বেইজিংয়ের পশ্চিমমুখী কৌশলী অগ্রযাত্রাকে সুসংহত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ বাড়াচ্ছে চীন। তাছাড়া পশ্চিমাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের ক্রমবর্ধমান অনাগ্রহেরও সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে চীন। সেই সাথে মিয়ানমার নিজেই সতর্কতার সাথে নতুন যে ‘লুক ইস্ট’ নীতি ও কৌশলগত ভিশন গ্রহণ করেছে, সে সুযোগটাও পাচ্ছে চীন।
রাজধানী নেপিদোতে চীনের উচ্চ পর্যায়ের সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাদের ধারাবাহিক সফর চলছে – সবারই উদ্দেশ্য একই – মিয়ানমার সরকারকে চীনের আঞ্চলিক ভিশনের ব্যাপারে পুরোপুরি পক্ষে নেয়া। ভিশনটা হলো চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট যেটা বর্তমানে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা নতুন ‘সিল্ক রোড’ হিসেবে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরে একটা বিতর্কিত গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ব্যাপারে একটি চুক্তি করেছে মিয়ানমার ও চীন। এর মাধ্যমে বেইজিং ভারত মহাসাগরে প্রবেশে তাদের কৌশলগত পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে পারবে। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়ার লক্ষণ এটা, মিয়ানমারকে যেটা শক্তভাবে চীনা বলয়ে ঠেলে দিচ্ছে।
মিয়ানমারের দিক থেকে এটা তাদের স্ট্র্যাটেজিক দূরদৃষ্টির সাথে মানানসই এবং তাদের ‘লুক ইস্ট’ নীতির অনুকূলে। কিন্তু চীনের বহির্মুখী সম্প্রসারণের মানচিত্রের এক টুকরা জিগস’ মেলাতেও সাহায্য করছে এটা, এখন যেটা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামে পরিচিত। পরিকল্পিত এই বন্দরটি চীনের উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে, এবং স¤প্রতি যে চায়না-মিয়ানমারে ইকোনমিক করিডোর (সিএমইসি) উন্নয়নের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে, তার একটি অংশ। এই প্রকল্প বন্দরকে মিয়ানমারের অন্যান্য বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর সাথে যুক্ত করবে।
বন্দর প্রকল্পের প্রথম ধাপের সাথে যে কিয়াউকফু ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি রয়েছে, সেটাও বিশেষ অর্থনৈতিক জোন পরিকল্পনার অংশ। গত মাসে মিয়ানমারের ডেপুটি পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী সেত অং এবং বেইজিং-ভিত্তিক সিআইটিআইসি গ্রুপের চেয়ারম্যান চ্যাং ঝেনমিং এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। অং সান সু কি’র প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সিন টার্নেল সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, “এই প্রকল্প মিয়ানমারের উপকার করবে, এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখবে, কারণ এখন চুক্তির বিষয়গুলো মিয়ানমারের স্বার্থের অনুকূলে সংশোধন করা হয়েছে”। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে প্রকাশ্যে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, যদিও সরকারের মধ্যে আরও অনেকেই তার উদ্বেগের সাথে একমত ছিল।
পরে সেত অংয়ের নেতৃত্বে কিয়াউকফিউ স্পেশাল ইকোনমিক জোন ডিপ সি পোর্ট প্রকল্প নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক মাস ধরে কঠিন দর কষাকষির পর চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রায় দশ বছর ধরে এই প্রকল্প নিয়ে কাজ চলছে। কিন্তু অং সান সু কি নাটকীয়ভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রকল্পের শর্তাদি মিয়ানমারের পক্ষে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেন যাতে সরকার ঋণে জর্জরিত না হয়ে ‘সাদা হাতি’ না হয়ে পড়ে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে দর কষাকষি থমকে যায় বলে জানান, দর কষাকষিতে জড়িত সরকারের একটি সিনিয়র সূত্র। মিয়ানমার সরকার পুরো এশিয়া জুড়েই এই ধরনের প্রকল্পের ভাগ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে – বিশেষ করে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিষয় নিয়ে। চলতি বছরের শুরুর দিকে, কলম্বো আর্থিক সমস্যায় পড়ে যখন তারা হামবানতোতা বন্দর নির্মাণের জন্য বিলিয়ন ডলার ঋণ করেছিল। ফলস্বরূপ ঋণ পরিশোধের অংশ হিসেবে তারা বন্দরের পরিচালনা কার্যক্রম ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম এরপর কিয়াউকফিউ বন্দর প্রকল্পটি সতর্কভাবে পর্যালোচনা করে এবং চীনের সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে জানায় যে, তারা এ পর্যায়ে শুধুমাত্র ছোট প্রকল্প ও বাজেট নিয়ে বিবেচনা করবে।
প্রেসিডেন্ট থিন সিনের নেতৃত্বাধীন মিয়ানমারের আধা-সামরিক সরকারকে ২০১৫ সালে গভীর সমুদ্র বন্দর ও অর্থনৈতিক জোন তৈরির ব্যাপারে সিআইটিআইসি অধিকার দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে দরপত্র আহ্বান করা হয় যেখানে পুরো প্রকল্পের খরচ ১০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে রাখা হয়। একই সাথে এ ব্যাপারেও সম্মত হয় যে, প্রকল্পের বন্দর অংশটি ৮৫-১৫ শেয়ারের ভিত্তিতে বিনিয়োগ হবে। ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্টে বন্দর উন্নয়নের ব্যাপারে পরিকল্পনা রাখা হয়, যেটা চার ধাপে বিভক্ত। প্রথম ধাপের ব্যাপারে এখন ঐক্যমত হয়েছে, এর অধীনে দুটি বার্থ নির্মাণ করা হবে। পরের ধাপে উন্নয়নের বাকি অংশগুলো নিয়ে বিবেচনা করা হবে এবং এই কাজ হবে প্রায় দশ বছর পরে। প্রথম ধাপগুলোর অগ্রগতি, এর ব্যবহার ও মুনাফার উপর পরবর্তী উন্নয়ন নির্ভর করছে বলে সরকারের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান। সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন