শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

শিশু মৃত্যুতে শীর্ষে নেত্রকোনা

হাসান সোহেল, নেত্রকোনা থেকে ফিরে | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অপুষ্টি, বাল্যবিবাহ ও অসচেতনতা দায়ী
শাহিনা আক্তার (২৫)। নেত্রকোনা সদর থানার বাসিন্দা। জ্বর-সর্দিতে ভোগা ইমু আক্তার (১১মাস) শিশুর চিকিৎসা সেবা নিতে সদর হাসপাতালে আসা শাহিনা জানান, তার মেয়ে গত তিনদিন ধরে জ্বর-সর্দিতে ভুগছে। তিনি ১৩ বছর বয়সে প্রথম সন্তান জš§ দেন। বর্তমানে তিন সন্তানের মা। তার স্বামী একজন রিকশাচালক।
স্বামী-স্ত্রী কেউই তেমন লেখাপড়া করেননি। নেত্রকোনা সদরের বোনোপাড়া থেকে শিশু রাফসান (৩ মাস) নিয়ে আসা শিউলী বেগম (২৩) জানালেন- তার সন্তানের ওজন বাড়ছে না। দিনকে দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই হাসপাতালের এসেছেন পরামর্শের জন্য। শিউলীও তিন সন্তানের মা। ইউনিসেফ ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে পুষ্টিগুণের তালিকায় সবচেয়ে নিচে অবস্থান নেত্রকোনা জেলার। আর অপুষ্টি শীর্ষে থাকা এ জেলাতে নবজাতক ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হারও বেশি।
নবজাতক মৃতের হার হাজারে ৯৪ এবং এক হাজার ৪৩৯ জন এক বছর বয়সী শিশুর মৃত্যু হয়। সরকারের নানা পদক্ষেপে সারাদেশে নবজাতক ও শিশু মৃত্যুর হার কমলেও নেত্রকোনায় এখনো এটি একটি বড় সমস্যা। যা জাতিসংঘ ঘোষিত ‘এসডিজি’ (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল- টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য) অর্জনে সরকারের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। যদিও বিবিএস’র (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাতৃমৃত্যুর পাশাপাশি কমেছে শিশুমৃত্যুর হারও। ২০১১ সালে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ৩৫, গত বছরে তা ছিল ২৯। মাতৃমৃত্যুর হারও গত পাঁচ বছরে একই হারে কমে এসেছে। ২০১১ সালে প্রতি হাজারে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ২ দশমিক ৫৯, যা ২০১৫ সালে নেমে এসেছে ১ দশমিক ৮১তে।
নেত্রকোনার চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অপুষ্টি ও নবজাতক মৃত্যুর প্রধান কারণ বাল্য বিবাহ। পাশাপাশি অসচেতনতা। তাদের মতে, অবহেলিত এ জেলায় সরকারের পৃথকভাবে নজড় দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে এখানকার মূল সমস্যা গর্ভবতী মায়ের অপুষ্টি। পাশাপাশি গর্ভকালীন মায়ের সঠিক যত্মের অভাবে জন্ম নেয়া শিশুর সঠিক বিকাশ না হওয়া। যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। আর হুমকিতে পড়ছে আগামী প্রজন্ম।
নেত্রকোনার সিভিল সার্জন ডা. তাজুল ইসলাম খান জানান, নেত্রকোনার মা ও শিশুরা একধরনের দুষ্ট চক্রে আবদ্ধ। এই চক্রে আছে অশিক্ষা, দারিদ্রতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার দৈণ্যদশা এবং অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা। তবে কিছুদিন থেকে এখানে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ইউনিসেফের অর্থায়নে শূণ্য থেকে ২৮ দিনের নবজাতক মৃত্যু রোধে স্ক্যানো নামে একটি পাইলট প্রকল্প চালু রয়েছে ২০১৪ সাল থেকে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জন্মের পর ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়। একই সঙ্গে গর্ভকালীণ বিভিন্ন পরামর্শ এবং মা’সমাবেশসহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমে এখানকার মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবায় কিছুটা উন্নতি এসেছে। ইউনিসেফের এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে তাই কিছুটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট ও অন্যান্য জনবল ও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে হয়তো এ সমস্যা বেশিদিন থাকবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যানসেট-এর তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে প্রতি মিনিটে জন্ম নিচ্ছে চারটি শিশু। এই হিসেবে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ৪৭৯ জন এবং প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে। তবে সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেক গর্ভবতী মা অপুষ্টিতে ভোগেন। যে কারনে, প্রায় ৮৩ হাজার নবজাতকই জন্ম নেয় মৃত অবস্থায়।
শাহিনার সন্তানকে দেখে হাসপাতালের শিশু রোগ বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. নজরুল ইসলাম ফকির জানান, হাসপাতালে আসা বেশিরভাগ শিশুই ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত। একই সঙ্গে শিউলীর সন্তানকে দেখে জানান, অপুষ্টিতে আক্রান্ত। ডা. নজরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় শিশুদের মধ্যে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এমনকি নানাবিধ বিরল রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, শিশু স্বাস্থ্যে নেত্রকোনা একটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত জš§ নেওয়া এক হাজার ৬৬৪ শিশুর মধ্যে ৫০০ শিশুই কম ওজনের। অর্থাৎ আড়াই কেজির নিচে। কম ওজনের শিশুরাই অপুষ্টিতে ভোগে, দুর্বল থাকে ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত হয়। এর আরেকটি কারণ- ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের গর্ভ ধারণ। যা মাতৃ স্বাস্থ্যেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
অবশ্য ডা. নজরুল ইসলাম ফকিরের বক্তব্যের সঙ্গে সরকারের স্থানীয় স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০১৬ এর তথ্যেও মিল রয়েছে। এ বুলেটিন থেকে জানা গেছে, নেত্রকোনা জেলার পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অসুস্থতার প্রধান কারণ অপুষ্টি। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০১৫ সালে এক হাজার ৭২২ জন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু হয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত জš§ নেওয়া ৬১ হাজার ৫৮৯ শিশুর মধ্যে ৫৬ হাজার ৯৬১ শিশুর জš§ হয় স্বাভাবিকভাবে। আর সিজার করে জš§ নেয় তিন হাজার ২১০ শিশু। এর মধ্যে এক হাজার ১৪৩ মৃত শিশুর জš§ হয়।
শাহিনা ও শিউলীর মতো ৪৯ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগে গর্ভবতী হয় বলে জানিয়েছেন নেত্রকোণা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মো. আজম। তিনি বলেন, সারাদেশে ১৮ বছরের আগে বিয়ের হার ৬৯ শতাংশ। এর ১৫ শতাংশই অবস্থিত শুধুমাত্র নেত্রকোনাতে।
ইউনিসেস’র নেত্রকোনা জেলা পুষ্টি কর্মকর্তা শাহজাহান কবির জানান, অপুষ্টিতে শীর্ষে রয়েছে নেত্রকোণা। দেশের জেলাগুলোর পুষ্টির র‌্যাংকিং এ দেখা গেছে- সেখানে নেত্রকোনার অবস্থান ৬৪-তে। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে সবচেয়ে বেশি শিশু মৃত্যুর হার নেত্রকোণাতে। আর তাই নেত্রকোনা জেলা হাসপাতালে ইউনিসেফের সহায়তায় শূণ্য থেকে ২৮ দিনের শিশুদের যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য ২০ শয্যা বিশিষ্ট ‘দ্য স্পেশাল নিউবোর্ন ইউনিট (এসসিএএনইউ) চালু করা হয়। ইউনিটটি ২০ শয্যার হলেও এখানে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০জন নবজাতক চিকিৎসা নেয়। এছাড়া নেত্রকোনা সদরের নয়টি উপজেলায় ৬-৫৯ মাস বয়সী শিশুদের জন্য পুষ্টি খাবার, সম্পূরক খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতি মাসে মায়েদের নিয়ে গর্ভধারণ, শিশুর যতœ ও পুষ্টি নিয়ে পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) এবং মুগদা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, এসডিজি নিয়ে বাংলাদেশের টার্গেট প্ল্যান রয়েছে। একই সঙ্গে পিছিয়ে পড়া এলাকাকে পৃথকভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এমডিজি (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল- সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য) অর্জনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে এবং সেভাবে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন ডা. সামিউল ইসলাম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন