ভারতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও স¤প্রদায়ের পার্থক্যের কারণে মানুষের উপর হামলা হয় মূলত তখন, যখন হামলাকারী মনে করে যে রাষ্ট্রীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থেকে রক্ষার জন্য তার পেছনে রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। এ অভিমত অপরাধ আইন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের। তারা বলেন, যে সব রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় অপরাধ সঙ্ঘটিত হচ্ছে, তাদেরকে অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে। অপরাধ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ মান্দের বলেন, মনে হচ্ছে ঘৃণা ছড়ানো বক্তৃতাবাজি আর ঘৃণা নিয়ে অপরাধ করার জন্য যেন একটা অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে হত্যা, ঘৃণা থেকে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ, ধর্মীয় উপাসনালয়- বিশেষ করে খ্রিস্টান ধর্মীয় উপাসনালয়ে পাদ্রী ও নানদের উপর হামলা, আর দলিত শ্রেণীর উপর হামলা (যেটা বহুকাল ধরে চলে আসছে)। তবে বিশেষভাবে বলতে হবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হামলার কথা, কারণ বিদায়ী বছরে মুসলিমদের উপর হামলা আর এর হিংস্রতা আরো বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বন্ধ করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রকে তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় হতে হবে। তাদেরকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, এ ধরনের যে কোন উসকানি অথবা সন্দেহজনক কর্মকাÐের বিচার হবে বিচারিক আদালতে, জনতার আদালতে নয়। গত বছর সংঘটিত ঘৃণা-সন্ত্রাসের ঘটনাগুলোর দিকে ধারাবাহিকভাবে তাকালে বোঝা যায় যে, এর মাত্রা ও ভয়াবহতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ২০১৭ সালের চারটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হলো। ২০১৭ সালের পহেলা এপ্রিল বিকাল ৬টায় রাজস্থানের জয়পুর থেকে দুইটি দুধেল গাভী কিনে ফেরার পথে গো-রক্ষা আন্দোলনকারীদের হামলার শিকার হন ছয়জনের একটি দল। এই গো-রক্ষকরা বাজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সমর্থনপুষ্ট। গাভী কেনার বৈধ কাগজপত্র দেখানোর পরও হামলার শিকার হন তারা। গো-রক্ষকরা তাদের নাম জিজ্ঞাসা করে এবং অরুণ নামে এক ড্রাইভারকে ছেড়ে দেয়। বাকি পাঁচজনকে তারা পিটিয়ে আহত করে এবং তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। এদের মধ্যে পেহলু খান (৫৫) আলওয়ার জেলার একটা হাসপাতালে দুই দিন পর মারা যান। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে, রাজস্থান পুলিশ ছয়জনকে গ্রেফতার করে, যাদেরকে মৃত্যুর আগে সনাক্ত করে যান পেহলু খান। কিন্তু এরা কেউই হামলার সময় উপস্থিত ছিল না- এমন দাবি করে তাদের গত সেপ্টেম্বরে ছেড়ে দেয় পুলিশ। এর পর থেকে এ ঘটনায় জড়িত আর কেউ গ্রেফতার হয়নি। ঈদের তিন দিন আগে, দিল্লী জামে মসজিদে নামাজ পড়তে এবং নতুন কাপড় কিনতে ভাইয়ের সাথে ফরিদাবাদ থেকে দিল্লী যায় ১৬ বছর বয়সী জুনায়েদ খান। সূর্যাস্তের আগেই বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। ফেরার পথে, মথুরা-মুখী জনাকীর্ণ ট্রেনে সিট নিয়ে বাক-বিতÐার এক পর্যায়ে জুনায়েদকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। হামলাকারীরা ট্রেনে উঠেছিল ওখলা থেকে। তারা চারজনকে দেশবিরোধী এবং গো-খেকো বলে গালি দিতে থাকে এবং তাদের সিট ছেড়ে দিতে বলে। তাদের মাথার টুপি খুলে ছুড়ে ফেলে দেয় তারা। হামলাকারীরা তাদের দাঁড়ি ধরে টানাটানি করে এবং তাদের মোল্লা বলে গালি দেয়। আসাওতি স্টেশনে তাদেরকে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে হামলাকারীরা। সেখানেই ভাই হাশিমের কোলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যায় জুনায়েদ। হাশিম অভিযোগ করে বলে, কোন যাত্রীই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। উল্টা তারা বলেছে যে, এদের শেষ করে দাও। সরকারী সূত্র অনুযায়ী, ঘটনার এক সপ্তাহ পরে হরিয়ানা পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করে। তবে কারোর বিরুদ্ধেই এখনও কোন অভিযোগ আনা হয়নি। ২০১৭ সালে ২৭ আগস্ট নজরুল ইসলাম (২৫), আনোয়ার হোসেন (১৯) এবং হাফিজুল শেখ (১৯) ধুপগুড়ি গবাদিপশু বাজার থেকে গরু নিয়ে কুচবিহারের তুফানগঞ্জের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে জলপাইগুড়ির বড়হালিয়া গ্রামে জনতার আক্রমণের শিকার হন তারা। বাজার থেকে সাতটি গবাদিপশু কিনে ফেরার পথে রাতে তুফানগঞ্জে পথ হারিয়ে ফেলে তারা। সাথে গবাদিপশু দেখে এলাকা পার হওয়ার জন্য তাদের কাছে ৫০ হাজার রুপি দাবি করে স্থানীয় জনতা। কাছে অর্থ নেই জানালে, তাদের উপর হামলা করে স্থানীয়রা। যানবাহনের ড্রাইভার নজরুল পালিয়ে বাঁচলেও পালাতে পারেনি বাকি দুজন। তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয় জনতা। ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর রাজস্থানের রাজাসামান্দে মোহাম্মদ আফরাজুল নামের এক শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা করে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। হত্যার পর ঘাতক শাম্বুলাল রেগার (৩৭) হামলার ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ওই হত্যার ভিডিও ধারণ করেছিল রেগারের ১৪ বছর বয়সী ভাতিজা। আফরাজুল পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে কাজের জন্য রাজস্থান গিয়েছিল। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, লাল জামা, সাদা ট্রাউজার ও সাদা মাফলার পড়া রেগার আফরাজুলের পিছু পিছু বনে প্রবেশ করছে। হঠাৎ মাটি থেকে একটা হাতকুড়াল তুলে আফরাজুলকে আঘাত করে রেগার। সাথে সাথে মাটিতে পড়ে যায় আফরাজুল। রেগার তাকে অব্যাহত কোপাতে থাকে আর প্রাণ বাঁচাতে চিৎকার করতে থাকে আফরাজুল। এক পর্যায়ে আফরাজুল পালানোর চেষ্টা করলেও রেগার তাকে সহজেই ধরে ফেলে এবং আবারও তাকে চূড়ান্তভাবে আঘাত করে। একসময় আফরাজুলের বাঁচার আকুতি থেমে যায়। রেগার তখন ভিডিওকারীর দিকে ফিরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ভাষায় কথা বলে। এরপর সে আবার আফরাজুলের দিকে ফিরে আবার তাকে কুড়াল দিয়ে কোপায় এবং এরপর তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেগারকে ওই দিনই গ্রেফতার করা হলেও, পরে পুলিশ জানায়, অন্য একজনকে হত্যা করতে চেয়েছিল রেগার। কিন্তু ভুলবশত আফরাজুলকে কুপিয়ে হত্যা করে সে। ইন্ডিয়াস্পেন্ডকে মান্দের বলেন, এইসব ঘৃণার মধ্যে হিংস্রতা রয়েছে। একজন অপরিচিত মানুষকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করা দেখলে বোঝা যায় আমরা মুসলিম-বিদ্বেষী ঘৃণার আবহাওয়া তৈরী করেছি। আর যেভাবে এই পরিবেশের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তার দায় দেশের শীর্ষ নেতাদেরকেই নিতে হবে। মান্দের বলেন, যেভাবে ঘাতকরা বা তাদের সহযোগীরা হামলার ঘটনা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা থেকে তিনটি জিনিস বোঝা যায়। প্রথমত, হামলাকারীরা একে একটা বীরত্বের কাজ মনে করছে। দ্বিতীয়ত, হামলাকারীরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে তাদের কিছুই হবে না। কারণ কিছু হওয়ার বিন্দুমাত্র আশঙ্কা থাকলেও তারা এগুলো ভিডিও করতো না। ইন্ডিয়াস্পেন্ড।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন