হোসেন মাহমুদ
বিশ্বে মানুষের যেদিন থেকে দিন যাপনের শুরু, যদিও সে ইতিহাস সুস্পষ্ট নয়, সেদিন থেকেই শ্রমেরও শুরু। শরীরটি নিশ্চল থাকলে কিংবা কেউ এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করলে তাতে শরীরের পেশিগুলোর নড়াচড়া হয়, কিন্তু তা শ্রম নয়। শ্রম হচ্ছে শিকার করা, পানি সংগ্রহ করে আনা, একটি ঘর তৈরি করা, জমিতে ফসল বোনা, কাঠ কাটা ইত্যাদি নানাবিধ কাজ যাতে কিনা প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। যে কাজে শক্তি লাগে তা হচ্ছে দৈহিক বা শারীরিক শ্রম। এ শ্রম অধিক করলে শরীর ক্লান্ত হয়। মানসিক শ্রমও আছে, তাতে শরীর ক্লান্ত না হলেও মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়। যাহোক, প্রথম দিকে মানুষ যখন নিজের সীমিত প্রয়োজনের কাজ নিজে সম্পাদন করেছে তখন শ্রম ছিল, কিন্তু শ্রমিক ছিল না। পরবর্তীতে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে শিখল, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ল কাজের পরিধি। একা কাজ করে কুলিয়ে উঠতে না পারলে তখন মানুষ সাহায্যকারীর সন্ধান করতে থাকল। খুঁজেও পেল তাকে। এভাবেই বাড়তি শ্রমের প্রয়োজন মিটাতে এলো শ্রমিক।
সমাজে সব মানুষ সমান নয়। শক্তি, জ্ঞান, কৌশল, বুদ্ধি একেক জনের একেক রকম। একইভাবে আর্থিক অবস্থাও সবার এক রকম নয়। অনেকেরই সংসার চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অর্থ জোটেনি। তখন সে প্রয়োজন মিটাতে তাকে কাজ করতে হয়। প্রথমে পাড়া, তারপর গ্রাম, তারপর শহর। একজন, দু’জন, অনেক জন। এভাবে অভাবী মানুষ শ্রমিক হলো, এক থেকে অনেক হলো। তবে তারা শ্রমিকই রইল, আর কিছু হলো না।
শ্রমের অনেক প্রকারভেদ। কেউ দিনমজুর, কেউ রাজা-পদস্থ রাজকর্মচারীর ভৃত্য, কেউ সৈনিক, কেউ সেরেস্তার কাজে নিয়োজিত, কেউ পাহারাদার। এ শ্রমিকরা কি করেনি? পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করেছে, খাল কেটে পানি এনেছে, বনজঙ্গল সাফ করেছে, বাড়িঘর তৈরি করেছে। ইতিহাসে সবকিছু লেখা হয়নি। বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে আছে মিসরের পিরামিড। কি অদ্ভুত সুন্দর, বিজ্ঞান সম্মত জটিল নির্মাণ। কত হাজার-লক্ষ শ্রমিক তাতে কাজ করেছে, তারা দেশীয় শ্রমিক না বন্দি, তারা কি পারিশ্রমিক পেতÑ সেসব কথা কোথায়ও লেখা নেই। হযরত মূসা (আ.) ও ফেরাউনের সময়কালভিত্তিক বিখ্যাত ‘দি টেন কমান্ডমেন্টস’ ছবিতে দেখা যায়, তখন শ্রমিকদের ওপর নির্মম নির্যাতন চলত। শ্রমিকদের শ্রম সাধনার অপরাপর নিদর্শনের মধ্যে ইনকা ও মায়া সভ্যতার সৃষ্টিকর্ম রয়েছে। আরো রয়েছে বিশ্বখ্যাত তাজমহলের কথা। কি আশ্চর্য, অনুপম সৃষ্টি। কয়েকশ’ বছর পরও আজো তা কালের কপোলতলে শুভ্রসমুজ্জ্বল। কিংবা বলা যায় সুদীর্ঘ চীনের প্রাচীরের কথা।
আমরা আজ যে উন্নত বিশ্বটাকে দেখতে পাচ্ছি তা গড়ে উঠেছে শ্রমিকের পরিশ্রমে। শ্রমিকের শ্রম ও ঘাম পরস্পর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কত শ্রমিকের কত যুগ-যুগান্তের পরিশ্রমের ফলে রচিত হয়েছে উন্নতি-অগ্রগতির সোপানশ্রেণি সে কথা কোথাও লেখা হয়নি। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত শ্রমিক শ্রম দিয়েছে। তার বিনিময়ে জুটেছে দু’মুঠো খাবার, নামে মাত্র কিছু পারিশ্রমিকও সে পেয়েছে যা দিয়ে চেষ্টা করেছে বৃদ্ধ পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র-সন্তানের ক্ষুণিœবৃত্তির। তার দুরবস্থার কোনো পরিবর্তন কখনোই হয়নি। রাজতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতা যেখানে এক হাতে কেন্দ্রীভূত সেখানে শ্রমিক কখনো সংগঠিত হতে পারে না। হয়ওনি। তাই সুদীর্ঘকাল বিশ্বের সর্বত্র শ্রমিক শ্রমিকই রয়ে যায়।
শ্রমিকের এই যে অপরিবর্তিত অবস্থান তাতে প্রথম পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে আমেরিকায়। এটা ঠিক যে, যন্ত্র যদি উৎপাদনের হাতিয়ার না হতো, শিল্প-কারখানা তৈরি না হত, শ্রমিক সেখানে কাজ না করত, তাদের মধ্যে শ্রম সম্পর্কে সচেতনতাবোধ গড়ে উঠত না। কারখানায় কাজ করতে গিয়েই শ্রমিক সমাজ প্রথম নিজেদের শ্রমিক হিসেবে সনাক্ত করে। তারা আর মালিকের ইচ্ছায় চোখ বাঁধা বলদের মতো কাজ করতে চাইল না। কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টায় আনার দাবি উঠল। জানা যায়, ইউরোপের মধ্যে ইংল্যান্ডে এ চেতনার প্রথম উন্মেষ ঘটে। তবে তা বিস্ফোরণের রূপ নেয় আমেরিকায়। এবং একপর্যায়ে ১৮৮৬ সালের ১ মে ঘটে শিকাগোর হে মার্কেটের সে গুলিবর্ষণের ঘটনা। বিশ্বের বহু স্থানে শিকাগোর সে আন্দোলন ছড়িয়ে গেল। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি কারণ পেল শ্রমিক সমাজ। সবচেয়ে বড় কথা, শ্রমিকদের যে সম্মান আছে, সেই প্রথম উপলব্ধ হলো।
বিশ্বে বহু কিছুই সহজে হয় না। শ্রমিকরা তো কোনোকালেই সমাজের সম্মান পাওয়ার মতো ছিল না। সেই তারা অধিকার লাভ করবে, রাষ্ট্রের শ্রমশক্তি হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাবে, এ বিষয়টি মেনে নেয়ার মতো মনে করেনি শাসক-মালিক কেউই। কিন্তু বিশ্বে ক্রমাগত শ্রমিক ঐক্যের বিস্তৃতিতে গড়ে ওঠে শক্তিশালী কাঠামো। শ্রমের সময় যেমন ৮ ঘণ্টা স্বীকৃত হয় আমরিকায়, তেমনি আরো বহু দেশে। বিশেষ করে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের অভ্যুদয় বিশ্বব্যাপী মে দিবসকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়। গোটা বিশ্বেই ১ মে বিশ্ব শ্রমিক দিবসের লাল ঝা-া ওড়ে।
বিশ্ব শ্রমিক দিবস আজ অনেকটাই পুরনো হয়ে গেছে। কিন্তু শ্রমিকরা বিশ্বের সর্বত্রই আজো ভালো নেই। শ্রমিকরা আজো সর্বত্রই সংগঠিত নয়, সর্বত্র তাদের অধিকার স্বীকৃত বা নিশ্চিত নয়। বিশ্বের অসংখ্য শ্রমিক শ্রম আন্দোলনের সুফল পায়নি। আরো কথা, বিশ্বের সর্বত্র শ্রমিকদের মর্যাদা সমান নয়, অবস্থানও সমান নয়। ইউরোপ-আমেরিকার শ্রমিক আর এশিয়া-আফ্রিকার শ্রমিকের অবস্থান এক নয়। আবার এশিয়ায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমিক আর বাংলাদেশ, ভারতের শ্রমিকের মধ্যে অবস্থান ও অধিকারগত ফারাক লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশে আগে শ্রমিক বলতে পাটকল শ্রমিকদের বোঝাত। শ্রমিক সমাজে আইনসঙ্গতভাবে আরো আছে রেল শ্রমিক, সড়ক পরিবহন শ্রমিক, নৌযান শ্রমিক প্রমুখ বহু সংগঠন। তবে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক কাজ করেন গার্মেন্টস খাতে। সবাই জানেন, এ গার্মেন্টস শ্রমিকরা প্রথম থেকেই ছিলেন বঞ্চিত, নিপীড়িত। বাংলাদেশে আর কোনো শিল্পখাতের শ্রমিকরা তাদের মতো শোষিত হয়নি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন ছিল সবচেয়ে মূল্যহীন। সাভারের স্পেকট্রাম গার্মেন্টস কারখানা ধসসহ আশুলিয়া, গাজিপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকার বিভিন্ন গার্মেন্টসে আগুন, রানাপ্লাজা ধসে মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা তার প্রকৃষ্ট উদহারণ হয়ে আছে। এসব ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোতে কর্মপরিবেশের উন্নতির চেষ্টা চলছে। নানা স্থানে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে, আবার নানা জায়গাতে হয়নি। তবে বেতন-ভাতার দিক থেকে এখনো তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু হয়নি বলে শোনা যায়।
কিন্তু এটাই বাংলাদেশের সমগ্র শ্রমচিত্র নয়। আগে সারাদেশে সবচেয়ে বেশি ছিল কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা। এখন চাষাবাদে ক্রমেই বেশি করে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। ফলে কমছে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা। তারপরও কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা বহু। আছে অসংখ্য নির্মাণ শ্রমিক। ইটভাটাগুলোতে, ধানকলে, দেশজুড়ে অসংখ্য নসিমন-করিমনে, গ্যারেজে, লেদ মেশিনে, ধোলাইখালের যন্ত্রাংশ নির্মাণ, গাড়ি মেরামত কারখানা, জিঞ্জিরায় সংখ্যাহীন বেওয়ারিশ যন্ত্র সামগ্রী নির্মাণ, পোশাক কারখানা ইত্যাদি কত পেশায় কত লক্ষ শিশুসহ শ্রমিকরা কাজ করে যাচ্ছেÑ সে হিসেব কেউ রাখে না। বিশ্ব শ্রমিক দিবস কি তারা জানে না, দুনিয়ার মজদুর এক হও সেøাগান দেয়ার সুযোগ তাদের নেই। এসব শ্রমিক ও তাদের শ্রম আড়ালেই রয়ে যায়, রয়ে যাবে। কে তাদের খোঁজ করবে, শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার দেবে, সে প্রশ্নের কোনো জবাব মেলে না। আর এর মধ্যদিয়েই প্রতিবছর মে দিবস আসে আর চলে যায়।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন