মিজানুর রহমান তোতা : সবজির মতো ফুল উৎপাদনেও যশোর শীর্ষে। আশংকা ছিল বর্ষায় ফুল উৎপাদন হবে ক্ষতিগ্রস্ত। ঘটবে বিরাট বিপর্যয়। ক্ষতি কিছুটা হয়েছে। বাস্তবে বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে কৃষির এই সেক্টরটি। ফুল চাষ হয় আপল্যান্ডে। যার কারণে ফুলের জমি তলায়নি। ফুলের কড়ি ও পাপড়িতে বৃষ্টির পানি ঢুকে কিছু ফুল নষ্ট হয়েছে। এর বাইরে কোন ক্ষতি হয়নি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর উপ পরিচালক ড. সুনীল কুমার রায় জানান, বৃষ্টিতে ফুল চাষ ও উৎপাদন ক্ষতি হয়নি। উপরন্তু বর্ষা আগাম ফুল চাষে সহায়ক হয়েছে। ফুল চাষের পিক সিজন অক্টোবর। এবার বর্ষার পরই অফসিজনেও ব্যাপকভাবে চাষ শুরু হয়েছে। তবে সাধারণত সব জাতের ফুলই কমবেশী বারোমাস চাষ ও উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, বর্ষার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে ফুলচাষিরা নতুন উদ্যোমে মাঠে নেমে আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন। ফুল চাষ ও উৎপাদনে ঘটছে বিপ্লব। যদিও এই বিপ্লব নতুন নয়। সারাদেশের মধ্যে যশোর রজনীগন্ধা, গাঁদা, লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, গøাডিওলাস, জারবেরা, লিলিয়ামসহ নানাজাতের ফুল উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে বহুদিন। দেশের মোট চাহিদার সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ ফুল সরবরাহ হয় যশোর থেকে। শুধু সৌন্দর্য কিংবা মিষ্টি সুবাতাস ছড়ানো নয়, এখন ফুল থেকে আসছে কাড়ি কাড়ি বৈদেশিক মুদ্রা। যা কিছুদিন আগে কল্পনাও করা যায়নি।
অপূর্ব সৌন্দর্য্য ও রঙীন ইতিহাস সৃষ্টিকারী ফুলরাজ্য যশোরের গদখালিতে সরেজমিন দেখা গেছে, বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। যশোর-বেনাপোল আন্তর্জাতিক সড়কের গা ঘেষে ঝিকরগাছা উপজেলাধীন গদখালী। গদখালী বাজার পয়েন্ট থেকে সোজা দক্ষিণে পটুয়াপাড়া, হাড়িয়া, নীলকন্ঠনগর, পানিসারা, কাউরা, নারাঙ্গালী, কৃঞ্চচন্দ্রপুর, কুলিয়া. চাদপুর, কানাইরালি, আশশিংড়ীসহ গ্রামের পর গ্রামের মাঠে মাঠে শুধু ফুল আর ফুল চাষ হচ্ছে। সবুজের মাঝে সাদা রজনীগন্ধা আর লাল গোলাপ, হলুদ গাঁদার চাদর পাতা মনমাতানো এক অভ‚তপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্য। যা দেখলে পাষাণ হৃদয়ও নরম হয়ে যায়। বিস্তীর্ণ এলাকার মাঠে মাঠে লাল, হলুদ, খয়েরী ও হলুদসহ রং বেরং এর বাহার। যতদুর চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি হারুণ অর রশীদের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন বর্ষাবাদলে ভেবেছিলাম এবার আমাদের সর্বনাশ ঘটবে। আল্লাহ রক্ষা করেছেন। খুব একটা ক্ষতি হয়নি ফুলের। বরং সেচের হাত থেকে বাচা গেছে। মাটি রসালো হয়েছে। সুবিধা হয়েছে চাষের। বর্তমানে আবহাওয়া অনুক‚লে। উৎপাদনও হচ্ছে ভালো। তিনি বললেন, রজনীগন্ধা ও গøাডিওলাস একবিঘায় একবার লাখখানেক টাকা খরচ করে ৩বছর ধরে ফুল পাওয়া যায়। বিক্রি হয় ৪ লক্ষাধিক টাকা।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি, গদখালী ফুল চাষী কল্যাণ সমিতি, ফুল ব্যবসায়ী সমিতি ও ফুল চাষিসহ সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠের অবস্থা খুবই ভালো। এখন দরকার দীর্ঘদিনের দাবি ফুল নীতিমালা করা। দরকার বিরাট সম্ভাবনাময় খাতটির প্রধান সমস্যা রফতানীর প্রতিবন্ধকতা দূর করা। ফুল রফতানীর ক্ষেত্রে সরকারী নীতিমালার অভাবে বিদেশে যাচ্ছে ফুল হিসেবে নয়, সবজি হিসেবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ফুলের ব্যাপক কদর ও চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সুযোগকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। ফুল চাষ, পরিচর্যা, ফুল তোলা, বান্ডিল করা, সংরক্ষণ, পরিবহন, ক্রয় ও বিক্রয় কাজে বহু লোক নিয়োজিত। ফুলের মান বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, চাষীপর্যায়ে আধুনিক পদ্ধতি ও কলাকৌশলের জ্ঞানের অভাব এবং সুষ্ঠু বাজারজাতকরণে বহুমুখী সমস্যার কারণে সম্ভাবনার খাতটির আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, আশার কথা ঢাকায় ফুলের একটি স্থায়ী পাইকারী মার্কেট স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশে রফতানী বৃদ্ধির ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে। সংরক্ষণের অভাবে পিকসিজনে অনেক সময় ফুল নষ্ট হয়। সেজন্য গদখালির পানিসারায় এক একর জমির উপর বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন হতে যাচ্ছে। যেখানে ফুল গ্রেডিং ও প্যাকেজিংএর ব্যবস্থা থাকবে। গদখালিতে একটি ফুল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনেরও প্রক্রিয়া চলছে। বর্তমানে প্রতিবছর গড়ে প্রায় আড়াইশো’ কোটি টাকার ফুল রফতানী হচ্ছে। এই অংক অনায়াসেই হাজার কোটিতে উন্নীত করা সম্ভব। বর্তমানে সবচেয়ে ফুলে বাজার নষ্ট করছে প্লাষ্টিকের ফুল। চীন ও থাইল্যান্ড থেকে প্লাষ্টিক ফুল ব্যাপকভাবে আমদানী হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে গদখালীতে আমরা মানববন্ধন ও সমাবেশ করবো ১১ সেপ্টেম্বর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের মোট ২৫ জেলায় ৬হাজার হেক্টরে ফুল চাষ হয়। প্রায় ২০হাজার চাষি ফুল চাষ করেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফুল শিল্পটির সঙ্গে ৩০লাখ লোক জড়িত। বর্ষায় যশোরে ক্ষতি হয়নি। তবে সাভার ও মানিকগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকায় কমবেশী ক্ষতি হয়েছে। যদিও ফুলের মূল চাষ হয় যশোর অঞ্চলে। এখানকার গদখালি এলাকা বিস্তীর্ণ মাঠে বারোমাস শুধু ফুল উৎপাদন হয়। নিকট অতীতে এতো ব্যাপক আকারে বানিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হতো না। সুত্র জানায়, জাপান ও হল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে ফুল উৎপাদন বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বাংলাদেশে সেটি অনায়াসেই করা যায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার মাটি রকমারী ফুল উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। ফুলের গঠন ও রং ভালো হয়। সুত্র জানায়, বাংলাদেশে ফুলের উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে বাজারও। অক্টোবর-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী-মার্চ পর্যন্ত ফুলের পিক সিজন। তবে সারা বছরই আমাদের দেশে ফুল উৎপাদন হয় কমবেশী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন