এ কে এম ফজলুর রহমান মুনশী : একজন নবীর সর্বপ্রথম ও অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব হচ্ছে তাবলিগ এবং দাওয়াত। অর্থাৎ যে সত্য তিনি আল্লাহর নিকট হতে লাভ করেছিলেন তা অন্যান্যদের নিকট পৌঁছে দেয়া এবং যে জ্ঞান তাঁকে প্রদান করা হয়েছিল, তা সম্পর্কে অন্যান্যদের অবহিত করা। আল্লাহর যে পয়গাম তাঁর নিকট পৌঁছেছিল তা মানুষকে শুনিয়ে দেয়া। তিনি তাঁকে যে সত্যতা সম্পর্কে বাখবর করেছিলেন তা সম্পর্কে সমগোত্রীয়দের অবহিত করা। যে সম্পদ, যে প্রাণশক্তি, যে বাকশক্তি, যে চিন্তাশক্তি, যে আত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি তাঁকে দান করা হয়েছিল সেগুলো দাওয়াত ও তাবলিগের পথে ব্যয় করা এবং এই বুঝানো, শিখানো ও সত্যপথে আনয়নের ক্ষেত্রে সত্যতার অভিব্যক্তিকে গ্রহণ করা। আর এই ঘোষণা ও দাওয়াতের মাঝে যে সকল বেদনা ও কষ্ট প্রতিবন্ধক হোক, তাকে শান্তির পরশ বলে বিবেচনা করা। যে যন্ত্রণাই দেখা দিক, তাকে আরাম মনে করা। এই প্রান্তরের বিষাক্ত কাঁটার আঘাতকে ফুলের পরশ বলে মনে করা। এই সত্য আহ্বানকে স্তিমিত করার জন্য যে শক্তিই মাথা তুলুক না কেন তা পদদলিত করা। মাল ও দৌলত, পরিবার-পরিজন মোটকথা যে কোন জিনিস এই সফরের সামনে আসুক তা হটিয়ে দেয়া এবং তাঁর যাবতীয় চেষ্টা ও তদবিরের উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহর রেজামন্দি, সৃষ্টিজগতের কল্যাণ সাধন এবং রিসালতের দায়িত্ব নিষ্পন্ন করা ছাড়া কিছুই না হওয়া।
আম্বিয়াদের দাওয়াত ও তাবলিগের মূল মর্ম হচ্ছে এই যে, এই পৃথিবীতে যত পয়গাম্বর আগমন করেছেন, তাঁরা নিজেদের দায়িত্বকে এতই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন যে, একটি মুহূর্তের জন্যও তাঁরা এতে শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। কারণ বর্তমান বিশ্বে আল্লাহর মহব্বত, ভ্রাতৃপ্রেম ও ভাতৃ¯েœহ, মানবিক সহমর্মিতা, নিঃস্বদের সাহায্য করা, গরিবদের সাহায্য করা এবং অন্যান্য পুণ্য কর্মকা-ের যে বিকাশ দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে নবী ও রাসূলদের দাওয়াত ও তাবলিগ, চেষ্টা ও সাধনার শুভ ফলমাত্র।
এই পৃথিবীতে বহু বড় বড় চিন্তাবিদ, বড় বড় কবি, নামী-দামী দার্শনিক নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলতে বুঝেন, অন্যকে বুঝিয়ে দেয়া, বড়জোর জানিয়ে দেয়া। কিন্তু আম্বিয়ায়ে কেরাম যে সত্যকে লাভ করেন তা অন্যদের বুঝানো এবং সম্ভাব্য সকল পন্থায় তা প্রচার করা এবং দুনিয়ার মানুষকে তা বিশ্বাস করানোর জন্য তারা নিজেদের সার্বিক শক্তি নিয়োগ করেন। এমনিভাবে তাঁরা প্রত্যেক বিপদকে উপেক্ষা করে, মূল সত্যকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে প্রাণপণ কাজ করেছেন এবং অন্ধজনকে পথের দিশা দেখিয়েছেন। তাই আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রশংসা করে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, ‘তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করত এবং তাঁকে ভয় করত এবং আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করত না, আর হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা আহযাব : রুকু-৫) হযরত মূসা (আ:)-কে হুকুম দেয়া হয়েছিল, “ফেরাউনের কাছে গমন কর কেননা সে বিরুদ্ধাচরণ করেছে।” (সূরা ত্বাহা) আর রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পয়গামে রাব্বানীকে নির্ভয়ে প্রচার করুন। দুশমনদের ভয় মোটেই করবেন না। কেননা তাঁর হেফাজতের দায়িত্ব শাহন শাহে দো-আলম নিজেই গ্রহণ করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের নিকট হতে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার করুন। যদি তা না করেন তাহলে আপনি তাঁর বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহপাক আপনাকে মানুষ হতে রক্ষা করবেন।” (সূরা মায়িদাহ : রুকু-১০)
আম্বিয়ায়ে কেরামের তাবলিগ ও দাওয়াতের মাঝে খোশ-খবরী প্রদান ও ভীতি-প্রদর্শন উভয়টিই থাকে। তাবসীর অর্থাৎ খোশ-খবরী দেয়া, আশার বাণী শোনানো এবং এনজার অর্থাৎ আল্লাহর জালালের ভীতি-প্রদর্শন করা, আল্লাহর আজাবের ভয় দেখানো এবং মানুষকে তাঁদের খারাপ পরিণাম সম্পর্কে সচেতন করা। আম্বিয়াদের আগমন এই দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারিত হয় এজন্য যে, আল্লাহর প্রমাণ উপস্থাপন বান্দাহদের প্রতি যেন পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “সুসংবাদবাহী ও সাবধানকারী রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূল আগমন করার পর আল্লাহর বিরুদ্ধে মানুষের কোন অভিযোগ না থাকে। এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (সূরা নিসা : রুকু-২৩)
আম্বিয়ায়ে কেরাম পয়গামে ইলাহী পৌঁছানোর সাথে সাথে নিজেদের মঙ্গলাকাক্সক্ষা, আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতার ঘোষণাও করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “আমি আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাক্সক্ষী।” (সূরা আ’রাফ : রুকু-৯)
অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, “তারপর সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছিয়েছিলাম এবং তোমাদেরকে হিতোপদেশ দিয়েছিলাম; কিন্তু তোমরা হিতকাক্সক্ষীদেরকে পছন্দ কর না।” (সূরা আ’রাফ : রুকু-১০)
মহান আল্লাহপাক আরো ঘোষণা করেছেন, “এবং হে আমার সম্প্রদায়! আমার প্রতিপালকের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে উপদেশ দিয়েছি, সুতরাং আমি অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য কেমন করে আক্ষেপ করি?” (সূরা আ’রাফ : রুকু-১১)
অন্যত্র আরো ঘোষণা করা হয়েছে, “হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন-সম্পদ কামনা করি না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহরই নিকট সংরক্ষিত।” (সূরা হুদ : রুকু-৩) একই সূরার সামনে অগ্রসর হয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, “হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের কাছে পারিশ্রমিক চাই না, আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট আছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা হুদ : রুকু-৫)
একটি সন্দেহের অবসান : বক্ষমান নিবন্ধে আমরা এমন একটি সন্দেহের অপনোদন করতে প্রয়াস পাব যা কোন কোন লোক রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সিফাতে তাবলিগ বা প্রচারের স্বরূপ সম্বন্ধে পোষণ করে থাকে। আল-কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই অর্থপূর্ণ বাণী রয়েছে যে, “রাসূলগণের কাজ হচ্ছে শুধু কেবল পয়গাম পৌঁছে দেয়া”-এর দ্বারা কতিপয় ক্ষীণদৃষ্টিধারীদের এই ধোঁকা হতে পারে যে, রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু কেবল অহীয়ে ইলাহীর তাবলিগ করা। অর্থাৎ কোরআনুল কারীমের শব্দগুলোকে মানুষের কাছে হুবহু পৌঁছে দেয়াই তাঁর দায়িত্ব। এগুলোর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, উদ্দেশাবলীর সঞ্চালন তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। এমনকি এই অধিকারও তাঁকে দেয়া হয়নি। তাদের দৃষ্টিতে মুবাল্লেগ রাসূলের পদমর্যাদা হচ্ছে একজন কাসেদ বা সংবাদবাহকতুল্য। যে একস্থান হতে অন্যস্থানে চিঠি পৌঁছে দেন। কিন্তু এই চিঠির ভাষার অর্থ, মর্ম-বিশ্লেষণ করার দায়িত্ব তার নয়। এমনকি সে এ কথাও জানে না যে, আবদ্ধ খামে কি আছে।
হয়ত তাদের মাঝে এই ধোঁকা এই আয়াত ছাড়া ‘রাসূল’ শব্দটি সম্পর্কেও হয়ে থাকতে পারে। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- কাসেদ বা বার্তাবাহক। কিন্তু তাদের মাঝে এই খেয়াল নেই যে, যেখানে তাঁকে রাসূল বলা হয়েছে, ঠিক একইভাবে নবীও (খবর প্রাপক) বলা হয়েছে। তাছাড়া মুবাশশির (খোশ-খবরদাতা) নাজির (ভীতি প্রদর্শনকারী), সিরাজুম মুনীর (আলোকোজ্জ্বলকারী বাতি) সুবিজ্ঞ মহৎ চরিত্রের অধিকারী, প্রশংসিত স্থানের অধিকারী, মুসতাফা (মাকবুল), মুজতাবা (মর্যাদাশীল) মুবিন (বয়ান ও বিশ্লেষণকারী), মুয়াল্লিম (শিক্ষাদাতা), মুযাক্কি (পবিত্রকারী, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী), হাকেম (ফায়সালাকারী), মুতায়িন (আনুগত্যপ্রাপ্ত) নির্দেশদাতা, নিষেধাজ্ঞাকারীও বলা হয়েছে। তবে কি এসকল গুণাবলী কেবলমাত্র এ কথাই প্রকাশ করে যে, তিনি শুধু কাসেদ ও পয়গামদানকারী ছিলেন? এ সকল বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর সাথে একজন মামুলী কাসেদ ও পত্রবাহকের কোন তুলনাই চলতে পারে না।
রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পয়গামের তফসির ও বিশ্লেষণ বহু আরবি ভাষাবিদ করেছেন। এর মূল মর্ম উদঘাটনের দাবিও অনেকে করেছেন। কিন্তু যিনি পয়গামের অধিকারী ছিলেন তিনি নিজের পয়গাম্বরীর সময় এর অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে জানতেন না এবং বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ সম্বন্ধে অনবহিত ছিলেন- এটা তো এক আশ্চর্য কথা। এটা তো মোটেই সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা ইতিপূর্বে যা উল্লেখ করেছি, এতেই তাদের এজাতীয় ধারণা বাতিল হয়ে যায়।
বিরুদ্ধবাদীদের সন্দেহ করার একটি কারণ এও হতে পারে যে, ইসলামের আইন প্রবর্তন ও বিধান জারির অধিকার কেবলমাত্র আল্লাহপাকের জন্যই স্বীকার করা হয়েছে এবং তিনিই হচ্ছেন আসল বিধানদাতা। সুতরাং রাসূলের জন্যও অহীয়ে কিতাবের দ্বারা পৃথক বিধান তৈরির অধিকার যদি স্বীকার করা হয় তাহলে আল্লাহ ছাড়া অপর এক বিধানবার্তার কথাও স্বীকার করা হয়।
এই অভিযোগ ও সন্দেহের প্রথম উত্তর হচ্ছে এই যে, আমরা রাসূলকে বিধানদাতা নয় বরং বিধান প্রবর্তনকারী বা বিশ্লেষণকারী মনে করি। তবে কি আদালতে জজ বা বিচারক যখন স্বীয় আসনে বসে রাষ্ট্রীয় কানুনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন তিনি স্বীয় এই কাজের মাধ্যমে তখনকার সুলতান হয়ে আইন প্রবর্তকের পদমর্যাদা লাভ করেন অথবা শুধু আইনের বিশ্লেষকের দায়িত্ব পালন করেন? এই অবস্থা ঐশী আদালতের কাজীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যাকে আমরা নবী এবং রাসূল, মুয়াল্লিম এবং মুবীন বলে থাকি।
আর দ্বিতীয় উত্তর হচ্ছে এই যে, আল্লাহপাক স্বীয় প্রত্যেক পয়গাম এবং উদ্দেশ্য ও উপলক্ষ এবং ফায়সালার দ্বারা শুধু অহীর সেই নির্দিষ্ট তরিকার মাধ্যমে স্বীয় পয়গাম্বরকে অবহিত করেন না, যে নির্দিষ্ট তরিকার দ্বারা কুরআন নাজিল হয়েছে; বরং তিনি তিনটি শ্রেণীর দ্বারা অপন উদ্দেশ্য সেই রাসূলের উপর তুলে ধরেন এবং এর মাঝে প্রত্যেক শ্রেণীর অহীর আনুগত্যকে উম্মতের উপর ফরজ করেছেন। চাই তা সরাসরি অহী হোক যা আল্লাহর শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যাকে কোরআন বলা হয় অথবা রাব্বানী অর্থ ও মর্ম রাসূলের মুখ নিঃসৃত শব্দে প্রকাশ হোক যাকে হাদীস ও সুন্নাত বলা হয়। মোটকথা, তা কিতাবে ইলাহীর দ্বারাই হোক অথবা হেকমতে রাব্বানীর ফায়সালা দ্বারাই হোক। কুরআনুল কারীমের ঐ সকল আয়াত যার অর্থ হচ্ছে এই যে, “আমাদের রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু পয়গাম পৌঁছানো”-এর উদ্দেশ্য শুধু এই নয় যে, তিনি কেবলমাত্র পয়গাম পৌঁছানেওয়ালা।
শুভ সংবাদ শোনানেওয়ালা নয়, হুঁশিয়ার ও সতর্ককারী নয়, পয়গামে ইলাহীর শব্দাবলী শ্রবণ করার পর এগুলোর শিক্ষাদাতা নয়, আয়াতে ইলাহীর বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাকারী নয়, হাদী ও পথপ্রদর্শক নয় এমনকি পবিত্রকারীও নয়। সুতরাং এমন কথা বলা কুরআনের বিপরীত এবং জ্ঞান ও সমীক্ষার খেলাপ। আল-কুরআনের কয়েক স্থানে ঘোষণা করা হয়েছে, “অবশ্যই আপনি ভীতি প্রদর্শনকারী”। (সূরা সোয়াদ, রা’য়াদ, নাযিয়াত) অপর এক স্থানে আছে “আমি অবশ্যই ভীতি প্রদর্শনকারীমাত্র। (সূরা সোয়াদ) তবে কি এই সকল আয়াতের অর্থ এই যে, ভীতি প্রদর্শন ছাড়া রাসূলের দায়িত্ব ও কর্তব্য রিসালত ও খোশ-খবরী শোনানো নয়? তিনি শুধুমাত্র ভয় প্রদর্শনকারী, শুভ সংবাদ দানকারী নন? আসল কথা হচ্ছে এই যে, এই শ্রেণীর আয়াতসমূহ “আমাদের রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু পয়গাম পৌঁছে দেয়া” (সূরা মায়িদাহ ঃ রুকু-১২) এর অর্থ এই নয় যে, তিনি শুধু কেবল পয়গাম পৌঁছানোওয়ালা ও কাসেদ। সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাকারী নন।
মূলত রাসূলের দায়িত্ব আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দেয়া। জবরদস্তির দ্বারা মানুষের মনে এই পয়গামকে বসিয়ে দেয়া নয়, বড় বড় লোকদের মুসলমান বানানো নয়, জবরদস্তি অর্থ-কড়ি আদায় করা নয়। তাছাড়া পয়গাম পৌঁছে দেয়ার পর কুফুর ও অস্বীকৃতি এবং ঈমান না আনার জিম্মাদারীও তাঁর উপর বর্তায় না।
সুতরাং আল-কুরআনের যে সকল স্থানে এই আয়াতসমূহ সংস্থাপিত হয়েছে এগুলোর উদ্দেশ্য ও মর্ম একই। কুরআনুল কারীমের তেরটি আয়াতে এই অর্থবোধক নির্দেশ এসেছে। এবং এগুলোর অর্থও তা-ই। ইরশাদ হচ্ছে, “আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও নিরক্ষরদেরকে বল, তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ? যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে নিশ্চয়ই তারা পথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তোমার কর্তব্য হচ্ছে শুধু প্রচার করা। আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।” (সূরা আলে ইমরান ঃ রুকু-২) এতে স্পষ্টত বুঝা যায় যে, ইসলামের হেদায়েত কবুল করার মাঝে কোন জবরদস্তি নেই। যদি মানুষ তা কবুল করে তাহলে তারা সুপথ লাভ করবে। আর যদি অস্বীকার করে তাহলে রাসূলের কাজ হচ্ছে শুধু পয়গাম পৌঁছে দেয়া। যেহেতু তিনি তা পৌঁছে দিয়েছেন, তাই তার দায়িত্ব আদায় হয়ে গেছে। এখন আল্লাহই জানেন, অবিশ্বাসীদের পরিণাম কি হবে।
অপর এক আয়াতে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সুতরাং তোমার দায়িত্ব হচ্ছে শুধু পয়গাম পৌঁছে দেয়া এবং আমার কর্তব্য হচ্ছে তার হিসাব গ্রহণ করা।” (সূরা রা’য়াদ ঃ রুকু-৬) এর বিস্তৃত বিশ্লেষণ সূরা গাশিয়াতে এসেছে। ইরশাদ হচ্ছে, “সুতরাং’ তুমি উপদেশ দাও, তুমি তো একজন উপদেশদাতা মাত্র। তুমি তাদের কর্ম নিয়ন্ত্রক নও। তবে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে এবং কুফুরী করলে আল্লাহপাক তাকে মহাশাস্তি দিবেন। তাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট। তারপর তাদের হিসাব-নিকাশ আমারই কাজ।” (সূরা গাশিয়া ঃ রুকু-১১)
একই অর্থ শু’রা-তেও তুলে ধরা হয়েছে যে, রাসূলের কাজ হচ্ছে শুধু বুঝানো, প্রচার করা। তাকে ফরমানদাতা, সুলতান, দারোগা বানিয়ে প্রেরণ করা হয়নি যে জবরদস্তি মানুষের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করবে। ইরশাদ হচ্ছে, “তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তোমাকে তো আমি তাদের রক্ষক করে পাঠাইনি। তোমার কাজ শুধু প্রচার করে যাওয়া।” (সূরা শু’য়ারা ঃ রুকু-৫)
কাফেররা যখনই রাসূলদের মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে তখন রাসূলগণ এ কথাই বলেছেন যে, আমাদের কাজ হচ্ছে পয়গাম পৌঁছে দেয়া। মানা-নামানা তোমাদের এখতিয়ার। ইরশাদ হচ্ছে, “তারা বললো, তোমরা তো আমাদের মত মানুষ; দয়াময় আল্লাহপাক কিছুই অবতীর্ণ করেননি। তোমরা কেবল মিথ্যাই বলছ। তারা বলল, আমাদের প্রতিপালক জানেন, আমরা তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি। আর স্পষ্টভাবে প্রচার করাই আমাদের দায়িত্ব।” (সূরা ইয়াসীন ঃ রুকু-২)
স্বয়ং আল্লাহপাক ও রাসূলদের সান্ত¡না দিয়েছেন যে, অবিশ্বাসীদের অস্বীকৃতির দ্বারা অন্তর মুষড়ে ফেলো না। পূর্বতন পয়গাম্বরগণ এমনই করেছিল। পয়গাম্বরদের কাজ মানুষকে মানানো নয় বরং তাদের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দেয়া। ইরশাদ হচ্ছে, “অংশীবাদীরা বলবে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমাদের পিতৃপুরুষেরা ও আমরা তাকে ছাড়া অপর কিছুর ইবাদতও করতাম না এবং তার অনুজ্ঞা ছাড়া আমরা কোন কিছু নিষিদ্ধ করতাম না। তাদের পূর্ববর্তীরা এরূপ করত। রাসূলদের কর্তব্য শুধু সুস্পষ্ট বাণী প্রচার করা।” (সূরা নহল ঃ রুকু-৫)
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, “যদি তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে (এতে কি হবে?) তাহলে তোমার পূর্ববর্তী কাওমের লোকেরাও মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। আল্লাহর রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া।” (আনকাবুত ঃ রুকু-২)
বস্তুত রাসূলের কাজ পৌঁছে দেয়া। বাকি আলিমুল গায়েব আল্লাহপাক যা চান তা-ই করবেন। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু পৌঁছে দেয়া এবং আল্লাহপাক জানেন যা তোমরা প্রকাশ কর এবং গোপন কর।” (সূরা মায়িদাহ ঃ রুকু-১২) একই অর্থবোধক আল-কুরআনের অন্যান্য আয়াতগুলো হচ্ছে এই ঃ “তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং সতর্ক হও। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে জেনে রেখ যে, সুস্পষ্ট প্রচারই আমার রাসূলের কর্তব্য।” (সূরা মায়িদাহ ঃ রুকু-১২)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর তারপর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে তার উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী এবং তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎপথ পাবে; রাসূলের কাজ হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া।” (সূরা নূর ঃ রুকু-৭) সূরা নহলে ঘোষণা করা হয়েছে, “এভাবেই তিনি তোমাদের প্রতি তার অনুগ্রহ পূর্ণ করেন যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ কর। তারপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার কর্তব্য হচ্ছে কেবল স্পষ্টভাবে বাণী পৌঁছে দেয়া।” (সূরা নহল ঃ রুকু-১১) সূরা তাগাবুনে ঘোষণা করা হয়েছে, “আর আল্লাহর আনুগত্য কর, যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমার রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া।” (সূরা তাবাবুন ঃ রুকু-২) আর পয়গাম্বরদের কথা হচ্ছে এই যে, সুতরাং যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে আমাকে যে পয়গামসহ তোমাদের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল আমি তা তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।” (সূরা হুদ ঃ রুকু-৫)
উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের সম্পর্ক হচ্ছে, নবুওত অস্বীকারকারীদের সাথে। এক্ষেত্রে একথাও লক্ষণীয় যে, যারা শুধু কেবল নবুওতের অস্বীকারকারী তাদের প্রতি রাসূলের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু তাবলিগ, নসীহত, সতর্কীকরণ ও বুঝানো। কিন্তু যে সকল সৌভাগ্যবান নবুওতের স্বীকৃতি প্রদান করেছে, তাদের সাথে রাসূলের অনুসরণ ও আনুগত্যসুলভ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর রাসূল তাদের শুধু তাবলিগই করেননি বরং আদেশ-নিষেধও করেন। কোন প্রশাসন ভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দাদের জবরদস্তি প্রজা বানায় না। কিন্তু কোন লোক যদি স্বেচ্ছায় প্রশাসনের প্রজা বনে যায় তাহলে তাকে এর আইন-কানুন পালনে বাধ্য করা হয়। সুতরাং প্রজা হওয়ার অর্থই হচ্ছে সেই প্রশাসনের বিধি-বিধান মেনে নেয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন