সব শিখে যখন কাজ করার জন্য প্রস্তুত, তখন ক্যারিয়ারের পথ দুটি : চাকরি অথবা ফ্রিল্যান্সিং। এ দুই ক্যারিয়ারের কোনটিকে আপনি বাছাই করবেন? নিচে দুটোরই পক্ষে বিপক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরছি, সেগুলো পড়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিন।
যখন চাকরিজীবী : চাকরি মানেই সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করা। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে প্রবেশ করতে না পারা। এবং এর মানেই বসের ঝাড়ির অপেক্ষা, সেই সাথে মাসের বেতন থেকে নির্দিষ্ট একটা অংশ হিসাব করে কেটে নেওয়া হবে। অফিসে প্রবেশের এ দেরিটা যানজট কিংবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে।
যখন ফ্রিল্যান্সার : ফ্রিল্যান্সার হলে ইচ্ছামতো সময়ে ঘুম, ইচ্ছামতো সময়ে ঘুম থেকে উঠলেও কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। শুধু সময় অনুযায়ী বায়ারের কাজ জমা দেওয়াটাই আসল কাজ। সেটি দিনে করা হচ্ছে নাকি রাতে, সেটি কারও জন্যই টেনশনের বিষয় নয়।
যখন চাকরিজীবী : চাকরি মানেই যেকোনো কাজের ভুল কিংবা যেকোনো অপরাধের জন্য বসের রুমে দুরু দুরু বুকে দাঁড়ানো, পরে এ অপরাধের জন্য বসের মুখ থেকে অপমানজনক বকাঝকা শোনা। যেকোনো চাকরিজীবীর জন্য এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত এ বিষয়টি মেনে নেওয়া গেলেও চাকরি করার বয়সে এসে এ ধরনের অপমান সহ্য করা অনেক সময়ই মেনে নিতে অনেকের কষ্ট হয়। কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে অনেক সময় সবই মেনে নিতে হচ্ছে, শুধু সুযোগের অপেক্ষা।
যখন ফ্রিল্যান্সার : ফ্রিল্যান্সার মানেই হচ্ছে নিজেই বস। কোনো বসের বকাঝকা খাওয়ার ভয় এ জগতে নেই। পকেট খালি থাকলে কাজ করব, না প্রয়োজন হলে নতুন করে কোনো কাজে যুক্ত হব না। কাজ না করলে কারও কোনো বাধা নেই।
যখন চাকরিজীবী : চাকরিজীবীদের ছুটির এক দিন কিংবা সর্বোচ্চ দুদিন। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করার কারণে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিজের ব্যক্তিগত কিংবা পরিবারের বিভিন্ন কাজের চাপ এসে পড়ে। সে জন্য ভ্রমণপিপাসুদের ভ্রমণের নেশাকে ভুলে যেতে হয়। মুক্ত পাখির মতো বিশ্বব্যাপী ছুটে বেড়ানোর স্বপ্ন বাদ দিয়ে চাকরির যান্ত্রিক জীবনটাকেই বেছে নিতে হয়।
যখন ফ্রিল্যান্সার : কোন জায়গায় বসে বায়ারের কাজ করছেন এবং জমা দিচ্ছেন, সেটি ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নয়। আর এটাই হচ্ছেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের আসল মজা। ভ্রমণে বের হয়ে সমুদ্রের পাশে বসে কিংবা পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে বসেও বায়ারের কাজ সম্পন্ন করা যায়। ঘোরাঘুরি এবং কাজ দুটিই সমানতালে করার সুযোগ রয়েছে ফ্রিল্যান্সারদের।
যখন চাকরিজীবী : চাকরিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেতন হতে পারে ৮ হাজার টাকা কিংবা কারও আরও বেশি হলে হয়তো ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। কম বেতনের কারণে নিজের অনেক স্বপ্ন মনের ভেতরেই কবর দিয়ে দিতে হয়। আবার এ টাকাতেই অনেকে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন হয়তো। কারণ তারা এর চেয়ে বড় স্বপ্ন এখনো দেখতে পারছেন না।
যখন ফ্রিল্যান্সার : এ দেশে অনেক ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন, যারা স্টুডেন্ট অবস্থায়ই মাসে লাখ টাকার ওপরে অনলাইন থেকে আয় করছেন। বাংলাদেশের একজন গ্র্যাজুয়েটের যেখানে চাকরিতে মাসিক বেতন হয় ৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। অন্যদিকে অনেক ফ্রিল্যান্সার দেখা যায়, যাদের এটা মাত্র ১ সপ্তাহের আয়, অথচ তিনি হয়তো এখনো গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেননি।
যখন চাকরিজীবী : পরিবারকে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য চাকরি শুরু করলেও এই চাকরি পরিবারের অন্যদের প্রাপ্য স্নেহ, ভালোবাসার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। সারা দিন অফিসের ব্যস্ততার জন্য অনেককেই দেখা যায় পরিবারকে সময় দিতে পারেন না। সন্তান, স্ত্রী কিংবা স্নেহের ছোট ভাইবোনেরা আদর থেকে বঞ্চিত হয়। সকাল নয়টা থেকে অফিস শুরু করে যদি বাসায় পৌঁছেন রাত ১০টার পর, তাহলে কীভাবে পরিবারের লোকজন পাশে পাবেন।
যখন ফ্রিল্যান্সার : পরিবারের সবারই স্বপ্ন থাকে প্রতিবেলায় সবাইকে সাথে নিয়ে এক টেবিলে বসে খাবার খাওয়ার। চাকরিজীবীরা পরিবারের মানুষদের এ দাবিটা মেটাতে না পারলেও ফ্রিল্যান্সারদের পক্ষে সম্ভব। কারণ ফ্রিল্যান্সারদের কোনো অফিসে গিয়ে কাজ করার প্রয়োজন হয় না, কোনো নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বন্দী থাকতে হয় না। চাইলে যখন ইচ্ছা পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা দেখে আসতে পারেন কিংবা বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতেও বাধা নেই।
যখন চাকরিজীবী : হয়তো এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যারা চাকরি করতে গিয়ে স্বপ্ন দেখেন না যে তিনি নিজেই একদিন বস হয়ে নিজের একটি অফিস খুলে বসবেন। এ ইচ্ছাটা কম-বেশি সবারই মনে রয়েছে। মন চায় অন্যের অফিসে চাকরি করব না, আমার নিজের অফিসে চাকরি করবে অনেক জন, শুনবে সবাই আমার নির্দেশ, আমাকে কারও নির্দেশ শুনতে হবে না। কিন্তু এ রকম হওয়া তো সম্ভব না। চাকরি করে যে টাকা পাওয়া যায়, সেটি দিয়ে নিজের চলতেই কষ্ট হয়, অফিসের স্বপ্ন দেখব কীভাবে? অফিসের জন্য আয় করব কীভাবে?
যখন ফ্রিল্যান্সার : একজন ফ্রিল্যান্সার জানেন অনলাইন থেকে কীভাবে কাজ জোগাড় করা যায়। ১ থেকে ২ বছর যাওয়ার পর অনেক ফ্রিল্যান্সারেরই কাজের চাপ বেড়ে যায়। সেই কাজ করানোর জন্য বাধ্য হয়েই লোকজন খুঁজে নিতে হয়। এবং তখন পূরণ হয় বহুদিনের বস হওয়ার স্বপ্নটি।
যখন চাকরিজীবী : প্রতিদিন অফিসে যেতে-আসতে যানজটের জন্য কমপক্ষে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। কিছুই করার নেই। ঢাকা শহরে থাকতে হলে এবং অফিসে গিয়ে চাকরি করতে হলে এটা মেনে নিতেই হবে। যানজটে নাকাল আবার তার ওপর দেরি হলে বসের ঝাড়ি এবং বেতন কাটা— এগুলো বাড়তি পাওনা। কিন্তু এ দেশে অফিস করতে গেলে যে যানজটের কারণে কখন অফিসে ঢুকতে পারবেন, নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। এ বিষয়টা সবাই বুঝলেও অফিসের বসরা বুঝতে চান না।
যখন ফ্রিল্যান্সার : যানজটের ঝামেলায় বিরক্ত হয়ে অনেকেই সমাধান হিসেবে ফ্রিল্যান্সার পেশাটাকেই এখন পছন্দ করছেন। প্রতিদিন রুটিন মেনে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে অফিস করার ঝামেলামুক্ত থাকা যাচ্ছে। নিজের ঘরটাই তখন অফিস, আবার সেই অফিসে নিজেই বস।
যখন চাকরিজীবী : বর্তমানে রাস্তায় বের হলেই পরিবারের লোকজন টেনশনে থাকেন ঘরে আবার ফিরতে পারবেন তো। প্রতিদিন সকালে অফিসের জন্য যখন বের হন, তখন থেকেই শুরু হয় এই টেনশন, অফিস থেকে বাসায় ফেরার আগ পর্যন্ত এ টেনশন কাজ করে। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে অন্য অনেক ধরনের দুর্ঘটনার ভয় নিয়েই ঘর থেকে বের হতে হয় চাকরিজীবীদের।
যখন ফ্রিল্যান্সার : ফ্রিল্যান্সারদের জন্য রাস্তাঘাটের ঝামেলামুক্ত জীবন। ঘরে বসেই যদি চাকরিজীবীদের চেয়ে ভালো আয় করা যায়, তাহলে কেন রাস্তাঘাটে বের হওয়ার ঝুঁকি নিতে হবে? প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া লাগতে পারে, কিন্তু সেটা তো আর প্রতিদিন রুটিন মাফিক টেনশন না।
অনেক কারণেই চাকরিজীবী না হয়ে ফ্রিল্যান্সার হওয়া যেতে পারে।
১. চাকরি করতে গেলে অফিসের অন্যদের থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে নিজে নিজে কিংবা নতুন কিছু শিখতে হলে সম্পূর্ণভাবে অনলাইনের ওপর নির্ভর করতে হয়।
২. চাকরিজীবীদের জন্য প্রতি মাসের নির্দিষ্ট একটা বেতনের নিশ্চয়তা থাকলেও অনেক সময় নতুন ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে সেটা থাকে না।
৩. চাকরিজীবীদের জীবনে যে শৃঙ্খলা থাকে, সময়ানুবর্তিতার চর্চা থাকে, ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে সেটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় না।
৪. এখনো আমাদের সমাজে ফ্রিল্যান্সারদের সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, যেমন দেওয়া হয় চাকরিজীবীদের। সে জন্য বিয়েসংক্রান্ত বিষয়ে ফ্রিল্যান্সারদের বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
৫. অনেক ফ্রিল্যান্সার ঘরকুনো বেশি হওয়ার কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে সেটি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
চাকরিজীবী হবেন নাকি ফ্রিল্যান্সার হবেন— সেটি আপনার নিজের সিদ্ধান্ত। সব ক্ষেত্রে ভালো-খারাপ দুই দিকই রয়েছে। তবে এখনো এ দেশে ফ্রিল্যান্সিংটাকে অনেকেই পেশা হিসেবে নিতে ভয় পান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক কারণে। তবে অবশ্যই খুব শিগগির এর পরিবর্তন আসবে। তখন হয়তো দেখা যাবে, লোকাল অফিসগুলো ফ্রিল্যান্সার হিসেবেই তাদের অফিসের লোক নিয়োগ দেবে। অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না, ঘরে বসেই অফিস করার সুযোগ থাকবে। ধর্মঘট, হরতালে জীবন রিস্ক নিয়ে অফিসে যাওয়ার ভয়ে হয়ত অনেকেই ফ্রিল্যান্সিংকেই বাছাই করবে। অনলাইনে যোগাযোগের এ যুগে সবকিছুতেই পরিবর্তন আসবে।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে ইনকাম
১ম পর্বঃ ফ্রিল্যান্সিংয়ে আগ্রহীদের জন্য প্রাথমিক গাইডলাইন
২য় পর্বঃ ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য কি কাজ শিখবেন?
৩য় পর্বঃ ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিষয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা
৪র্থ পর্বঃ ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হওয়ার কিছু সূত্র
|লেখকঃ পরিচালক, নেক্সাস আইটি ইন্সটিটিউট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন