শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সিয়াম ও অর্থনৈতিক সংযম

প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ. জেড. এম. শামসুল আলম
উপবাস থাকা সিয়াম সাধনার প্রধান অঙ্গ হওয়ার তাৎপর্য কি?
আদম সন্তানের প্রথম জৈবিক প্রয়োজন খাদ্য। জন্মের পরই শিশু চিৎকার করে ওঠে, হয়তো ক্ষুধায়। তাকে নিরস্ত করার জন্যে মুখে দেয়া হয় এক ফোঁটা মধু বা তরল পানীয়। খাদ্যই মানুষের সর্বপ্রধান না হলেও সর্বপ্রথম প্রয়োজন। অনেকের মতেই সর্বপ্রধান। মানুষের যতগুলো প্রয়োজন আছে তার মধ্যে খাদ্যের প্রয়োজনই সবচেয়ে বেশি।
আমরা উল্লেখ করেছি, সিয়াম সাধনার অন্যতম উদ্দেশ্য আত্মসংযম। উপবাস হলো মানুষের অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে সংযত ও সংকুচিত করার প্রচেষ্টা।
বড় বাড়ী, সুন্দর আঙ্গিনা, সুসজ্জিত ড্রয়িংরুম ইত্যাদির অভাববোধকে আপনার সিয়াম (রোজা) কতটুকু কমাতে পারল?
অসংখ্য ভুখা-নাঙ্গার ভিড় ঠেলে শেরোয়ানী পরে ঈদের জামায়াতে যেতে আমার কি লজ্জাবোধ হয়? তা না হলে তো আমার সিয়াম সাধনাই ব্যর্থ। যে দেশে লক্ষ লক্ষ মেয়ে আব্রু ঢাকার কাপড়ের জন্য আমার কাছে হাত পাতে, সেদেশে দামি পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র ও বিলাস দ্রব্যাদির কোনো ইচ্ছাকে আমার সিয়াম কিছুটা দমিত করেছে?
যে দেশে মানুষ পথের পাশে চার হাত উঁচু ছাউনির নিচে থাকতে গিয়ে উচ্ছেদ হয়, সে দেশের আমার ঘরের মেঝে মোজাইক করার প্রবণতা ও ইচ্ছাকে আমার দীর্ঘ এক মাসের উপবাস কি প্রদমিত করতে পেরেছে? পারেনি। তাহলে আমার সিয়ামের মাধ্যমে হয়তো আমি শুধু ক্ষুৎপিপাসার কষ্টই পেলাম। বোধ হয় এর বেশি কিছু নয়।
উপবাস হলো আমার অর্থনৈতিক প্রয়োজন সংযত ও প্রদমিত করার সংকল্পের প্রতীক। কারণ সকল প্রয়োজনের চেয়ে মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন বেশি।
আপনি সারাদিন খাদ্য যা আপনার জীবনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, না খেয়ে থাকলেন তখন আপনাকে ভাবতে হবেÑ খাদ্য ছাড়াই যখন থাকতে পারি, দামি শার্টটা না হলে তাতে কি আসে যায়? গাড়িতে না চড়ে রিকশাতে চড়লাম, কি আসে যায় তাতে?
রিকশায় চলাফেলা তো গাড়িতে চড়ার ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম।
আত্মিকশক্তি বৃদ্ধি : সারাদিন উপবাস থেকে আমাকে প্রতিটি অর্থনৈতিক প্রযোজনের কথা ভাবতে হবে, আর মনে মনে বলতে হবে, এটা ছাড়াও চলতে পারে। বাড়াতে হবে আত্মিকশক্তি, অর্থনৈতিক প্রয়োজন নয়, চিন্তা করতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে যে, ভোগে নয়, ত্যাগেই মানব জীবনকে মহিয়ান করে সংসারকে সুন্দর করে। এতে শুধু বিশ্বাস নয়, পূর্ণ ইয়াকীন আনতে হবে। প্রতিটি কাজের ফাঁকে আমাকে ভাবতে হবেÑ এটা আমার না হলেও চলে। আমার মন আমার শরীরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমার আত্মার সন্তুষ্টি আমার জড় দেহের জৈবিক সন্তুষ্টির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ভাবতে হবে, আমি শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণাকাতর জীব নই, কারণ এগুলো তো সকল পশুরই আছে। আমি আমরাফুল মাখলুকাত, ক্ষুধা থাকলেও আপনি না খেয়ে থাকতে পারেন, মহত্ত্বের সাধনায় লিপ্ত হতে পারেন। এরূপ চিন্তা যদি আপনার না হয় তবে কি লাভ উপবাসে?
আহারে সংযম : শুধু খাদ্যে নয়, সকল অর্থনৈতিক প্রয়োজন সমন্ধে আমাদের আত্মসংযম অভ্যাস করা উচিত। অর্থনেতিক প্রয়োজনগুলোর মধ্যে খাদ্যের প্রয়োজনই সবচেয়ে বেশি। এ প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণে শক্তি অর্জন করতে পারলে অন্যান্য চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। ভালো জামা না পেলে বা সোফা সেটে না বসলে বা মোজাইক করা রুমে বাস করতে না পারলে এতটুকু কষ্ট হয় না, যতটুকু হয় ক্ষুধার্ত দেহে ৬ ঘণ্টা জাগ্রত থাকতে। ক্ষুধার তাড়নায় পিতা সন্তান বিক্রি করে, বাঘিনী সন্তানের হাড় মটকে রক্ত পর্যন্ত পান করে।
রমজান মাসে আমাদের খাওয়া উচিত সবচেয়ে কম। রাসূল (সা.)-এর সময় রমজান আসতো ধনীদের জন্য আল্লাহর খাস রহমত হিসাবে। কারণ এটা ছিল তাদের গুণাহ্ মাফ ও সওয়াব হাসিলের মাস। তাঁরা কোনো বিলাসে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর ইবাদতেই বেশি লিপ্ত থাকতেন। তাঁরাই হতেন সমাজের সবচেয়ে পরহেজগার শ্রেণী। ধন-দৌলতের জন্য লজ্জিত হয়ে এ মাসে তাঁরা প্রমাণ করতেন যে, ধন তাঁদের নিজের ভোগের জন্য নয়।
রমজান ও বাজারদর : যেহেতু ধনীরা এ মাসে কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া করতেন কম, তাই বাজারে জিনিসপত্রের দাম থাকতো সবচেয়ে কম। স্বল্প ও সীমিত আয়ের লোকেরা যে খাবার ব্যয় বাহুল্য হবে মনে করে অন্য মাসে খেতে পারত না, তারা রমজান মাসের মন্দ বাজারে তা কিনতে পারত। কিন্তু আমাদের দেশে রমজান মাসে ধনীরা খাদ্য-বস্ত্র সব কিছুতেই বেশি ব্যয় করেন। তাঁদের বিত্তের আক্রমণে বাজারের হাল-হাকিকত হয় বেসামাল। এক টাকার মাছ পাঁচ-ছয় টাকায় বিক্রি হয়। সীমিত ও স্বল্পআয়ের মানুষেরও অবস্থা রমজানে ত্রাহী ত্রাহী।
ক্ষুদে রাক্ষস : রমজানের দাবি হলো ভোজনের ব্যাপারে আত্মসংযম অনুশীলন করা। কিন্তু আমরা ধনী-নির্ধন প্রায় সকলেই করি তার উল্টো। এ মাসে বহু রোজাদার একটি ক্ষুদে রাক্ষসে পরিণত হন।
এ মাসেই পেটের অসুখ সবচেয়ে বেশি হয়। এ মাসেই সালফাগনেডিন, নাকাতম, এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি সবরকম পেটের পীড়ার ওষুধ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এ মাসেই পেটে ভুটভাট বেশি হয়, টক-ঢেঁকুর বেশি ওঠে।
স্বল্পাহারের মাধ্যমে মনে সংযম সৃষ্টির যে মহৎ উদ্দেশ্য আজ সে মহৎ উদ্দেশ্য ভোজন বিলাস চরিতার্থের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ব্যর্থ মনে হয়। রমজান মাসে প্রতিটি রোজাদারের কর্তব্য সমাজে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ব্যক্তিদের প্রয়োজন এবং অসুবিধার কথা ভেবে খাদ্যদ্রব্য কম ক্রয় করাÑ যাতে তাঁদের ভোজনলিপ্সা বা অপকর্মের জন্য জিনিসপত্রের দামের স্থিতিশীলতা নষ্ট না হয়। বাজারে দাম বৃদ্ধি না পায়।
খাদ্যের ব্যাপারে অপর যে বিষয়টি সম্বন্ধে প্রত্যেক মাসে, বিশেষ করে রোজার মাসে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা হলো হালাল-হারাম চিন্তা করে খাদ্য গ্রহণ করা।
রমজান ও হারাম রোজগার : বহু হারাম জিনিসের মধ্যে সাধারণ দৃষ্টিতে হারাম বস্তু হলো মদ, শূকরের মাংস ও ঘুষ। শূকরের মাংস বাংলাদেশের রোজাদার বা বেরোজাদার মুসলিম কেউই খায় না। মদ সাধারণত ডোম, মেথর এবং কিছুসংখ্যক পথভ্রষ্ট ধনীরা পান করে। আর একটি হারাম কিন্তু অনেকেই খাই যা মদ খাওয়া এবং শূকরের গোশত খাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি পাপ এবং তা হলো হারাম রোজগার। এটা শুধুমাত্র ঘুষের মধ্যেই সীমিত নয়। অনেকেই বিপদে পড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ ব্যতীত আমদানি-রফতানি বা বড় ব্যবসা এক রকম অসম্ভব। ইচ্ছা থাকলেও সৎ থাকা যায় না।
ঘুষ ছাড়াও হারাম পদ্ধতির রোজগার আছে এবং এ হারাম রোজগারে সাধারণত আমরা চাকরিজীবীরাই বেশি লিপ্ত এবং এতে মস্তবড় মোত্তাকী পরহেজগার, অসম্ভব সৎ বলে সুনামের অধিকারী অফিসারও আছেন।
একদিকে হারাম কাজ ও হারাম রোজগার করে যারা, তারা আবার নিয়মিত রোজাও করে। আত্মা তাদের শুদ্ধ নয়, তবে তারা আত্মশুদ্ধি চায়। নিজেকে ফাঁকি দেয়ার এই প্রচেষ্টায় কখনই আত্মোন্নতি লাভ হয় না। যে হারাম সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ, সে হারাম রোজার মধ্যে খাওয়া রোজাকে উপহাস করা নয় কি?
রমজান ও কাজে ফাঁকি : এবার আমার চেহারাটা একটু দেখুন। ধরুন, আমি কোনো অফিসে চাকরি করি। সরকার প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজের জন্য বেতন দেন। কিন্তু আমি কাজ করি মাত্র তিন ঘণ্টা। বাকি সময়টা অফিসে হাজিরা দিয়ে নিজের কাজ করে বেড়াই। আত্মীয়স্বজনের জন্য তদবির করি, খোশগল্প করি, এ টেবিল ও টেবিল করি। তিন ঘণ্টা কাজ করে আট ঘণ্টার বেতন নিলাম। আমাকে আপনি কি বলবেন? এক সের তৈলে এক পোয়া কম দিলে আপনি দোকানদারকে বলেন ডাকাত। দুঘণ্টা কাজ করে আট ঘণ্টার বেতন নিলাম, আপনি আমাকে বলবেন বড় অফিসার। আমরা ভদ্রলোক। এই শ্রেণীতে আমরা যারা পড়ি তাদের সমস্ত রোজগারই হারাম।
এই টাকা দিয়ে খোরমা-খেজুর খাই আর জমজমের পানি খাই, সবই হবে হারাম। শুধু ঘুষের টাকাই হারাম নয়, পুরো কাজ না করে পুরো বেতন নেয়াও হারাম।
রমজানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো এরূপ হারাম থেকে বিরত থাকতে সচেতন অনুশীলন ও সাধনা করা। রোজার দিনে বহু রোজাদার অফিসে যায় দেরি করে, ক্লান্ত বলে অফিস ত্যাগ করেন ছুটির অনেক আগে। বাংলাদেশে এমন কোনো মুফতি, আলেম, ফাজেল নেই যিনি বলবেন তিন ঘণ্টা কাজ করে চার ঘণ্টার বেতন নেয়া হালাল। সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা, সরকারকে ফাঁকি দেয়ার মতো বড় পাপ এ দুনিয়াতে আর নেই।
সাংস্কৃতিক রোজা : সিয়াম পালন করতে দশ-বারো বছরের কিশোরদের উৎসাহ দেখেছেন! তারা কি সিয়ামের তাৎপর্য বোঝে? তবু সিয়াম পালন করতে চায়। কে ক’টা রোযা রাখল তারা তার হিসাব রাখে। এতে তাদের ধর্মীয় চেতনা সক্রিয় যতটুকু, তার চেয়ে বেশি সক্রিয় সাংস্কৃতিক চেতনা। তারা যে সমাজে বাস করে সে সমাজে এর সামাজিক মূল্য আছে। এটা তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। তাই তারা তাদের এই সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চায়। ধর্মীয় চেতনা যতটুকুই থাক না কেন, সামাজিক স্বীকৃতিই তাদের অনুপ্রেরণার উৎস। আপনার আমার উপবাস এবং সিয়াম-প্রবণতাও কি তাই?
শুধু শিশু-কিশোররাই নন, আমাদের প্রবীণদের অনেকেও নিতান্ত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে সিয়াম পালন করেন। তাঁরা দেখে এসেছেন যে, তাদের মা-বাবা, দাদা-দাদি সিয়াম পালন করেছেন। বর্তমানেও সমাজের বহু ব্যক্তি সিয়াম পালন করেন। যারা সিয়াম পালন করেন না তাদেরকে লোকে খারাপ মনে করে। তাই সিয়াম সামাজিক কারণেই পালন করতে হয়।
এই সামাজিক রোজায় কি সিয়ামের আসল উদ্দেশ্য হাসিল হয়? আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে তৎকালীন বর্বর আরবেরা রাসূল (সা.)-কে বাধা দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি সামাজিক এবং প্রচলিত সাংস্কৃতিক বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি তাদের বাপ-দাদাদের প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে, তাদের অতি আদরের পাথরের খোদাগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন।
আজকাল আমরা যারা সামাজিক কারণে সিয়াম পালন করি, তাদের মানসিকতা এবং আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে যারা মূর্তিপূজা করত তাদের মানসিকতার মধ্যে পার্থক্য কতটুকু?
লেখক : সাবেক সচিব, গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন