‘বিশ্ব পর্যটন দিবস’ আজ। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য হল ‘টেকসই পর্যটন- উন্নয়নের চাবিকাঠি’। এ দিবসটিকে ঘিরে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনসহ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অভিজাত হোটেল-মোটেলের উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে চট্টগ্রাম অঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। পর্যটকদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা। এদিকে পাহাড়, নদী ও প্রকৃতির ছায়াসুনিবিড় চট্টগ্রাম অঞ্চলের পুরোটাই যেনো পর্যটনের বিশাল ক্ষেত্র। দেশের পর্যটন শিল্পের অফুরন্ত সম্ভারের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রাণী চট্টগ্রাম। দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের সবকিছুই আছে এখানে। এসব পর্যটন কেন্দ্রের পরিকল্পিত উন্নয়ন হলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি চট্টগ্রামে পর্যটকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের কুটির শিল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিমান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বন্দর, পানি শোধনাগার ইত্যাদি উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়। তাছাড়া পর্যটন শিল্পের মান সমুন্নত রাখতে হলে দেশের ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ স্থান, পুরাকীর্তিসমূহ, জাতিতাত্তি¡ক সংস্কৃতি রক্ষণাবেক্ষণে তৎপর থাকতে হয় বলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ সুরক্ষিত থাকে।
পর্যটন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, পর্যটন প্রকৃতির দান। অন্য দেশে পাথরের পাহাড়। আমাদের দেশে উর্বর মাটির পাহাড়। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের পর্যটন স্পটগুলোর যথাযথ উন্নয়ন হলে পর্যটকের সংখ্যা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। এখানকার দর্শনার্থীদের কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সুন্দরবনে যেতে হবে না। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ইকোপার্ক, পতেঙ্গা সী-বিচ, পারকি, ওয়্যার সেমিট্রি, বায়েজিদ বোস্তামী মাজার, শাহ আমানত মাজার, মোহছেন আউলিয়া মাজার, ভেলুয়ার দীঘি, ফৌজদারহাট সী-বিচ, ফয়’স লেক, ইউএসটিসি, সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় ইত্যাদি।
অন্যদিকে যেখানে থাইল্যান্ড, নেপাল, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর শুধু পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, সেখানে আমাদের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয়। বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন এলাকার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলা অন্যতম। এছাড়া কুয়াকাটা, সুন্দরবন, ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, নাটোর, পাহাড়পুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, দ্বীপ জেলা ভোলা পর্যটনের বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের রয়েছে বিপুল সুনাম। চট্টগ্রামের বিনোদন স্পটগুলোর মধ্যে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, কাপ্তাই লেক, চট্টগ্রাম শিশু পার্ক ও কর্ণফুলী শিশু পার্ক, ফয়’স লেক, জাতিতাত্তি¡ক যাদুঘর, সীতাকুন্ড ইকোপার্ক, জিয়া যাদুঘর, নৌবাহিনী যাদুঘর, সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়, ওয়্যার সেমিট্রি, ডিসি হিল ও লালদীঘির পার্ক, পারকি বিচ, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, রাঙ্গামাটি, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বান্দরবান, মহেশখালীর পার্ক। এসব পর্যটন স্পটের বাইরেও বর্তমানে নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে হিলটপ পার্ক।
রাঙ্গামাটি ঃ পাহাড় লেকে ঘেরা রাঙ্গামাটিতে রয়েছে দর্শনীয় অনেক স্থান। সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢল ও পাহাড় ধসে পর্যটন এলাকাগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হলেও তা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চলছে। পর্যটকরা রাঙ্গামাটিমুখী হচ্ছে না। রাঙ্গামাটির লেকে পর্যটকদের জন্য রয়েছে স্পিডবোট এবং ইলিশ বোট। পাহাড়ঘেরা সুন্দর চাকমা বাড়িটি রাঙ্গামাটির হ্রদের সৌন্দর্যের একটি। প্রতিবছর রাঙ্গামাটি আদিবাসীদের ঐতিহ্য রাজ্যপুনাহ মেলা এ জনগোষ্ঠীর প্রধান মেলা।
কক্সবাজার ঃ বাংলাদেশের বৃহত্তর সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে যার অবস্থান। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত (১২০ কিলো) বঙ্গোপসাগরের অতল জলরাশির সাথে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে বিশাল বর্ণময় বালুতটের। এ সৌন্দর্য প্রাকৃতিক পরিবেশে পাহাড় ঝর্ণা, হিমছড়ি ইনানীর সুবিশাল পাথর ও বালু সম্মিলন পর্যটকদের আকর্ষণ করে বেশি।
পতেঙ্গা ঃ চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত সৌন্দর্যে ঘেরা এ সৈকত বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন এ সৈকতকে ঘিরে মানুষের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়।
ওয়্যার সেমিট্রি ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিকে স্মরণে রাখার মানসে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম ওয়্যার সেমিট্রি। ৭৫৫ জন সৈনিকের সমাধির সার্বিক তত্ত¡াবধানে আছেন কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেইভস কমিশন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ ওয়্যার সেমিট্রি। চট্টগ্রাম নগরীর আর্ট কলেজের পাশেই গড়ে উঠেছে নিরব প্রকৃতি ঘেরা এ স্মৃতিসৌধ। কুমিল্লার ময়নামতিতে এ ধরনের আরও একটি ওয়্যার সেমিট্রি রয়েছে।
জাতিতাত্তি¡ক যাদুঘর ঃ এশিয়া মহাদেশের মধ্যে জাতিতত্তে¡র বিষয় কেন্দ্রিক যে কটি যাদুঘর রয়েছে তন্মধ্যে চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত জাতিতাত্তি¡ক যাদুঘরটি সামগ্রিকভাবেই উল্লেখযোগ্য। যাদুঘরের প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে দেশ-বিদেশের একটি জাতি (বাংলাদেশী), বারোটি জনগোষ্ঠী এবং ছাব্বিশটি মৌলগোষ্ঠী ও আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবন বৈশিষ্ট্য।
জিয়া যাদুঘর ঃ চট্টগ্রামের জিয়া যাদুঘরটি বৃটিশ শাসন আমলে কুঠিরবাড়ি হিসাবে পরিচিত ছিলো। এ যাদুঘরটিতে মোট ১২টি গ্যালারি উপস্থাপনের মাধ্যমে ৭৪৩টি নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী চেতনাকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে এ সকল গ্যালারি স্থাপন করা হয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সংগ্রামী জীবন এবং কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে যাদুঘরের প্রদর্শনীর মাধ্যমে।
ডিসি হিল ঃ চট্টগ্রামের আরেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হলো ডিসি হিল পার্ক। বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে এখানে মেলা বসে। এছাড়া ডিসি হিলে স্থায়ীভাবে একটি উন্মুক্ত মঞ্চও রয়েছে। মঞ্চের সামনে বিশাল দর্শক গ্যালারি। পাহাড়ের উঁচুনীচু ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে ডিসি হিল পার্কে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন। আকর্ষণীয় প্রকৃতির শোভাবর্ধিত চট্টগ্রাম হলেও এ শহরের পর্যটনের জন্য আশানুরূপ বিকাশ লাভ করেনি।
ফয়’স লেক ও চিড়িয়াখানা ঃ চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত পাহাড়ের পাদদেশে লেক সমৃদ্ধ এ বিনোদন কেন্দ্র ফয়’স লেক। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা এ লেক দর্শনার্থীদের কিছুটা হলেও বিনোদন চাহিদা পূরণ করছে। ফয়’স লেকের সামনেই গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা।
সীতাকুন্ড ইকোপার্ক ঃ চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ মন্দির ও ইকোপার্ক। পাহাড় ও অরণ্য ঘেরা এ অঞ্চল পাহাড়ের পাদদেশ থেকে অনেক উপরে। বেশ উঁচুতে সিঁড়ি ভেঙে এ পাহাড়ে উঠা বেশ কষ্টসাধ্য হলেও এর সৌন্দর্য দেখে সবাইকে মুগ্ধ করতে পারে এর প্রকৃতি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন