বিশেষ সংবাদদাতা : মাদক ব্যবসায়ীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে রাজধানীর কদমতলী ও শ্যামপুর থানা এলাকা। মাদক ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জের ধরে বিগত তিন বছরে আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১১ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তও হয়নি। মাদক ব্যবসার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ঘটছে ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাÐ। দিন-রাত সচল এখানকার শতাধিক মাদক স্পট এখন মাদক বিক্রেতা, সেবী, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্বেগের শেষ নেই।
সরেজমিনে কদমতলী ও শ্যামপুর থানার বুড়িগঙ্গা সেতুপাড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা চলছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এনে বুড়িগঙ্গা নদীসংলগ্ন পার্কে প্রবেশ করছে শুধু মাদক কেনার জন্য। আলাপকালে কয়েকজন মাদকসেবী জানায়, বুড়িগঙ্গার পাশে ইকোপার্ক এলাকায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক পাওয়া যায়। শুধু কেনার জন্য নয়, মাদক সেবনের জন্য নিরাপদ ও নিরিবিলি পরিবেশ আছে। অনেকে সে কারণেও আসে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু কদমতলী থানা এলাকাতে মাদকের চিহ্নিত স্পট আছে শতাধিক। শ্যামপুরে আছে প্রায় অর্ধশত। এর মধ্যে পাইকারি স্পট আছে কমপক্ষে ৪৫টি। সবচেয়ে বেশি মাদক বেচাকেনা হয় শ্যামপুর বটতলার বিল্লালের স্পটে। সেখান থেকে অন্য স্পটগুলোতে মাদক সরবরাহ করা হয়। বিল্লালের নেতৃত্বে শ্যামপুর বড়ইতলা নতুন রাস্তার মাথার বস্তিতে গড়ে উঠেছে আরও একটি বিশাল স্পট। এটি নিয়ন্ত্রণ করে লিটন, জালাল, বন্দুক সেলিম ও ফারুক। কমিশনার রোড চেয়ারম্যানবাড়ি, কলেজ রোড এলাকার রহমতবাগ, নবীনবাগে আছে সুমন ও গনির মাদক স্পট। ঢালির তত্বাবধানে কলাপট্টির ৪টি স্পট চালায় আবু ও চানু। জুরাইন আলমবাগের আউয়ালের বাড়ির প্যাথেডিনের মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করে ভবন মালিক খোদ আউয়াল। পূর্ব জুরাইন এক নম্বর সড়কের কানা জব্বারের বাড়ি এখন কদমতলীর বৃহৎ ইয়াবা স্পট। নিয়ন্ত্রণ করে ইয়াবা বাপ্পা ও জাহাঙ্গীর। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্যামপুর শিল্প এলাকার স্পট চলে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের দুই নেতার প্রত্যক্ষ মদদে। নামা শ্যামপুর রেললাইনসংলগ্ন আকমল শাহ মাজারের আশপাশে ও ওয়াসার বড়ইতলার হাড্ডি কারখানা এলাকায় রয়েছে বিল্লাল, লিটন, বন্দুক সেলিম, ফালান ও পারুলির বিশেষ বাহিনী। এই বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে আশপাশের ১৫টি মাদক স্পট। মুরাদপুরের গিয়াসউদ্দিন গেসু, সুমন, মামুন, রাজন, বাহার, মোশারফ, খোকার মাদক স্পট পরিণত হয়েছে বখাটেদের আখড়ায়। চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকার ১২টি স্পট চালায় আবু, আমির ও কাউসার। নবীনবাগ এলাকায় এসপির বাড়ির সামনে ৩টি স্পটের মালিক স্বপন, চানু, খোকা ওরফে গোপাল, নজু ও রিপন। পাটেরবাগ খালপাড় ইটালি মার্কেটের পাশের ৮টি স্পট চালায় জামাল, মানিক, সুমন ও ফিরোজ। মুরাদপুরের গীত সংগীত সিনেমা হলের পেছনে, ডিপটির গলিসহ কয়েকটি মাদক স্পট চলে চোরা বাবুল, শহীদ, খবুর, সুজন, পিচ্চি সুমনের নামে। বউবাজার রেল লাইনের ওপর ও পাবলিক টয়লেট সংলগ্ন ৪টি স্পটসহ কয়েকটি স্পট চালায় ফর্সা রশিদের শ্যালিকা ও টাকলু রশিদ। লাকুর ক্যারামবোডের দোকানের সাথেই রয়েছে শামিমের হেরোইন স্পট। ডিপটি গলির বড় মাদক স্পট নিয়ন্ত্রণ করে চাকমা মামুন, পাপ্পু, জাভেদ, সোহেল, সান্টু, পিন্টু ও বাপ্পি। মুরাদপুরে শাহেদ ও বাগানবাড়ির মিন্টুর স্পটে দিন-রাত বিক্রি হয় ইয়াবা। বিড়ি ফ্যাক্টরি, খালপাড়, নোয়াখালীপাড়া, মেডিক্যাল রোড, রুটি ফ্যাক্টরির গলিতে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হয়। দনিয়ার গোয়ালবাড়ি মোড়ে কোকিলার ভাগ্নে নাঈমের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে ইয়াবার সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট শনিরআখড়া, দনিয়া বর্ণমালা স্কুল রোড, দনিয়া বাজার, সোয়াশের গলিসহ আদর্শ স্কুলের আশপাশের এলাকায় প্রকাশ্যে ইয়াবা বিক্রি করে। এছাড়াও কদমতলী এলাকায় ফারুক, রোলেক্স, মাঝি-সুজন, ফালান, টুপি সুমন, বিধান, ভেলু রিপন, মুরাদ, সাইফুল, ট্যাপলা আলম, জাকির, মনা, লম্বা সাগর, আদম, রাসেল, ডেউয়া সুমন, মুরাদপুরে কাউয়া রাজন, বদনা রনি, জিতু, রানা, বার রুবেল ও হানিফের স্পট র্যাব-পুলিশের তালিকায় রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মূলত মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে অন্যসব অপরাধের বিস্তার ঘটছে কদমতলী ও শ্যামপুর থানা এলাকায়। পুলিশের সোর্সরাই এসব মাদক ব্যবসার সাথে বেশি জড়িত। একইভাবে ওই সব সোর্সকে ব্যবহার করে পুলিশের দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, মাদক ব্যবসার পাশাপাশি কদমতলী এলাকায় জুয়ার আসরও বসে নিয়মিত। সেখান থেকেও পুলিশ মোটা অংকের মাসোহারা পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া স্পটগুলো থেকে সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে মোটা অঙ্কের চাঁদার ভাগ পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট জোনের কতিপয় কর্মকর্তা। মাদক ব্যবসার টাকার ভাগ যায় ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার পকেটেও। জানতে চাইলে কদমতলী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, আমি এই থানায় আসার পর মাদক ব্যবসা নির্মুলের জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এলাকাভিত্তিক মিটিং করে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছি। মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা এবং স্থান (স্পট) ধরে ধরে অভিযান চালিয়েছি। তিনি বলেন, শতভাগ নির্মূল না হলেও আমার থানা এলাকায় মাদকের প্রকোপ অনেকটাই কমেছে। এখন কেউ বলতে পারবে না ওমুক স্পট থেকে পুলিশ টাকা নেয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন