মো হা ম্ম দ আ ব দু ল গ ফু র
উপমহাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘শেখ’ পদবিধারী দুই ব্যক্তিকে ইতিহাসে বিশেষ স্থান করে নিতে দেখা যায়। তাদের উভয়েরই জন্ম ব্রিটিশ শাসনামলে। দুজনই ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। উভয়েরই জীবনের প্রধান স্বপ্ন ছিল নিজ নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতা। এ স্বপ্ন পূরণে বাস্তব পথে অগ্রসর হওয়ার ফলে একজন সফল হলেও অন্যজন অবাস্তব পথে অগ্রসর হওয়ায় ব্যর্থতার বেদনা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। শেখ পদবিধারী এ দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অপরজন শেরে কাশ্মীর শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। উভয়ই যে খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে নিজ নিজ দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাওয়াটাও ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের জন্য শুধু স্বদেশের স্বাধীনতা, মুক্তি ও কল্যাণ কামনা করাটাই যথেষ্ট নয়, সে লক্ষ্য অর্জনে বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করাটাও জরুরি।
উপমহাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যে রাজনৈতিক বাস্তবতা বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার আলোকে দেখা যায় উপমহাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য উপমহাদেশের মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। এর বিরুদ্ধে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতা কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের যে দাবি এক পর্যায়ে পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে তার ভিত্তি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। উপমহাদেশের মুসলমানরা শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নয়, তারা (তদানীন্তন) দশ কোটি জনসংখ্যার একটি স্বতন্ত্র জাতি, তাই স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে তাদের স্বাধীন স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রয়োজন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, উপমহাদেশের মুসলমানরা হঠাৎ করেই স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেনি। অখ- ভারতের কাঠামোর মধ্যেই তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাবি-দাওয়া পূরণের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরই তারা নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের একগুঁয়েমি এবং তাদের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষপাতের কারণে তাদের সেসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
ব্রিটিশ ভারতের হিন্দু নেতাদের মধ্যে মুসলমানদের প্রতি উদার মনোভাবের কোনো নেতা যে একেবারে ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু স্ব-সমাজে তারা ছিলেন কোণঠাসা অবস্থায়। এ ক্ষেত্রে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। অবিভক্ত বঙ্গে মুসলমানদের ক্রমে ক্রমে সংখ্যানুপাতিক হারে সরকারি চাকরি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তার উদ্যোগে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের গোড়ার দিকে বেঙ্গল প্যাক্ট নামের যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তার বিরুদ্ধে গোড়া থেকেই কট্টর হিন্দুদের ছিল মহাআক্রোশ। চিত্তরঞ্জন দাশ জীবিত থাকা অবস্থায়ই এ চুক্তির বিরুদ্ধে তারা তুমুল সমালোচনা শুরু করে। তার মৃত্যুর পর প্রথম সুযোগেই কংগ্রেস এ চুক্তি বাতিল করে দেয়।
এসব দুঃখজনক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটেই ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, ইতিহাসে সেটাই লাহোর প্রস্তাব হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। এই প্রস্তাবে কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দের উল্লেখ ছিল না। কিন্তু পরদিন হিন্দু পত্রিকাসমূহে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত’ বলে খবরটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের আন্দোলন পাকিস্তান আন্দোলন নামেই পরিচিতি লাভ করে।
লাহোর প্রস্তাবে গৃহীত হওয়ার পর একে সাম্প্রদায়িক প্রস্তাব বলে এর বিরুদ্ধে প্রচুর অপপ্রচার চালানো হয়। কিন্তু এসব সমালোচনার কোনো বাস্তব ভিত্তিই ছিল না। কারণ লাহোর প্রস্তাবের দ্বিতীয়াংশের মধ্যেই প্রস্তাবিত মুসলিম-প্রধান ও হিন্দু-প্রধান সকল রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লিখিত ছিল। বাস্তব ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের পার্টিশনের পর তদানীন্তন পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা প্রায় ঘটেইনি। পক্ষান্তরে ভারতে মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হতো না এমন মাস খুব কমই দেখা যেত। ভারতের সেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ধারাবাহিকতার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ছিল গুজরাট। এই সাম্প্রদায়িক প্রবণতা ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে ক্রমে বেড়েই চলেছে। গুজরাট দাঙ্গার নায়ক নরেন্দ্র মোদি ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছেন, তা বাস্তবায়িত হলে তাতে সেকুলার ভারতের প্রকৃত চেহারা বিশ্ববাসীর কাছে আরও নগ্নভাবে প্রকট হয়ে পড়বে।
এবার যে বিষয় নিয়ে আজকের এ লেখা শুরু করেছিলাম সে প্রসঙ্গে ফিরে আসি। উপমহাদেশের শেখ পদবিধারী যে দুই রাজনীতিবিদ রাজনীতি ক্ষেত্রে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন, তাদের অন্যতম কাশ্মীরের শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তার আজীবনের স্বপ্ন কাশ্মীরের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভুল ও অবাস্তব পন্থা অবলম্বন করায় স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়েই তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। তিনি উপমহাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সহযোগী সংস্থা হিসেবে ন্যাশনাল কনফারেন্স গড়ে তুলেছিলেন। তিনি শুধু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক হিসেবেই রাজনীতি করেননি, ব্যক্তিগত জীবনেও পরিণত হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা প-িত জওহরলাল নেহরুর পারিবারিক বন্ধু। নেহরু পরিবারের সদস্যদের সাথে এই অস্বাভাবিক ঘনিষ্ঠতার খেসারত তাকে কেমন কঠিনভাবে দিতে হয়েছিল পরবর্তী ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা আইনের খসরানুসারে কাশ্মীরের তদানীন্তন অমুসলিম রাজা মুসলিম-প্রধান এ দেশীয় রাজ্যটির ভারতীয় ডোমিনিয়নে যোগদানের ঘোষণা দেন। এর পরপরই কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য পাঠানো হয়। মুসলিম-প্রধান কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্য প্রবেশ ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার ফলে রাজ্যে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাতে শেরে-কাশ্মীর শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর আজীবনের কাশ্মীরের স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তিনি স্বাধীন কাশ্মীর প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও দেন। কিন্তু এ ঘোষণার খেসারত তাকে দিতে হয় বড় কঠিনভাবে।
স্বাধীনতার পর তার প্রিয় বন্ধু কংগ্রেস নেতা প-িত জওহরলাল নেহরু যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের স্বাধীনতা দাবি উত্থাপনের দায়ে নেহরু পরিবারের এই ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ আবদুল্লাহ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। শেখ আবদুল্লাহকে রাজনৈতিক জীবনের স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রে ভুল অবাস্তব পন্থা অবলম্বনের ফলে শুধু বৃদ্ধ বয়সে কারাবাসের যন্ত্রণাই ভোগ করতে হয়নি, তার আজীবনের স্বপ্নভঙ্গের বেদনাও তাকে সইতে হয়েছে অসহায়ভাবে। শেখ আবদুল্লাহর ভুলের খেসারত শুধু তিনি নিজেই দেননি, তার ভুলের মাশুল আজও গুনছে হিন্দু-শাসিত ভারতের অধীনে মুসলিম-প্রধান কাশ্মীরের হতভাগ্য অধিবাসীরা।
পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেরে কাশ্মীর শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর তুলনায় তার আজীবনের স্বপ্ন পূরণে অনেক বেশি বাস্তববাদিতার পরিচয় দেন। তিনি ছাত্র বয়সেই মুসলিম লীগের ছাত্রফ্রন্ট মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন এবং অল্প দিনের মধ্যেই মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সম্ভাবনাময় সাহসী তরুণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। শেখ আবদুল্লাহ যেখানে অখ- ভারতের প্রবক্তা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে মুসলিম-প্রধান কাশ্মীরের স্বাধীনতার অবাস্তব স্বপ্ন দেখতেন, সেখানে বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের একজন উৎসাহী কর্মী হিসেবে কালক্রমে বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ স্বপ্নের মধ্যে কোনো অবাস্তবতা ছিল না। কারণ যে লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি বিবেচনা করা হয়, সেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা উল্লিখিত ছিল। লাহোর প্রস্তাবের এ বৈশিষ্ট্যও ছিল খুবই স্বাভাবিক। কারণ উপমহাদেশের মুসলিম-অধ্যুষিত পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মধ্যে হাজার মাইলের দূরত্ব। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখ- মিলে একটি রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। এ বাস্তবতা সম্বন্ধে মুসলিম লীগ নেতারা যে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় লাহোর প্রস্তাবের আংশিক সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৪৬ সালের দিল্লি কনভেনশনে উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা মিলে আপাতত একটি (পাকিস্তান) রাষ্ট্র গঠনের যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তার উত্থাপক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষণ থেকেও।
ওই প্রস্তাব উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি যে ভাষণ দেন তাতে এক পর্যায়ে বলেন, অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেন, পাকিস্তানই আমার শেষ দাবি কি-না? আমি সে প্রশ্নের কোনো জবাব দেব না। তবে এ কথা আমি অবশ্যই বলব, এ মুহূর্তে পাকিস্তানই আমার প্রধান দাবি। অর্থাৎ তিনিও অদূর ভবিষ্যতে-স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নাকচ করেননি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা অখ- ভারতের প্রবক্তা কংগ্রেসের নির্দেশিত পথে সম্ভব নয়। এ লক্ষ্য পূরণে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রবক্তা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের পথেই অগ্রসর হতে হবে। এই বাস্তবতাবাদী কর্মপন্থার কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলেও অবাস্তব রাজনৈতিক কর্মপন্থার কারণে শেরে কাশ্মীর শেখ আবদুল্লাহকে তার স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়েই এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন