প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ১৮ বছরের ব্যয়বহুল ও প্রাণ সংহারক যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার অংশ হিসেবে আফগানিস্তানে তার কূটনীতিকদের সংখ্যা হ্রাস করার কথা বিবেচনা করছে। মার্কিন কর্মকর্তারা ফরেন পলিসিকে একথা বলেন।
অভ্যন্তরীণ আলোচনার সাথে সম্পৃক্ত ৩ জন মার্কিন কর্মকর্তা জানান, পররাষ্ট্র দফতর ২০২০ সালে কাবুলে মার্কিন কূটনীতিকদের সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশিয়া ও চীনের সাথে ‘পরাশক্তি প্রতিযোগিতা’র যুগে প্রস্তুতির জন্য মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় তার যুদ্ধ পদচিহ্ন হ্রাসের পাশাপাশি ইরাকে মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিকদের সংখ্যা হ্রাসেরও আগাম পরিকল্পনা থাকতে পারে। মার্কিন কর্মকর্তাদের এ আলোচনা তালিবানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি আলোচনা ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার কীভাবে হবে সে বিষয়ক মূল্যায়নের সাথে সম্পর্কিত।
এক সময়ের গুরুত্বহীন বাগদাদ ও কাবুলের মার্কিন ক‚টনৈতিক ফাঁড়িগুলো এ দেশ দুটিতে মার্কিন অগ্রাসনের পর বিশ্বের বৃহত্তম ও ব্যয়বহুল কূটনৈতিক মিশনে পরিণত হয়। কাবুল ও বাগদাদে দূতাবাস কর্মীদের একটি অংশ হচ্ছে কূটনীতিকরা। বাকিরা হচ্ছে অন্যান্য কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর লোকজন, ঠিকাদার ও নিরাপত্তা কর্মীরা।
ফেব্রুয়ারিতে এনপিআর কাবুলের মার্কিন দূতাবাস থেকে ফাঁস হওয়া একটি অভ্যন্তরীণ দলিলের কথা প্রকাশ করে যাতে এই ফাঁড়িকে খুব বেশি বড় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং এর আকারের ব্যাপারে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনার আহবান জানানো হয়েছে। তবে এ দলিলে প্রস্তাবিত কর্তনের মাত্রা উল্লেখ করা হয়নি। আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক বাহিনীর তুলনায় পররাষ্ট্র দফতরের লোকজনের উপস্থিতি স্বল্প, কিন্তু বাগদাদের দূতাবাসসহ কাবুলের দূতাবাস বিশ্বের অন্যান্য দেশে মার্কিন দূতাবাসগুলোর তুলনায় মার্কিন বাজেট ও কর্মচারীদের অযৌক্তিক পরিমাণ ও সংখ্যা সুবিধা পাচ্ছে। কিছু কূটনীতিক মনে করেন এই সম্পদ অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার এখনি সময়।
পররাষ্ট্র দফতরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা নিয়মিত ভাবে আফ্রিকা থেকে শুনছি যে সে মহাদেশে অর্থনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে কর্মরত চীনাদের তুলনায় আমাদের জনশক্তি কম, আনুপাতিক হারে তা ১ঃ ৪-৫। আমরা আফগানিস্তান ও ইরাকে এ ধরনের অর্থ ব্যয় অব্যাহত রাখতে পারি না।
কর্মকর্তা বলেন, প্রধান প্রতিযোগীদের কাছে আরো জায়গা হারানো পরিহার করে আমরা কিভাবে আমাদের সীমিত সম্পদ ব্যবহার করতে পারি সেটাই এখন বিষয়। প্রতিযোগিরা যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে তাদের নাগাল ধরা কঠিন হতে পারে।
দু জন মার্কিন কর্মকর্তা কয়েক মাস ধরে প্রণীত পরিকল্পনার বিশদ জানিয়ে বলেন, পরিকল্পনায় এ বছর ইরাক থেকে ২০ থেকে ৩০ জন ক‚টনৈতিক অবস্থানে থাকা ব্যক্তিকে প্রত্যাহার করা হতে পারে। ইরাকে বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ও এরবিলে একটি কনস্যুলেট রয়েছে। ২০২০ সালে ইরাক মিশনের ক‚টনৈতিক কমী সংখ্যা ৩০-৫০ শতাংশ কর্তন করা হতে পারে
ফেব্রুয়ারি মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমসে এ পরিকল্পনার কিছুটা উল্লেখ করে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় যে বাগদাদ দূতাবাসে প্রায় ১৬ হাজার কর্মচারী রয়েছে। তাদের মধ্যে ২ হাজার হল কূটনীতিক।
পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র জানান, নিরাপত্তার কারণে পররাষ্ট্র দফতর দূতাবাস বা কনস্যুলেটগুলোতে কর্মরত লোকেদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ্যে আলোচনা করেনা।
আফগান ও ইরাক দূতাবাসে প্রস্তাবিত ক‚টনীতিক সংখ্যা হ্রাস বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র ইমেইলে জানান যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নীতিগত লক্ষ্যের প্রেক্ষিতে বিদেশী মিশনগুলোতে আমাদের কর্মীসংখ্যা নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। আমরা তাদের সংখ্য প্রকাশ না করলেও দূতাবাস কর্মকর্তারা তারা প্রয়োজনানুগ সংখ্যায় আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত পর্যালেচনা করেন।
মুখপাত্র বলেন, আমরা ইরাককে পরিত্যাগ করছি না। বাগদাদে দূতাবাস ও এরবিলে কনস্যুলেট তাদের কঠিন দায়িত্ব পালন করে যাওয়া অব্যাহত রাখবে।
সাবেক পেশাদার ক‚টনীতিক ও জর্জ ডব্লিউ. বুশের আমলে আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ দূত, বর্তমানে র্যান্ডস কর্পোরেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট জেমস ডবিনস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি তালিবানের সাথে শান্তি আলোচনায় এগোতে পারে তাহলেই আফগানিস্তান থেকে কূটনীতিক সংখ্যা হ্রাস অর্থপূর্ণ হবে।
তিনি বলেন, ট্রাম্পের প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদ তালিবানের সাথে শান্তি আলোচনায় স্থায়ী চুক্তি করতে সক্ষম হবেন কিনা তার উপর আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা বিপুল ভাবে নির্ভর করে। আমি সব সময়ই মনে করি যে একটি শান্তি চুক্তির চেষ্টা দীর্ঘ ব্যাপার। আপনি চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু নির্ভর করতে পারেন না।
পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেন, প্রেসিডেন্ট সুস্পষ্ট করেছেন যে আফগানিস্তানে একটি টেকসই শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর ও সন্ত্রাসবাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ করাই তার অগ্রাধিকার। কাবুল দূতাবাসের কর্মচারী সংখ্যার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকারের বিষয়টিরই প্রতিফলন ঘটবে।
অন্য কর্মকর্তারা ক‚টনীতিক প্রত্যাহার একটি ভ্রান্তিকর বিষয় হবে বলে আশঙ্কা করছেন। শান্তি আলোচনা এখনো শেষ হয়নি, আফগানিস্তানে বহু এলাকা এখনো সহিংসা কবলিত এবং তালিবান ক্রমবর্ধমান ভাবে সরকারের কাছ থেকে অধিকতর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। তারা বলেন, কূটনীতিকরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন যা সামরিক বাহিনীর আয়ত্তের বাইরে।
জাতিসংঘের মতে, ২০০৯ সাল থেকে তারা আফগানিস্তানে নিহতের সংখ্যার তথ্য সংগ্রহ শুরু করার পর গত বছর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। আফগানিস্তানের জাতিসংঘ মিশন জানায়, ২০১৮ সালে সেখানে ৩,৮০৪ জন নিহত ও ৭,১৮৯ জন আহত হয়েছে।
ওয়াশিংটন ও কাবুলের মধ্যে এক অস্বাভাবিক বিতর্ক তালিবানের সাথে মন্থরগতি আলোচনায় জটিলতা সৃষ্টি করেছে। একজন উর্ধতন আফগান কর্মকর্তা খলিলজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে তিনি বর্তমান আফগান সরকারকে সরিয়ে ঔপনিবেশিক আমল মার্কা সরকার প্রতিষ্ঠা ও তালিবানের সাথে আলোচনায় আফগানদের বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র করছেন। যুক্তরাষ্ট্র এ অভিযোগ নাকচ করেছে।
আফগানিস্তানে মার্কিন দূতাবাস প্রচলিত দূতাবাসের মত নয়। বাগদাদের মত এটিও বিশাল ও বিপুলভাবে স্বয়ং সম্পূর্ণ। সেখানে রয়েছে হাজার হাজার কর্মী, ঠিকাদার ও স্থানীয় কর্মচারী। দূতাবাসের আকার হ্রাসের সাথে সাথে লজিস্টিক্যাল সমস্যা ও নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
আগে আফগানিস্তানে কাজ করেছেন ও বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপে কর্মরত সাবেক মার্কিন কূটনীতিক লরেল মিলার বলেন, আপনাকে চিন্তা করতে হবে যে আফগান দূতাবাস এমন স্থান নয় যে মানুষ শুধু সেখানে কাজ করতে যায়। বরং এটা একটা কলেজ ক্যাম্পাসের মত।
২০১৮ সালে পরস্পর বিরোধী খবর ছড়িয়েছিল যে ট্রাম্প পেন্টাগণকে আফগানিস্তানে সৈন্য সংখ্যা ১৪ হাজার থেকে হ্রাস করে ৭ হাজারে আনতে বলেছেন। ট্রাম্পের সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পাশাপাশি এ পরিকল্পনার কথা জানানো হয় যা মার্কিন আইন প্রণেতাদের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তার পরিণতিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস ম্যাটিস পদত্যাগ করেন।
পরে হোয়াইট হাউস আফগানিস্তানে সৈন্য হ্রাসের পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে। সিরিয়া সিদ্ধান্ত থেকেও পিছিয়ে আসে। তবে ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে চূড়ান্ত ভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের তার নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করতে আগ্রহী বলেই মনে হয়।
আফগানিস্তানে বর্তমানে মার্কিন ১৪ হাজার সৈন্যের পাশাপাশি ন্যাটোর রেজোলিউট সাপোর্ট মিশনের অধীনে ন্যাটো ও মিত্র দেশগুলোর আরো প্রায় ৮ হাজার সৈন্য অবস্থান করছে। তারা আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা পরামর্শ প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী আফগান যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ২,৩০০ আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়েছে।
কিছু বিশেষজ্ঞ আফগান দূতাবাসে কূটনীতিক সংখ্যা হ্রাসের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন যে এর ফলে কোনো বড় রকম প্রভাব পড়বে কিনা, বিশেষ করে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে কাবুলে দূতাবাসের মধ্যে তাদের সীমিত থাকার বিষয় বিবেচনা করে। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এ অঞ্চল বিশেষজ্ঞ সি. ক্রিস্টাইন ফেয়ার বলেন, বহু মার্কিন কূটনীতিক নিকটবর্তী বিমান ঘাঁটি ও ‘আমেরিকা দুর্গ’ নামে আখ্যায়িত মার্কিন দূতাবাসের মধ্যে আসা-যাওয়া করেন। তারা নিরাপত্তা বেষ্টনির বাইরে যান না যা তাদের সাফল্যের সীমাবদ্ধতাকে প্রদর্শন করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন