স্নেহময় বাবা পরম ভালোবাসায় সুন্দর চুল আর নীল চোখের নিষ্পাপ শিশুপুত্রকে বুকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। এ ছবিটি ব্রেনটনের মায়ের প্রিয় স্মৃতিগুলোর একটি। হাওয়াইতে সপরিবারে বেড়াতে গিয়ে তোলা হয়েছিল এ ছবি। শিশু ব্রেনটন ট্যারান্ট-এর জন্মদিনে তোলা।
নিউ সাউথ ওয়েলসের এক মফস্বল শহর গ্রাফটনে বাবা-মা ও বোনের সাথে দিন কেটেছে তার। স্কটিশ, আইরিশ ও ইংরেজ বংশোদ্ভ‚ত শ্রমজীবী শ্রেণির নিম্ন আয়ের একটি পরিবার। সে নিজের পরিচয় দিত সাধারণ শে^তাঙ্গ হিসেবে। সকল অর্থেই তার জীবন ছিল অনুল্লেখ্য। স্থানীয় জিমে ফিটনেস ইন্সট্রাক্টর হতে স্কুল ছাড়ে সে। লেখাপড়া বা আর কিছুতে তার আগ্রহ ছিল না। তার বাবা রডনি ছিলেন একজন অ্যাথলেট। ২০১০ সালে তিনি ক্যান্সারে মারা যান। এর ফলে কিছু সম্পদের মালিক হয় সে। বেরিয়ে পড়ে দুনিয়া ঘুরে দেখতে।
তার মা একজন ইংরেজি শিক্ষিকা। ব্রেনটন বাইরে থাকার সময় তিনি ‘খেয়ালি ছেলে’র অভাব কতটা বোধ করেছেন সে কথা অনলাইনে লিখেছিলেন। বলেছিলেন যে, তার ভ্রমণের আকাক্সক্ষার বিষয়টি তিনি উপলব্ধি করেন। ছেলেকে তিনি মমতাভরে ‘ব্রেন্টো’ বলে ডাকতেন। মনে হয়, মনের দিক দিয়ে ছেলে কতটা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল তা তিনি জানতেন না। ট্যারান্ট ইউরোপের অধিকাংশ দেশ, উত্তর কোরিয়া, ভারত ও জাপান ভ্রমণ করে। গত বছর পাকিস্তান ভ্রমণ করে দেশটিকে অসাধারণ স্থান বলে উল্লেখ করে। পাকিস্তানিদের সে আখ্যায়িত করে বিশে^র অত্যন্ত আন্তরিক, দয়ালু হৃদয় ও আতিথেয়তাকারী মানুষ বলে।
সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকা জানায়, সে অনলাইনে লিখেছিল যে, শরতে হুনজা ও নাগার উপত্যকার সৌন্দর্য অতুলনীয়। বিভিন্ন ঘুরে বেড়ানোর সময় ব্রেনটনের মনের পরিবর্তন ঘটে। এ সময়েই তার মনে সহিংসতার বীজ রোপিত হয়। ২০১৬ ও ২০১৭-তে ইউরোপে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা তাকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে অনলাইনে দেয়া তার অসংলগ্ন ইশতেহারে সে ২০১৭ সালে স্টকহোমে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ৫ জনের মধ্যে ১১ বছরের শিশু এবা আকারল্যান্ডের কথা উল্লেখ করে।
ব্রেনটন তার যে ব্রিটিশ ঐতিহ্যের কথা বলেছে তা জোরালো নয়। কারণ, তার বাবা-মা ও পিতা-পিতামহ অস্ট্রেলিয়ায় জন্মেছেন বলেই ধারণা। তবে তার বোন ব্রিটেনের পোর্টসমাউথের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন।
তার ৫১ বছর বয়স্কা মা এখনো গ্রাফটনেই থাকেন। শুক্রবারের ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করার অনুরোধ করা হলেও তিনি তার জবাব দেননি।
তার বড় ছেলে ক্রাইস্টচার্চে থাকেন। শুক্রবারের হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তিনি দ্রুত হামলার শিকার ব্যক্তিদের আশ্রয়, খাবার ও তারপক্ষে যা কিছু সম্ভব তা করার প্রস্তাব দেন। সে সময় মনে হয় তিনি হামলাকারীর পরিচয় জানতে পারেননি। তিনি অনলাইনে লেখেন, হামলাকারী একজন অস্ট্রেলিয়ান যে সুনির্দিষ্টভাবে এ ঘৃণ্য হামলা চালাতেই এখানে এসেছে। তিনি লেখেন, আমি মসজিদটি চিনি। সব সময় সেখান দিয়ে যাওয়া আসা করি। এটা একটা সর্বদা ব্যস্ত ও সুন্দর জায়গা। আমি এই কান্ডজ্ঞানহীন বর্বরতায় আতঙ্কিত। তার মাও বুঝতে পারেননি যে, এ হামলা ব্রেনটন চালিয়েছে।
ট্যারান্ট তার ১৭ হাজার শব্দের ইশতেহারে তার নিজের দেশকে নিষ্প্রভ ও এক উদাসীন দেশ হিসেবে। সে অনলাইনে নিজেকে বর্ণনা করেছে ভাষায়, সংস্কৃতিতে, রাজনৈতিক বিশ্বাস আর দর্শনে, আত্মপরিচয়ে এবং বংশপরিচয়ে একজন ইউরোপীয় হিসেবে। সে লিখেছে, সবচেয়ে বড় কথা আমার রয়েছে ইউরোপীয় রক্ত। সে অস্ট্রেলিয়াকে ব্রিটিশ কলোনি ও ইউরোপের বর্ধিত অংশ বলে আখ্যায়িত করে। ব্রেনটন নিজেকে বেক্সিট সমর্থক বলে ঘোষণা করে নিজেকে একজন ফ্যাসিস্ট বলে স্বীকার করে বলে, সে অসওয়াল্ড মোসলির একাত্মতা বোধ করে। সে নিজেকে নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে তুলনা করেছে। বলেছে, সে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবার প্রত্যাশা করে।
ব্রেনটন বলে, সে একজন বর্ণবাদী, তবে বিদেশী আতঙ্কগ্রস্ত নয়। সে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন করে বলে, তিনি পুনরুজ্জীবিত শ্বেতাঙ্গ পরিচয় ও অভিন্ন লক্ষ্যের প্রতীক। সে তার উগ্রপন্থার কারণ হিসেবে ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলার উল্লেখ করে বলে, বন্দুকের মালিকানার বিষয়ে সে যুক্তরাষ্ট্রে একটি সমস্যা সৃষ্টির আশা করছে। ২০১১ সালে নরওয়েতে হামলা চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যাকারী চরম দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসী অ্যান্ডার্স ব্রেইভিকের তার সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ ছিল বলে সে দাবি করে।
এদিকে ব্রেইভিকসের আইনজীবী ওয়িস্টেইন স্টরভিক শুক্রবার একটি নরওয়েজীয় পত্রিকাকে বলেন, জেলে থাকা তার মক্কেলের সাথে চারপাশের পৃথিবীর সংযোগ খুবই সীমিত। তাই ট্যারান্টের সাথে তার সংযোগ ছিল বলে মনে হয় না। ব্রেনটনের মা ২০১৩ সালে তার ছেলের নিউজিল্যান্ড ভ্রমণের পর পাঠানো একটি মেসেজের অংশ বিশেষ পোস্ট করেন। সে দেশটিকে প্রকৃতই এক স্বর্গ বলে বর্ণনা করে। কে জানত যে, মাত্র ক’বছর পরই সুন্দর সেই দেশটিকে সে এক নরকে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে? হয়ে উঠবে এক ভয়ঙ্কর ঘাতক?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন