মরুভূমির মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এক গোয়ালঘরে একটির পর একটি গরু তোলা হচ্ছে মেশিনে দুধ দোহনের জন্য। কিন্তু এক বছর আগেও কাতারে ডেইরি ফার্মের কোন অস্তিত্ব ছিল না। দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য দেশটি সম্পূর্ণ সউদী আরবের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভালো জাতের গাভী আমদানির মাধ্যমে সে চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখন দেশটির বালাদনা ফার্মে দশ হাজার গরু রয়েছে। এক বছর আগে সউদী আরবের নেতৃত্বে গাল্ফ দেশগুলো কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে বয়কটের এক মাস পর কাতার এয়ারওয়েজে করে প্রথম গরুটি আনা হয়েছিল দেশে। সেই বয়কটের কারণে ছোট্ট এ দেশটি সেসময় বেশ বড় সঙ্কটে পড়েছিল শিশুখাদ্য নিয়ে। এরপরই দেশটি সিদ্ধান্ত নেয় স্বনির্ভর হবার।
ফার্মের মালিক পিটার ওয়েল্টেভরেডেন বলছিলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল, এক বছরের মধ্যে আমরা ফ্রেশ দুধে নিজেরা স্বাবলম্বী হব। সবাই বলেছিল এটা হবে না, কিন্তু আমরা করে দেখিয়েছি। বলতে গেলে গাল্ফ দেশগুলোর বয়কটের কারণেই কাতার স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। গত বছর পাঁচই জুন সউদী আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর মিসর কাতারের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং পরিবহন সংযোগ ছিন্ন করে। কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেবার অভিযোগ আনে দেশগুলো। কাতার সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সম্পর্ক ছিন্ন করাকে কাতার নিজের সার্বভৌমত্বের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে। নিজেদের বিপুল খনিজ সম্পদ গ্যাস বিক্রির পয়সা কাজে লাগিয়ে কিভাবে সঙ্কট দূর করা যায়, সে চেষ্টা চালিয়ে যায়। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি বলছেন, যারা অবরোধ দিয়েছে আমাদের ওপর, তারা ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চেয়েছিল। তাদের চেয়ে যারাই আলাদা, তাদেরই সন্ত্রাসী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে তারা।
প্রসঙ্গত, এই সঙ্কটের শুরু হয়েছিল, ২০১৭ সালের ২৪শে মে কাতারের সরকারি বার্তা সংস্থা কিউএনএ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে যাতে বলা হয় কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি ইসলামপন্থী গ্রæপ হামাস, হেজবুল্লাহ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রশংসা করে বক্তব্য দিয়েছেন।এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশিদিন টিকবেন না। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই সঙ্কটের শিকড় আরো গভীরে প্রোথিত।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক অ্যারাবিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আলি শিহাবি জানিয়েছেন, কুড়ি বছর ধরে চাপা থাকা একটি বিষয় এই বিরোধের মূল কারণ। ২০১১ সালে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর প্রকাশিত এক টেপে দেখা যায়, কাতারের কর্তমান আমিরের বাবা সউদী রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। শিহাবি বলছেন, কাতার অন্য আরব দেশগুলোতে থাকা বিদ্রোহীদের অর্থ না দেবার একটি চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয় এবং আল-জাজিরাতে তাদের বক্তব্য প্রচারের সুযোগ করে দেয়। শিহাবি আরো বলেন, এটা অনেকটা ছোট ভাই বড় ভাইদের সঙ্গে লড়তে যাওয়া। সে তো সব সময় উল্টো ফল দেবে, আর সমস্যা বাড়াবে। বর্তমানে চারদিকে স্থলসীমায় অবরোধ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছে কাতার। এরই মধ্যে দেশটি সাতশো কোটি ডলার খরচ করে গাল্ফ উপকূলে নতুন একটি বন্দর খুলেছে। এর মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা কিছুটা হলেও সামাল দিচ্ছে দেশটি। এই বন্দর দিয়ে এখন ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল স্টেডিয়াম বানানোর নির্মাণ সামগ্রী আসছে।
সা¤প্রতিক সময়ে কাতার ইরানের সঙ্গে উপকূলবর্তী একটি সীমান্ত এবং সবচেয়ে বড় গ্যাস ফিল্ডে ভাগাভাগি করছে। কাতারের বিমান এখন ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার করছে। আর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র সউদী আরবকে সমর্থন দিলেও, স¤প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার জন্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর ঐক্যের কথা বলছে। এছাড়া কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় বিমান ঘাঁটি রয়েছে। কিন্তু দেশটির ঐতিহাসিক বাজার সৌক ওয়াকিফে সাধারণ কাতারিরা অপেক্ষা করছে, কবে এই অবরোধ শেষ হবে। একজন বলছিলেন, উপসাগরীয় দেশগুলোর বন্ধন অচ্ছেদ্য। এই ব্যক্তির স্ত্রী সউদী আরবের নাগরিক এবং তার মা রিয়াদে থাকেন। অবরোধের কারণে তিনি পরিবারের সাথে দেখা করতে পারছেন না। তিনি খুবই বিরক্ত। তবে ভিন্নমতও আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছিলেন, তারা আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। সূত্র : বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন