বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

মহররম এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত সত্যের দিশারী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর কাছে যেমন প্রিয় তেমনি প্রিয় ছিলেন দৌহিত্র ইমাম হাসান (রাঃ) ও হোসাইন (রাঃ)। তবে কেন সর্বকালের সর্বাপেক্ষা করুণ ইতিহাস রচিত হল কারবালার প্রান্তরে? রসূল (সঃ) তাঁর প্রিয় দুই দৌহিত্রকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন, তার চিত্র ইসলামি ইতিহাসে সমৃদ্ধ। যারা মরু কারবালার প্রান্তরে আওলাদে রসুল (সঃ)-দের প্রতি অস্ত্র ধারণ করেছে মূলত তারাও ছিলেন রসুল (সঃ) এর অনুসারী, কিন্তু কেন এমন এক ঘটনা ঘটল। আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে ১০ মহররম তারিখে ইরাকের কারবালার প্রান্তর ফোরাত নদীর তীরে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে অনুশোচনার মাধ্যমে।
হজরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) মক্কা নগরের বিখ্যাত কোরাইশ বংশে চতুর্থ হিজরিতে মদিনায় জন্ম লাভ করেন। তার পিতার নাম শেরে খোদা হযরত আলি (রাঃ) । মায়ের নাম বিবি ফাতেমা, দাদার নাম আবু তালেব, নানা হলেন বিশ্ব নন্দিত হযরত মোহাম্মদ (সঃ)। তার বড় ভাই ইমাম হাসান (রাঃ), পিতা-মাতা ও নানা মহানবী (সাঃ)-এর আদর্শে আদর্শিত। রসুল (সাঃ) বলেন, আমার অর্ধাংশ জুড়ে আছে হাসান আর বাকি অর্ধাংশ জুড়ে আছে হোসাইন। রসুল (সঃ) আরো বলেন, হাসান ও হোসাইন সুগন্ধযুক্ত বেহেস্তের দুটো ফুল যারা তাদেরকে ভালোবাসবে আমিও তাদেরকে ভালোবাসব।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-র ইন্তেকালের পর হযরত আবুবকর (রাঃ), ওমর (রাঃ), ওসমান (রাঃ) ও আলি (রাঃ) ইসলামী বিশ্বের খলিফা নিযুক্ত হন। হযরত আলি (রাঃ) খেলাফতের আসনে থাকা অবস্থায় কুফার মসজিদে ফজরের নামাযের সুন্নাত নামাযরত অবস্থায় আবদুর রহমান নামক এক গুপ্তঘাতকের ছুরির আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন। পরে তার বড় ছেলে হযরত হাসান (রাঃ) মাত্র ৬ মাস খেলাফতের দায়িত্ব পালন করার পর কয়েকটি শর্তের বিনিময়ে হাসান (রাঃ) খেলাফতের দায়িত্ব মাবিয়া (রাঃ)-এর হাতে অর্পন করেন। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল মাবিয়া (রাঃ)-এর পর ইমাম হোসাইন (রাঃ) খলিফা নিযুক্ত হবেন। কিন্ত কয়েক মাস পর মাবিয়া (রাঃ) সুকৌশলে নিজ পুত্র এজিদকে খেলাফতের আসনে সমাসীন করেন যা কেউই মানতে রাজি ছিলেন না।
হজরত মাবিয়া (রাঃ) এর পর যখন এজিদ খেলাফতের আসনে সমাসীন হন তখন মক্কা, মদিনা ও কুফাবাসীরা বলল, আমরা এজিদকে খলিফা মানি না। আমাদের খলিফা হবে নবি বংশের শেষ প্রদীপ ইমাম হোসাইন (রাঃ)। তাই কুফাবাসীরা ইমাম হোসাইন (রাঃ) কে আমন্ত্রণ জানাতে থাকেন। ফলে ইমাম হোসাইন ৭২ জন সাথী নিয়ে কুফার পথে যাত্রা করেন। এজিদ এ খবর জানতে পেরে তার সেনাপতি ওবায়েদুল্লাহকে পাঠিয়ে পথে বাধা প্রদান করেন। ইমাম হোসাইন (রাঃ) উপায়ান্তর না পেয়ে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। ইমাম হোসাইন (রাঃ) কারবালার প্রান্তরে পৌছার আগেই এজিদ বাহিনী ফোরাত নদীর তীরে পাঁচশত সৈন্য দ্বারা পানি বেষ্টন করে রাখে যাতে ইমাম হোসাইন (রাঃ) ফোরাত নদী থেকে এক ফোঁটা পানিও নিতে না পারেন। পানির অভাবে ইমাম শিবিরে হাহাকার পড়ে যায়। ইমাম হোসাইন (রাঃ) আক্কাস (রাঃ)-র সাথে ৫০ জন সাথীকে ফোরাত নদী থেকে পানি আনার জন্য আদেশ দেন। আক্কাস (রাঃ) ২০ মশক পানি নিয়ে আসেন।
এদিকে কুফার গভর্নর সেনাপতি ওমরকে এই বলে চিঠি পাঠালেন যে, হে ওমর-তোমার প্রতি আমার আদেশ ছিল ইমাম হোসাইন (রাঃ)কে আমার দরবারে হাজির করবে। যদি তুমি এ কাজে অবাধ্য হও, তবে তোমার এ স্থান দখল করবে সীমার। এদিকে অর্থলোভী, কুচক্রী সীমার ২২ হাজার সৈন্যসহ মরু কারবালার প্রান্তরে হাজির হয়ে ইমাম হোসাইন (রাঃ) শিবিরের চারদিক ঘেরাও করে ফেলে যাতে কোন লোক ভিতরে প্রবেশ ও বাহির হতে না পারে। পরদিন ইমাম হোসাইন (রাঃ) বললেন, তোমরা কেউ ধৈর্যহারা হবে না। এরপর তিনি হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে বড় ভাই ইমাম হাসান (রাঃ) পর্যন্ত প্রাপ্ত খেলাফতের সব উপহার ও পোশাক অঙ্গে ধারণ করেন। পিতা হযরত আলি (রাঃ)-এর জুলফিকার তরবারি হাতে করে শিবিরের বাইরে আসেন। বাইরে ৭২ জন বীরযোদ্ধা সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষমাণ।
ইমাম হোসাইন (রাঃ) দুলদুল ঘোড়ায় চড়ে শত্রু সৈন্যদের কাছে গিয়ে বললেন, তোমরা শান্ত হও। বেশি তাড়াহুড়ো করবে না। এমন সময় ইমাম হোসাইনের অধিনায়ক ইবনে কাইয়েসনা শত্রæর নিকটবর্তী হয়ে কথা বলতে দেখে সীমার ইবনে কাইয়েসনাকে লক্ষ্য করে তির নিক্ষেপ করে যুদ্ধের সূচনা করে। এদিকে সেনাপতি ওমরকে কটুক্তি কয়ায় ওমর স্থির থাকতে পারলেন না, তিনি ইমাম বাহিনীর প্রতি তীর নিক্ষেপ শুরু করলেন। ইমাম বাহিনীর সৈন্যরা যখন তা প্রতিহত করতে লাগলেন তখন সীমার যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পলায়ন করে। যুদ্ধের রূপরেখায় এমন দেখা গেল যেন বিজয় মুসলমানদের হবে। কিন্তু শত্রæ বাহিনীর সবাই যখন অতর্কিতে হামলা শুরু করল, তলোয়ারের ঝনঝনানিতে কারবালার প্রান্তর প্রকম্পিত হল। জোহরের নামাযের সময় হলে ইমাম বাহিনী সালাতুল খওফ আদায় করলেন। দিনের প্রায় শেষ বেলায় মুসলিম সৈন্যরা বীর বিক্রমে লড়াই করে শাহাদত বরণ করেন। এখন ইমাম হোসাইন ছাড়া আর কেউ রইল না। এমন সময় ইমাম হোসাইন (রাঃ) সদ্যপ্রসূত শিশুটিকে কূলে নিয়ে তার কপালে চুমু খেলেন এবং তাঁর নাম রাখলেন আলি আসগর। ঠিক এমন সময় পাপিষ্ঠ শত্রæদল কচি শিশুকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করল। ইমাম হোসাইন (রাঃ) শিশুটিকে আড়াল করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার পূর্বেই বিষাক্ত তীরের আঘাতে কচি শিশুর দেহ পিঞ্জর হতে প্রাণখানি শূন্যে উড়ে যায়। মৃত শিশুটিকে তার মায়ের কোলে দিয়ে ইমাম হোসাইন দুলদুল ঘোড়ায় উঠে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন। পৃথিবী যেন নিস্তব্ধ নিস্তেজ। বাতাস যেন গতিহীন, সূর্য যেন নিষ্ঠুর সাক্ষী হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিক থেকে শত্রæ সৈন্য ইমাম হোসাইনকে (রাঃ) ঘিরে ফেলল। তিনি সিংহ বিক্রমে গর্জে উঠলেন, ইমাম হোসাইনের তরবারি কাউকেও দুইবার স্পর্শ করতে হয় না। তরবারির আঘাতে, অশ্বের পদাঘাতে শত্রæদেরকে কচুকাটা করে চলেছেন। ডানে, বামে, সারা মাঠে অগণিত সৈন্যের লাশ মাঠে গড়াগড়ি করতে লাগল। নিমেষে তিনি সব সৈন্যকে নির্মূল করে বিজয়ী বেশে ফোরাত নদীর দিকে চলছেন। ফোরাত কূলের সব সৈন্যদেরকে তছনছ করে দিলেন। ইমাম হোসাইন (রাঃ) ফোরাত নদীতে নামলেন। তিনি ছিলেন খুবই ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, ক্লান্ত। তিনি হাতের অঞ্জলিতে পানি নিয়ে মুখে চুমুক দিতে যাবেন, ঠিক এমন সময় মনে হল তার নবজাতক সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বীর মোজাহিদদের কথা। ঠিক সেই মুহূর্তে সীমারের ভক্ত অনুগত পাষাণ হোসাইন বিন নোমাইর দূর থেকে বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করল। এই তীর হোসাইন (রাঃ) কন্ঠনালী ভেদ করে অপর দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি হাতের পানি পান না করে ফেলে দিলেন। দুই হাতে কন্ঠনালীর রক্ত চাপা দিয়ে ধরলেন। এই রক্তমাখা হাত আকাশে উত্তোলন করে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমার যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। এবার হোসাইন (রাঃ) তীরে উঠে ঘোড়ায় না-চড়ে অত্যন্ত কাতর দেহে মাঠে প্রবেশ করতে লাগলেন। তার দেহের দুর্বলতা দেখে সীমার এসে সামনে দাঁড়াল। তিনি এক পা, দুই পা করে সামনে এগিয়ে চললেন। দেহের শক্তি নিস্তেজ হতে লাগল। সীমারের হুকুমে জোহরা তরবারি দ্বারা ইমাম হোসাইন (রাঃ)কে আঘাত করতে লাগল। আর সিনান বিন আলম নাখায়ি তরবারি হাতে ইমাম হোসাইনের বুকের ওপর চেপে বসল। আকাশ, বাতাস, পশু-পাখি, আল্লাহতা’লার সব সৃষ্টিরাজি চেয়ে দেখল কারবালা প্রন্তরের রক্তপিপাসু নরখাদকের দল তরবারির আঘাতে জান্নাতি যুবকদের সর্দার রসূল (সাঃ)-র পরম দৌহিত্র, মা ফাতেমা ও শেরে খোদা আলি (রাঃ), ইমাম হোসাইন (রাঃ)-র পবিত্র মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। সাথে সাথে আকাশ-বাতাস, কারবালার প্রান্তর, পাহাড়, পর্বত দিগি¦দিক হতে এক শব্দ উচ্চারিত হতে লাগল হায় হোসাইন! হায় হোসাইন! হায় হোসাইন!!!
শাহাদতে কারবালা এমন একটি মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা যার সামনে ১০ মহররম তথা আশুরার দিনে সংঘটিত সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা ¤øান হয়ে গিয়েছে। ১০ মহররম দুনিয়ার সৃষ্টি, আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আরো ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ইমাম হোসাইন ও নবী বংশের শাহাদাতের ঘটনার সামনে যেন ¤øান হয়ে গেছে। শাহাদাতে কারবালা যেভাবে সারা পৃথিবীকে নাড়া দিয়ে আলোড়িত আতঙ্কিত করে, তেমনি আর অন্য কোনো ঘটনা এমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি।
এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আশুরা তথা ১০ মহররম-এর পূর্বে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনার সাথে কারবালার ঘটনার একটি আশ্চর্য মিল রয়েছে। তা হল সত্যের বিজয়-মিথ্যার পরাজয়, সত্যের প্রতিষ্ঠা-মিথ্যার বিনাশ। সত্যের কাছে অসত্যের পরাজয়, মাঝখানে সত্যের জন্য করতে হল কঠোর পরিশ্রম। এ সত্য প্রতিষ্ঠায় যারা অংশগ্রহণ করেন তারাই হন বিশ্ববরেণ্য ও সর্বজননন্দিত। ইমাম হোসাইন কঠোর আত্মত্যাগের বিনিময়ে ইসলামকে চিরদিনের জন্য রক্ষা করেছিলেন। ইমাম হোসাইন (রাঃ) নিজের শির বিসর্জন দিলেন কিন্তু এজিদ ও জালেমের কাছে মাথা নত করলেন না। সেজন্যেই তিনি শিক্ষা দিয়ে গেলেন যে, ইসলাম রক্ষায় আত্মত্যাগ পবিত্র কর্তব্য।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন