বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

কুরআন-হাদিসের আলোকে প্রতিবেশীর হক

আহমদ আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মানুষ একা নয়, সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধতা মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা। তাই তো সমাজের সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়, পরস্পরের সহযোগীতায় অবস্থানকারী মানব সংঘকে সমাজ বলে। সমাজে মানুষ একে অপরকে সহযোগীতার করে। মানুষের এ পারস্পরিক সহযোগীতা সূচনা হয়েছিলো হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)- এর সময়কাল থেকে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মানুষের সামাজিক পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের সামাজিক চাহিদা ও প্রয়োজন। তাই ইসলাম পরস্পরের মাঝে হক যথাযথ আদায়ের ব্যাপারে কঠোর উচ্চারণ করেছে। প্রিয়নবী (সা.) বলেন, জিবরাঈল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে এত বেশি তাগিদ করতেন যে এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে হয়তো অচিরেই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী সাব্যস্ত করা হবে। (বোখারী : ২/৮৮৯)
মানুষের ভালোমন্দ, শত্রু-মিত্র, উপকার-অপকার এসব কিছু নির্ভর করে প্রতিবেশীর ওপর। প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে যে, তোমরা প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী, অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন করো না। তাদের ধন-ঐশর্যের প্রতি লোভাতুর-লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করো না। হজরত ঈসা (আ.) প্রতিবেশী সম্বন্ধে বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো। ইসলাম ধর্মে প্রতিবেশীর ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, মা-বাবার সঙ্গে সৌহার্দ পূর্ণ আচরণ করো। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম এবং মিসকিনদের সঙ্গে সদাচার করো। সদ্ব্যবহার করো পরিচিত অপরিচিত প্রতিবেশী ও সাময়িক প্রতিবেশী এবং মুসাফিরদের সঙ্গে। (সুরা নীসা: ৩৬)
উক্ত আয়াত থেকে প্রতিবেশীকে আমরা তিনভাগে বিভক্ত করতে পারি। ১. নিকটতর আত্মীয় প্রতিবেশী। ২. অনাত্মীয় প্রতিবেশী। এবং ৩. সাময়িক প্রতিবেশী।
প্রতিবেশী কেবল তারাই নয়, যারা নিজ বাড়ির একান্ত আশেপাশে বসবাস করে। এর সীমারেখা আরও বিস্তৃত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের ডানে-বামে, সামনে-পেছনে চল্লিশটি বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশীর আওতার অন্তর্ভুক্ত। (বোখারি: /২৯০১)
প্রতিবেশীর হক : প্রতিবেশী অভাবী হলে তার অভাব পূরণে আর্থিক সাহায্য সহযোগীতা করা। পিড়ীত হলে তার সেবা করা। সুখে-দুঃখে সদাসর্বদা তার পাশে দাঁড়ানো। নিজে যা খাবে সম্ভব হলে প্রতিবেশীকেও তার কিছু অংশ দেয়া। নতুবা এমনভাবে আহার করা যেনো প্রতিবেশী টের না পায়। এমনটি না হলে তর মনে কষ্ট পাওয়ার আশংকা থাকে। এ বিষয়টি মহানবী (সা.)- এর বাণীতে উচ্চারিত হয়েছে এভাবে, ‘সে ব্যক্তি মুমিন নয় যে রাত যাপন করলো পরিতৃপ্ত অবস্থায় অথচ তার পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত এবং সে তা জানে।’ (তহাবী শরীফ: ১/২৫) উক্ত হাদীসে শুধু খাবারের কথা উল্লেখ করা হলেও উদ্দেশ্য শুধু খাবারই নয়; বরং উদ্দেশ্য হলো, প্রতিবেশী কোন কষ্ট ভোগ করলে সাধ্যানুযায়ী খোঁজ খবর রাখা এবং সহযোগিতা করা। প্রতিবেশীর ভেতর কেউ মারা গেলে তার জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবেশীর হক আদায়ের কারণে একদিকে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) খুশি হন, অপরদিকে সে সমাজে হয়ে ওঠেন একজন মর্যাদাশীল ব্যক্তি। সামাজিকভাবে তার সম্মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহর কসম, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়; আল্লাহর কসম, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়; আল্লাহর কসম, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়। উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ কোন ব্যক্তি মুমিন নয়? প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।’ (বোখারী: ২/৮৮৯) উক্ত হাদীসের বর্ণনা বিন্যাসের প্রতি লক্ষ্য করলে বুঝে আসবে, হাদীসের বাক্য ও শৈলী হাদীসের মর্মকে কিরূপ শক্তিশালী করেছে এবং প্রতিবেশীর হকের বিষয়টিকে রাসুল (সা.) কিরূপ তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন এবং অন্যদের মধ্যে কিরূপ চেতনা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
প্রতিবেশী যদিও বখাটে কিংবা দুশ্চরিত্র হয় এবং তার দ্বারা কোনো অনিষ্টা হয়, তাহলেও তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে নেই। বরং তার জবাব দিতে হবে উত্তম আচরণের মাধ্যমে। হজরত (রা.) একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি তার প্রতিবেশী সম্বন্ধে অভিযোগ আরোপ করলে রাসুল (সা.) তাকে ধৈর্যধারণ করতে বললেন। পুনরায় এরূপ অভিযোগ নিয়ে আসলে হুজুর (সা.) বললেন, অন্যত্র বসবাস করো। উক্ত ব্যক্তি রাসুল (সা.)- এর কথামতো অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রস্তুতি দেখে সেই দুশ্চরিত্র প্রতিবেশী স্বীয় কৃতকর্ম বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হন। সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ভবিষ্যতে এমনটি না করার দৃঢ় প্রতিশ্রæতি দেন।
প্রতিবেশীকে উপঢৌকন দেয়া : প্রতিবেশীর সঙ্গে কেবল সদাচার করার দ্বারাই তার হক আদায় হয়ে যায় না। প্রতিবেশীকে মাঝে মাঝে উপঢৌকনও দিতে হয়। অনুরূপ প্রতিবেশীকে কর্তৃক উপহার খুশিখুশি গ্রহণ করা। এতে করে পরস্পর মুহাব্বত ও ভালোবাসা জন্ম নেয়। উচ্চবিত্ত মহিলারা সাধারণত প্রতিবেশীর হাদিয়া গ্রহণে ঘৃণা করে। তাই রাসুল (সা.) মহিলাদের সম্বোধন করে বলেন, হে মুসলিম মহিলারা! তোমরা তোমাদের প্রতিবেশীর হাদিয়ার প্রতি তুচ্ছবোধ প্রদর্শন করো না, যদিও উহা বকরির খুরা হয়। রাসুল (সা.) এ বিধান নিজ পরিবারে বাস্তবায়ন করেছেন। হজরত আয়শা (রা.) জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার দুইজন প্রতিবেশী আছে, হাদিয়া দানে কাকে বেশী প্রাধান্য দিবো। হুজুর (সা.) বললেন, যে তোমার অধিকতর নিকটতম।
প্রতিবেশী হওয়ার জন্য ধর্ম প্রতিবন্ধক নয় : জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার ওপরই প্রতিবেশীর হুকুম আরোপিত। হজরত মুজাহিদ (রহ.) থেকে বর্ণিত, একদা আবদুল্লাহ ইবনে অমরের জন্য একটি বকরী জবাই করা হলো। তিনি ঘরে এসে বলতে লাগলেন, ‘তোমরা কি আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীর জন্য গোশত হাদিয়া পাঠিয়েছো’? আমি রসুলুল্লাহ (সা.)- কে বলতে শুনেছি, ‘হযরত জিবরাঈল আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে এতবেশি তাগীদ করতেন যে, এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে, হয়তো অচিরেই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার বানিয়ে দেয়া হবে।’ (তিরমিজি: ২/২৪)
সাময়িক প্রতিবেশী : যেমনিভাবে স্থায়ী প্রতিবেশীর হক রয়েছে, তেমনি যারা সাময়িক সময়ের জন্য বাড়ির পাশে অথবা আবাসিক হোটলে থাকাকালীন পার্শ্ববর্তী রুম বা সিটের প্রতিবেশী। সা¤প্রতিক অসহায় রোহিঙ্গা ভাই-বোনেরাও আমাদের প্রতিবেশী। তাদের যথাযথ খোঁজখবর নেয়া উচিৎ। তাদের কষ্ট দেয়া গুনাহে কবিরা। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে প্রতিবেশীদের কষ্ট দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই কষ্ট দেয়া যাবে না। কেননা, কুরআন-হাদিসের আলোকে তারাও আমাদের প্রতিবেশী। তাই তাদের যথাযথ সেবাশুশ্রুষা করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।
ভ্রমণকালীন প্রতিবেশী : বাড়িতে বসবাসকালে যেমন প্রতিবেশী হলো তার পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা, তদ্রুপ ভ্রমণ ও পর্যটককালে তার প্রতিবেশী হলো পার্শ্ববর্তী সিট ওয়ালা। সুতরাং তার হকের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। গাড়িতে ওঠে পুরো সিট দখল করে বসবে না। কোনো দুর্গন্ধ জিনিস খেয়ে গাড়িতে ওঠবে না এবং অহেতুক ওঠা বসা করবে না। কেননা এর দ্বারা পাশেরজনের মনে বিরক্তি ভাব উদ্রেক হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রতিবেশীর হক যথার্থভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
hr Rahman90.H ১৬ জুন, ২০২০, ১১:৪৮ এএম says : 0
প্রতিবেশির গুরুত্ব
Total Reply(0)
আব্দুল মালেক ৬ জুলাই, ২০২০, ৮:৩৭ পিএম says : 0
অনেক সুন্দর লাগছে আরও ভালো লিখতে হবে, কোরআন ও হাদিসের তথ্যভিত্তিক
Total Reply(0)
মাহমুদুল হাসান ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৮:৫৫ এএম says : 0
হাদীসগুলো কিতাবের সাথে হাদিসের সরাসরি মিল পাচ্ছি না
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন