শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইরানের কাছে হেরে গেছে যুক্তরাষ্ট্র

নিউজউইক | প্রকাশের সময় : ১৩ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

২০১৭ সালের আগস্টে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় দেইর আজ্জৌর প্রদেশে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের পরাজিত করতে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে তখন সিরিয়ার রণাঙ্গনের অবস্থা ছিল ২০১১ সালের চেয়ে একেবারেই পৃথক।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তখন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টাকারী সরকার বিরোধী বিদ্রোহীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। ২০১২ সালে তিনি তাদের অস্ত্রসজ্জিত করতে শুরু করেন। তারপর থেকে আমেরিকার বন্ধু ও মিত্ররা অবস্থানের পরিবর্তন করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী রাশিয়া বাশারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। বাশার আজ দেশব্যাপী বিদ্রোহীদের দমন করেছেন এবং হারানো বেশিরভাগ এলাকাই উদ্ধার করেছেন।
সিরিয়ার যুদ্ধে মস্কোর অংশগ্রহণ এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে জিহাদিদের প্রভাব বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে তার অবস্থান পুনর্বিন্যাসে বাধ্য করে এবং তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ইরান। যুক্তরাষ্ট্রকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিতর্কিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প মনে করছেন যে ইরান তেহরান থেকে বৈরুত পর্যন্ত একটি দীর্ঘস্থায়ী পদচিহ্ন আঁকার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রভাব করিডোর প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তা যাতে সফল না হয় যুক্তরাষ্ট্র সে চেষ্টা করছে। একদল বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পূর্ব সিরিয়ার গোত্রীয় শিকড়ের সুবিধা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তার স্বার্থ বজায় রাখতে চাইতে পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হতে পারে স্বচ্ছতা ও অঙ্গীকার যা গত ছয় বছরের সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রদর্শন করেনি। এখন তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইরানের কাছে হেরে গেছে যুক্তরাষ্ট্র।
সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির ফেলো নিকোলাস হেরাস নিউজউইককে বলেন, জোট ও সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)-এর জন্য সিরিয়ার যে কোনো অংেেশর চেয়ে দেইর আজ্জৌর হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ।
দেইর আজ্জৌর হচ্ছে এখন সিরিয়ার সহিংসতার সবচেয়ে মারাত্মক কেন্দ্র। ২০১১ সালের আগে বাশার সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানে দেইর আজ্জৌরের কোনো ভূমিকা ছিল না। মূলত গ্রামপ্রধান এ প্রদেশের তরুণরা দামেস্ক ও আলেপ্পোর মত বড় শহরগুলোতে চলে যেত। অন্যদিকে প্রচন্ড খরার কারণে প্রদেশটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখেনি কখনো। কিন্তু সরকারের দুর্নীতি, বেকারত্ব ও সামাজিক স্বাধীনতার অভাব যখন নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকার বিরোধী বিদ্রোহীদের মধ্যে সহিংসতায় রূপ নিল তখন দেইর আজ্জৌরও তাতে সামিল হয়। প্রদেশ থেকে সরকারী বাহিনীর বড় অংশই বিদায় নেয়। তবে একটি অংশ প্রায় ঘেরাও অবস্থায় সেখানে থেকে যায়।
এক পর্যায়ে আল কায়েদার আল-নুসরা ফ্রন্টসহ সরকার বিরোধী গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রদেশের লোভনীয় তেল ক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাত শুরু হয়। এ অবস্থায় আরো শক্তিশালি ইসলামিক স্টেটের আত্মপ্রকাশ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে। ২০১৩ সালেই আইএস ইরাক ও সিরিয়ার এক উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২০১৪ সালে তারা দেইর আজ্জৌর দখল করে। কিন্তু ২০১৬ ও ১৭ সালে পরিস্থিতি আবার পাল্টে যায়। আইএস ইরাকে তাদের প্রায় সকল ভূখন্ড হারিয়েছে। সিরিয়ার একদিকে রুশ-ইরান সমর্থিত সিরীয় সরকারী বাহিনী অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের সমর্থিত কুর্দি ও আরবদের নিয়ে গঠিত এসডিএফের আক্রমণে আইএস সিরিয়ায় তাদের শেষ আশ্রয়ও হারাতে চলেছে। তবে সিরিয়া সরকার ও কুর্দিদের দেইর আজ্জৌর নিয়ে পৃথক ভাবনা রয়েছে। আইএস নির্মূল হওয়ার পর উভয় পক্ষই স্থানীয় গোত্রপ্রধানদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে আসাদ সুবিধাজনক স্থানে আছেন।
আসাদের ক্ষমতায় তাকা সিরিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নীদের পছন্দ নয়। কিন্তু আইএসের পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাওয়া নিয়েও তাদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। হেরাস বলেন, আসাদ গোত্রপ্রধানদের মধ্যে এ ধারণা ছড়িয়ে দেবেন যে আমেরিকা ও তার মিত্ররা শেষ পর্যন্ত সিরিয়া ছাড়বে। আসাদই সিরিয়ার ক্ষমতায় থাকবেন।
হেরাস বলেন, দেইর আজ্জৌর বাসীরা যতটা না আমেরিকাপন্থী তার চেয়ে অনেক বেশি ইরান বিরোধী। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনুকূল। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের আইএসের বিরুদ্ধে কাজে লেগেছে। একই সাথে তা দেইর আজ্জৌর ও এ অঞ্চলের অন্যান্য অংশে সুন্নীদের মধ্যে ইরানিদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছে।
ইরাকে অঙ্গীকার ভঙ্গের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার সুন্নীদের মধ্যে সম্ভাব্য জোট গঠনে বাধা হতে পারে। কিন্তু ইরান ও তার মিত্রদের সাথে আসাদের ঘনিষ্ঠতা বর্তমান ঘটনাপ্রবাহে বিপুল প্রভাব ফেলতে পারে। পশ্চিম ইরাকে আইএসের পরাজয় দেইর আজ্জৌরে ইরাকি সুন্নীদের আত্মীয়-স্বজনকে তেহরান ও বাগদাদ সমর্থিত আল হাশদ আল শাবি নামে পরিচিত শিয়া মুসলিম পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেসের প্রতিশোধের শিকার করতে পারে। এই শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপ ও তাদের ইরানি সহায়তাপুষ্ট মিত্ররা একটি স্থলপথ নির্মান সম্পন্ন করেছে যা ইরানপন্থী গ্রুপগুলোকে ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননের মধ্যে অবাধ চলাচলের সুযোগ দিয়েছে।
হেরাস বলেন, দেইর এজ্জরে আসাদ ও ইরানের প্রভাব সীমিত করার যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভালো সুযোগ হচ্ছে একটি শক্তিশালি প্রতিনিধিত্বমূলক সামরিক পরিষদকে সমর্থন যার কাঠামো হবে উত্তরের এসডিএফের মত যারা হবে যথেষ্ট স্বাধীন ও এ অঞ্চলকে কুর্দি কবলে যেতে দেবে না।
সিরিয়া, রাশিয়া ও ইরান ধীরে ধীরে দেইর আজ্জৌর শহরের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার কুর্দি মিত্ররা অঞ্চলিক রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের চেষ্টা পরিত্যাগ করেছে মনে হয়। কার্যত দক্ষিণপশ্চিম অভিমুখে তাদের অগ্রগতি থেকে মনে হয় তাদের লক্ষ্য অন্য- তা হচ্ছে দেইর এজ্জরে অবস্থিত সিরিয়ার প্রধান তেল ক্ষেত্রগুলো।
সিরিয়ার সামরিক বিষয়ক বিশ্লেষক ওয়েল আল হুসেইনি বলেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই এই লোভনীয় তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র দখলে নিতে চায়। তার বিশ^াস, মার্কিন সমর্থিত কুর্দিরাই বেশিরভাগ তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র দখল করবে। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা উত্তরের কুর্দিদের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের বিনিময়ে এ সব আসাদ সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে চাইবে।
কুদির্ ও সিরিয়া সরকারের মধ্যে সমঝোতা প্রয়াস ট্রাম্পকে সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে আত্মরক্ষামূলক প্রস্থানের পথ দিতে পারে। একই সাথে তা ইরানের প্রভাব বিস্তারের দরজা খুলে দেবে। একমাত্র দেইর এজ্জরের সুন্নীদের গোত্রীয় কনফেডারেশনই ইরানকে এ অঞ্চলের বাইরে রাখতে পারে। সেকডেভ গ্রুপের শীর্ষ বিশ্লেষক নেইল হাউয়ার বলেন, দেইর আজ্জৌরের সুন্নী গোত্রগুলোর কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নাটকীয় ভাবে ইরান ও সিরিয়া সরকারের কাছে হেরে গেছে। তিনি বলেন, সিরিয়া সরকার ও ইরান ইতোমধ্যেই সেখানে সিরিয়া সরকারের নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। প্রায় এক বছর ধরে তারা এ চেষ্টা করছে। তাদের তুলনায় মার্কিন ও এসডিএফের চেষ্টা খুবই গৌণ, কারণ এ গ্রুপটি কুর্দিদের স্বার্থ রক্ষা নিয়ে ভাবে, সুন্নীদের নয়।
পূর্ব সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তার পদচিহ্ন হারিয়েছে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর সিনিয়র সহযোগী আরাম নারগুইজিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার আইএস বিরোধী অভিযান শেষ ও আসাদ তার নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার প্রেক্ষিতে এখন ইরান ও রাশিয়ার কৌশলগত সম্পর্ক কি দাঁড়ায় তা দেখার জন্য পর্যবেক্ষকরা অপেক্ষা করছেন।
সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়া ও ইরান জোট তৈরি করে। কিন্তু এখন ইরানের প্রবলতম দু’শত্রু ইসরাইল ও সউদী আরবের সাথে মস্কোর নতুন সম্পর্ক রচনা মস্কো ও তেহরানের মধ্যে সহিষ্ণুতার সম্পর্কে ভাঙন সৃষ্টি করতে পারে। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের আওতায় চীনেরও এ অঞ্চলের ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে। তার অর্থ এই যে, যুদ্ধোত্তর সিরিয়া কয়েকটি বড় আন্তর্জাতিক শক্তির ক্রীড়ামঞ্চে পরিণত হতে চলেছে।
নারগুইজিয়ান বলেন, প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বড় শক্তিগুলো কি করবে? তিনি নিউজউইককে বলেন, এটা একেবারেই বিশ্বশক্তিগুলোর খেলা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আজিজ ১৩ অক্টোবর, ২০১৭, ৩:৩৩ এএম says : 0
কবে যে এই ভুখন্ডে শান্তি আসবে ?
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন