বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কাঁচা মরিচের আর্তচিৎকার

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আমি মরিচ। না কারো পেট ভরে খাওয়ার ফল বা সবজি নই। মশলা প্রজাতি আমি মূলত মানুষের মুখে ঝাল স্বাদ দেই। তামাম দুনিয়ার রসনা বিলাসীরা তরি-তরকারি ও খাদ্যে জিহ্বার স্বাদ বৃদ্ধির জন্য আমাকে ব্যবহার করেন। অথচ কারো কাছে আমার ‘কদর’ নেই! খাদ্য রসিকদের আমার ছাড়া চলে না। বাংলাদেশে তো আমার ব্যবহার যাচ্ছেতাই। আমার কী কোনো সম্মানবোধ নেই? কৃষক শ্রমিক নিম্নআয়ের মানুষ আমাকে পিষে পান্তাভাতের সঙ্গে খায়; তরি-তরকারির ঝালস্বাদ বাড়াতে আমাকে ব্যবহার করে। শত রকমের ভর্তা আমার ব্যবহার ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। সমাজের উপর-নীচ সব শ্রেণীর মানুষ খাবার টেবিলে লবণের সঙ্গে আমাকে সাজিয়ে রাখে। ইচ্ছে হলে খায় না হলে উচ্ছিষ্টের সঙ্গে ফেলে দেয়। অথচ লবণ রেখে দেয়। আমার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমি কী এতোই ফেলনা? আমার কি আত্মসম্মানবোধ নেই? ওরা কি আমার রাজকীয় জন্ম বেড়ে ওঠার ইতিহাস জানেন? কলম্বাসকে ইতিহাসের বইয়ে জায়গা দেন; আমার কোনো মূল্যায়ন নেই! পৃথিবীর এতো ইতিহাস ইন্টারনেটে পড়েন অথচ আমার রাজকীয় ইতিহাস ঐতিহ্য কেউ পড়েন না? অবশ্য এতে আমার আফসোস নেই। মানুষের জিহŸার স্বাদ দিচ্ছি তাতেই খুশি। কিন্তু কিছু দালালচক্র ও সিন্ডিকেট আমাকে নিয়ে খেলছে; বাংলাদেশের সাধারণ ভোক্তাদের ‘পকেট’ কাটতে মরিচের মূল্য উর্ধ্বশ্বাসে উপরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কাঁচা মরিচের বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। সাধারণ ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে গেছে। আমার প্রতি অবহেলা আর এই অন্যায় বন্ধ হোক; নিম্নবৃত্ত-মধ্যবৃত্তের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের বাইরে যেতে চাই না। ওরা পান্তাভাতে আমাকে ডলে খাক; ঝাল স্বাদ নিক? ভর্তায় ইচ্ছেমতো ব্যবহার করুক!!
শুনুন আমার রাজসিক জন্মকথা। বাংলাদেশের মানুষ নাম দিয়েছে মরিচ! কেউ ডাকেন লংকা নামে আবার ইংরেজরা ডাকেন গ্রীন চিলি। স্থান ভেদে পিপার নামেও ডাকা হয়। সবজি ক্ষেতে জন্ম হলেও মসলা হিসাবে আমি রান্নায় ঝাল স্বাদের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছি। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ক্যাপসিকাম এর সোলানেসি পরিবারের উদ্ভিদে অন্তর্ভুক্ত করে আমাকে মরিচ বলা হয়ে থাকে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় আমার (মরিচ) আদি নিবাস সুদূর আমেরিকা মহাদেশে। এখনো সেখানে যেতে হলে বাংলাদেশের মানুষকে ভিসার জন্য মাসের পর মাস ঘাম ঝড়াতে হয়। প্রায় ৭ হাজার ৫শ’ বছর আগ থেকেই আমেরিকার আদিবাসীরা খাবারে আমাকে (মরিচ) ব্যবহার করে আসছে। ইকুয়েডরের দক্ষিণ পশ্চিমাংশে পুরাতাত্তি¡কেরা ৬ হাজার বছর আগে আমার (মরিচ) চাষাবাদের প্রমাণ পেয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকে আমেরিকায় মরিচের চাষ হলেও ইউরোপীয়দের মধ্যে ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে আমার (মরিচ) দেখা পান। ভারতবর্ষে উৎপন্ন গোল মরিচের মতো ঝাল বলে কলম্বাস আদর করে পিপার নাম দেন। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর আমি (মরিচ) সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ি। দিয়েগো আলভারেজ চানকা নামের একজন চিকিৎসক কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযানের সময় পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ হতে আমাকে (মরিচ) স্পেনে নিয়ে যান। তিনি ১৪৯৪ সালে আমার ঔষধি গুনাগুণ নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। আমি শুধু পৃথিবীর রসনা বিলাসীদের খাদ্যে স্বাদ বিলাই না; একই সঙ্গে মানব দেহের নানা রোগের মহৌষধও বটে। মরিচ মানবদেহের ওজন কমায়; দেহের তাপমাত্রা বাড়ায়; ক্যান্সার প্রতিরোধ করে; সর্দি-কাশি ও স্ট্রোক প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে; হৃদপিন্ড সুস্থ রাখে; দেহের খারাপ কোলেস্টেরল দূর করে; প্রদাহ বন্ধ করে; উচ্চ রক্তচাপ কমায়; রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখে; মানবদেহে সেরেটেনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে মস্তিষ্কে ভাললাগা অনুভূতি উৎপন্ন করে। স্পেনীয় ব্যবসায়ীরা মেক্সিকো থেকে আমাকে (মরিচ) এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যান। প্রথমে ফিলিপাইন; সেখান থেকে ভারতবর্ষ, চীন, কোরিয়া ও জাপানে কাঁচা মরিচের চাষাবাদের বিস্তার। বাংলাদেশে এখন মরিচের চাষাবাদ ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র রান্না ও ঔষুধি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছি। আথচ আমাকে অবহেলা! আর সেই সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নামের একটি অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আমাকে (মরিচ) সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। যদি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থেকে মানুষের উপকারে না আসি তাহলে যতই রাজকীয়ভাবে জন্ম হোক; সে জন্মের স্বার্থকতাই তো বৃথা।
শুনেছি বাংলাদেশে পবিত্র রমজান মাসে আমার (মরিচ) ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। সে জন্য ওই মাসে আমার কদরও বেশি। সাধারণত সারাবছর কেজি দর ৩০ টাকা থেকে ৬০ টাকা। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে ৫ থেকে ১০ টাকা দরেও বিক্রি হয়। গত রমজানে মূল্য ছিল কেজিপ্রতি ৭০ টাকা থেকে ৯০ টাকা। অথচ এখন মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছি ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমার জন্ম দেন উৎপাদন করেন তারা প্রকৃত মূল্য না পেলেও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, মধ্যস্বত্বভোগী টাউট দালাল ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা অতি বৃষ্টির অজুহাতে আমার বাজার মূল্যে ‘আগুন’ লাগিয়ে দিয়েছে।
অনেকেই ঝাল খাবার একেবারে খেতে পারেন না; আবার অনেকে ঝাল ছাড়া খেতে পারেন না। সবকিছুই আমি বুঝি। আরো বুঝি যেভাবেই মরিচের ব্যবহার হোক না কেন সাধারণ মানুষ আমাকে ভালবাসে। মরিচ ছাড়া মানুষের চলে না। তাই ধনী-গরিব সব মানুষের খাবারের টেবিলে, গরিবের পান্তাভাতে, ভর্তায় থাকতে চাই সব সময়। কিন্তু দেশের মধ্যস্বত্বভোগী ফরিয়া-দালাল, সিন্ডিকেট বৃষ্টির দোহাই দিয়ে আমার মূল্যহার এমন উপরে উঠিয়েছেন যে সাধারণ মানুষের পক্ষে মরিচের গায়ে হাত দেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগে ঢাকা শহরের নিম্নআয়ের মানুষ সবজি বাজারে গিয়ে অন্যান্য তরকারি কেনার পর ৫ টাকা ১০ টাকার কাঁচা মরিচ কিনে ঘরে ফিরতেন। এখন একশ’ গ্রাম মরিচের দাম ৩০ টাকা। জন্ম আমার যত রাজকীয় হোক না কেন এ জীবন আমি চাইনি। সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকতে না পারলে আমার জন্মই তো বৃথা। আমার এ হাহাকার ক্ষমতাসীনদের, সিন্ডিকেট দালালদের কানে কী যাচ্ছে না?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
S. Anwar ৮ অক্টোবর, ২০১৭, ৭:১১ এএম says : 0
হায়রে কাঁচা মরিচ.! তোমার কীর্তন ও ইতিহাস শুনলাম।সবই সত্য বটে। তবে মনে হচ্ছে বুদ্ধিতে তুমি এখনো কাঁচাই রয়ে গেছো। কে বলে তোমার সন্মান বা কদর নেই? আরে বোকা মরিচ কখনো কি ভেবে দেখেছো, তোমার সন্মান বৃদ্ধির জন্য আমরা কি করেছি? তোমার সন্মানের যথার্থ মুল্যায়নের জন্য বাজারে আমরা তোমার দাম সবার উপরে তুলে দিয়েছি। সমাজের অসন্মানিত ও নিচু মানুষেরা যেন তোমার ধারে-কাছে ঘেঁষার সাহস না পায়। তুমি কি দেখছোনা, বাজারে গিয়ে ওই গরীব নিচু লোকেরা তোমার সন্মানের উচ্চতা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে কিংবা মুর্ছা যাবার হাল হয়.?? আর কি সন্মান চাও তুমি? আরো বেশী সন্মান চাইতে গেলে দেখবে তখন কেউ আর তোমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। তাহলে এক সময় জনমের জন্য এই দেশ ছেড়ে তোমাকে তোমার আদি জন্মভূমিতে ফিরে যেতে হবে।
Total Reply(0)
Rafiul Azam ৮ অক্টোবর, ২০১৭, ২:৪১ পিএম says : 0
এই সরকার যত দিন থাকবে ততদিন বাড়তে থাকবে নিত্য পন্যের দাম ও বিদ্যুতের দাম।এখানে সাধারন জনগনের কিছুই করার নাই
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন