বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

স্বঘোষিত ‘কর্মবীর’-নির্ভর প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার অপচয়ের শঙ্কা

শফিউল আলম ও রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রধান সমুদ্রবন্দর ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারক বন্দরনগরী চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির হৃদপিন্ড। চট্টগ্রামকে বলা হয় দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। প্রাচ্যের রাণী। কিন্তু চট্টগ্রামের আজ বেহালদশা। বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতা। আর সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে বছরের প্রায় অর্ধেক সময় ভাসছে চট্টগ্রাম নগরীর ব্যাপক এলাকা। দুর্বিষহ জীবনযাত্রা। ভাদ্রশেষের মাঝারি বৃষ্টি আর জোয়ারে গতকালও (শনিবার) প্লাবিত হয় আগ্রাবাদ বাকলিয়াসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা। ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’ চাক্তাই খালসহ সবক’টি খাল ছরা নালা-নর্দমা ভরাট ও বেদখল হয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ। সড়ক রাস্তাঘাট অধিকাংশই ভাঙাচোরা, ফাটল ও খানাখন্দে ভরা। সড়কগুলোর পরিকল্পিত স¤প্রসারণ নেই। অথচ যেনতেন প্রকারে ফ্লাইওভারের নামে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান স্বঘোষিত ‘কর্মবীর’ আবদুচ ছালামের ইচ্ছেমাফিক উন্নয়ন নামের জঞ্জালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মহানগরীর অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমন- ‘সর্বাঙ্গে ব্যাথা ওষুধ দিব কোথা’। নগরবাসী নাগরিক সমস্যা-সঙ্কটের সমাধান চান স্বভাবতই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়রের কাছেই। এরপর আছেন চসিক কাউন্সিলরগণও। বিশেষ করে অসহনীয় পানিবদ্ধতা, রাস্তাঘাটের চরম দুর্দশা, যানজট, বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবসহ নিত্যদিনের নাগরিক দুর্ভোগের জন্য চাটগাঁ নগরবাসী দুষছেন সিটি মেয়রকেই। অপরদিকে মন্ত্রী-এমপি-নেতারা বলছেন, বন্দরনগরী বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের উন্নয়ন এবং নাগরিক সমস্যা-সঙ্কট নিরসনের জন্য সরকার সচেষ্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ আগস্ট একনেক কর্তৃক সরকারি অর্থায়নে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার একটি মেগাপ্রকল্প অনুমোদন লাভ করেছে। ‘চট্টগ্রাম শহরের পানিবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণকল্পে খাল পুনঃখনন, স¤প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে এটি এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প এবং নিঃসন্দেহে সরকারের একটি বড় ধরনের উদ্যোগ।
অন্যদিকে সাধারণ সচেতন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নাগরিকমহল, পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মাঝে এই মেগাপ্রকল্পটিকে ঘিরে নানামুখী প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে। এর মূল দিক হচ্ছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তথা মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের পরিবর্তে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামকে দায়িত্ব দিয়ে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার একটি ঢাউস সাইজের প্রকল্প-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপটি যথার্থ এবং যৌক্তিক হলো কিনা। তার যথেচ্ছ ‘উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে’র খেসারত দিতে গিয়ে জনদুর্ভোগের যেখানে শেষ নেই সেখানে পানিবদ্ধতা দূরীভূত করবেন ছালাম? চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত বেশ কিছুদিন ধরেই সাধারণ সচেতন লোকজন অনেককেই এখানে-সেখানে আলাপচারিতায় বলতে শোনা যায়- টাকা পায় ছালাম, আর গালি খায় নাছির। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কথায়ও সেই একই সুর বেজে উঠছে। তারা বলছেন, এক যাত্রায় দুই ফল হলো কেন কীভাবে? সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে পানিবদ্ধতা নিরসনের মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ও সমস্যা মেটানোর জন্য সরকার বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আন্তরিক উদ্যোগটি নিয়েছেন সেটি ছালাম-নির্ভরতার কারণে শুভ প্রয়াস ও সদিচ্ছারই অপচয় ঘটবে তারা এমনটি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইইবি) চট্টগ্রামের সাবেক নেতা প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার অভিমত ব্যক্ত করেছেন, এককভাবে সিডিএ চেয়ারম্যান ছালামকে ছেড়ে দেয়ার ফলে প্রধানমন্ত্রীর একটি ঐকান্তিক সদিচ্ছার অপচয় ঘটতে পারে।
নির্মম পরিহাসের বিষয়টি হলো, চসিক মেয়র আ জ ম নাছির পানিবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ইতোপূর্বে একই ধরনের প্রকল্প-প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিলেন। আগামী একশ’ বছর বিবেচনায় নিয়ে ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ মাস ধরে নগরীতে সমীক্ষা চালিয়ে এ প্রকল্প প্রস্তাবটি তৈরি করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। প্রস্তাাবনায় বলা হয়, ৫ হাজার কোটি টাকায় ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিবদ্ধতা ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পানিবদ্ধতামুক্ত হবে চট্টগ্রাম মহানগরী। এমনটি আশ্বাস ছিল মেয়রের নগরবাসীর প্রতিও। ‘পাওয়ার চায়না’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নেরও প্রস্তাাব ছিল। অথচ সেটি নাকচ হয়ে গেল। আর অপ্রত্যাশিতভাবেই সিডিএ চেয়ারম্যান ছালামের প্রস্তাাব অনায়াসে অনুমোদন পেলে। আরও পরিহাস হচ্ছে, এরআগে পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো) ২ হাজার ৭শ’ কোটি টাকার সংশোধিত একটি প্রকল্প প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠায়। সেটিও আমলে নেয়া হয়নি। গত ৭ সেপ্টেম্বর ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ চট্টগ্রাম চাপ্টারের নেতাদের সাথে বৈঠকে সিডিএ ‘কর্মবীর’ ছালাম পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পটি তিনি কিভাবে অনুমোদন পেলেন সেই প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিশাল বাজেটের প্রকল্প অনুমোদন নেয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের মেয়র মহোদয়ের দোষ নেই। উনি প্রকল্পটি নেয়ার ক্ষেত্রে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন’। একজন সাবেক মেয়র এসব মন্তব্যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেয়র আ জ ম নাছিরের প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল।
উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সমীক্ষা ছাড়াই চট্টগ্রাম শহরের পানিবদ্ধতা নিরসনে একনেকে অনুমোদন পাওয়া স্বঘোষিত ‘কর্মবীর’ ছালাম-নির্ভর প্রকল্পটি আদৌ কোন সুফল বয়ে আনবে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। এটি বাস্তবায়নে হাত দেয়ার আগে আরও অনেক বিষয় যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা অতীতে চট্টগ্রামে বিভিন্ন প্রকল্প জনগণের জন্য সুফল আনেনি শুধুই যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে। যেমন- বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারটি নির্মিত হয়েছে কোনো রকমের ফিজিবল স্টাডি ছাড়াই। আর মুরাদপুর-লালখান বাজার ফ্লাইওভারটির ফিজিবল স্টাডি করা হয় নির্মাণ কাজ শুরু করার অনেক পর। এরফলে এখন দেখা যাচ্ছে, বহদ্দারহাট ও কদমতলী ফ্লাইওভারে যানবাহন চলে না। অথচ নিচে যানজট। তাছাড়া পানিবদ্ধতা নিরসনের নামেও গত ২০ বছরে অপরিকল্পিত হরেক ধরনের কাজ হয়েছে। ২০০৩ সালে ৩২৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরআগেও মহানগরীকে পানিবদ্ধতামুক্ত করার নামে হয়েছে হরেক প্রকল্পের বাণিজ্য আর হরিলুট। সমস্যা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বৃষ্টি ও জোয়ারে নগরীর বিশাল এলাকাজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনযাত্রা থমকে যাচ্ছে। শত শত কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রতিবছর। এবার সিটি কর্পোরেশনকে পাশ কাটিয়ে ‘কর্মবীর’ ছালামকে দিয়ে পানিবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের বদলে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে কিনা তা নিয়েই চিন্তিত চট্টগ্রাম নগরবাসী।
এদিকে সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামকে চট্টগ্রাম মহানগরী পানিবদ্ধতামুক্ত করার জন্য সরকারের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি মেগাপ্রকল্প প্রদান প্রসঙ্গে সাবেক সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, ছালামের অপরিকল্পিত কর্মকান্ডে মানুষের কষ্ট আর দুর্ভোগের সীমা নেই। নগরবাসীর কাছে তার কোন জবাবদিহিতা নেই। এ কারণে যা খুশী তা করছে। চট্টগ্রামের উন্নয়নে সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও ছালাম অথর্ব, ব্যর্থ। নিজেকে তিনি বড় আমলা ভাবেন। তাকে পানিবদ্ধতা দূরীকরণের দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি নতুন করে আরও সমস্যা আর সঙ্কট তৈরি করবেন। তাছাড়া পানিবদ্ধতা নিরসন সম্পর্কে সিডিএ’র ছালামের কোন কারিগরি প্রাক-সমীক্ষাও নেই। সরকার সরাসরি দায়িত্ব নিয়ে যদি মেগাপ্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে তাহলেই মঙ্গলজনক হবে।
সাবেক চসিক মেয়র ও সাবেক এমপি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ইনকিলাবকে এ প্রসঙ্গে বলেন, এ প্রকল্পটি যথানিয়মে অবশ্যই সিটি মেয়রের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা উচিৎ। কেননা মেয়র একজন জনপ্রতিনিধি। জনগণের কাছে তার জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু সিডিএ চেয়ারম্যান ছালামের তো জনগণের কাছে কোন জবাবদিহিতা নেই। তাছাড়া সিডিএ’র অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুফল চট্টগ্রামবাসী পাচ্ছে না। বরং নানামুখী সমস্যা তৈরি হয়েছে। বার বার সরকারের বরাদ্দ লাভ করা ছাড়া ছালাম সিডিএ’কে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করতে আদৌ কী চেষ্টা করেছেন জানতে চান তিনি।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান ইনকিলাবকে জানান, বন্দরনগরীতে পানিবদ্ধতা সমস্যা দীর্ঘদিনের এবং তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন যে মেগাপ্রকল্পটি সরকার অনুমোদন দিয়েছে সেটি সিটি কর্পোরেশনের তথা মেয়রেরই যৌক্তিকভাবে প্রাপ্য ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। তাছাড়া যতদূর আমরা জানি, এত বিশাল প্রকল্প সিডিএকে দেয়া হলো অথচ এরজন্য যথারীতি প্রাক-সমীক্ষা, ডিজাইনসহ পরিকল্পনা নেই (সিডিএ’র)। এখন সিটি মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে মেগাপ্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন