার্জের অর্থ তামাকের ক্ষতিকর দিক ও তামাক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য) রোকসানা কাদের বলেন, সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেই খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। কিছু বিষয় খসড়ায় অনুপস্থিত থাকতে পারে, সেগুলো পরে সংযুক্ত করা হবে।
সূত্র মতে, ২০১৫’র জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন’ শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স সামিটের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তামাককে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, তামাকবিরোধীদের নিয়মিত আন্দোলন ও দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার বিগত ২০১৪-১৫ বাজেটে তামাকপণ্যে ১ শতাংশ হারে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করে। যা সুষ্ঠুভাবে আদায়ের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে ‘স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আদায় বিধিমালা ২০১৪’ ও পরবর্তীতে ২০১৭ সালে ‘উন্নয়ন সারচার্জ ও লেভী (আরোপ ও আদায়) আইন ২০১৫’ এর ধারা ৬ এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ (আদায় ও পরিশোধ) বিধিমালা ২০১৭’ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। যা ১ জুলাই ২০১৭ তারিখ থেকে কার্যকর রয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী আমদানিকৃত তামাকজাত পণ্যের ক্ষেত্রে, যে মূল্যের ভিত্তিতে মূল্য সংযোজন কর নিরূপণ করা হয়, সেই মূল্যের উপর সারচার্জ প্রদান করতে হবে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তামাকজাত পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উৎপাদন স্তরে মূল্য সংযোজন কর আরোপযোগ্য মূল্যের উপর সারচার্জ প্রদেয় হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন