কূটনৈতিক সংবাদদাতা : চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী চ্যাং ওয়ানকুয়ান তিনদিনের সফরে (২৮-৩০ মে) আজ ঢাকা আসছেন। তার সঙ্গে আসছে ১৫ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক প্রতিনিধি দল। দীর্ঘ আট বছর পর চীনের কোনো প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকের বেইজিং সফরের পরই ঢাকা আসছেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। জেনারেল বেলালের সফরের পর দুইপক্ষই বাংলাদেশ ও চীনের সামরিক বাহিনীর চার দশকের সামরিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেয়ার অঙ্গীকারের কথা জানায়। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানসহ বিভিন্ন দেশের সাথে চীনের বিরোধের সাথে বঙ্গোপসাগর সন্নিহিত বাংলাদেশে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র জানায়, চ্যাং ওয়ানকুয়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা, তিন বাহিনী প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবেন চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এছাড়া বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো ও উন্নয়ন সহযোগিতার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা খাতে কয়েক বছরে বড় ধরনের সহযোগিতা গড়ে উঠছে। দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও উচ্চমাত্রায় নিতেই চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকা আসছেন।
তবে চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি ভারত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা ও বেইজিংয়ের সামরিক সম্পর্ক কতো দূর যাবে, আমরা তা বোঝার চেষ্টা করছি।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জামের সবচেয়ে বড় বিক্রেতা চীন। এছাড়া চীন থেকে মিং ক্লাস সাবমেরিনও কিনছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের শেষভাগে ওই সাবমেরিন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্টকহোমভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের পর থেকে বেইজিং ঢাকার কাছে পাঁচটি মেরিটাইম পেট্রোল ভেসেল, দুটি করভেট, ৪৪টি ট্যাংক, ১৬টি জেট ফাইটার, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে।
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা চীন থেকে বরাবরই উচ্চতর পেশাদারিত্বের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। গত কয়েক বছরে বড় পরিমাণে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম দিয়েছে চীন। গত মার্চে নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হয়েছে দুটি ফ্রিগেট। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক, যুগোপযোগী ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করার উপযোগী করতে চীনের সহযোগিতা বড় ধরনের অবদান রাখছে। কেবল সমরাস্ত্র আমদানি নয়, বাংলাদেশ ও চীনের সামরিক সম্পর্ক এগিয়েছে প্রশিক্ষণ ও সামরিক যোগাযোগের দিক দিয়েও। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের জুন মাসে চীন সফরের পর প্রতিরক্ষা খাতে উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকটি সফর বিনিময় হয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মুহাম্মদ শফিউল হকের গত বছরের ডিসেম্বরে চীন সফরের সময় চীনা সেনাবাহিনী (পিএলএ) ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানও চীন সফর করেন। এর আগে চীনের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান জেনারেল শু কি লিয়াং বাংলাদেশ সফর করেন। তখন দু’দেশের মধ্যে চারটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
জেনারেল বেলালের চীন সফরের সময় ওয়াং আশা প্রকাশ করেন, দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর, সমরতাত্ত্বিক পর্যায়ে যোগাযোগ এবং প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বেলাল সে সময় বলেন, বাংলাদেশ সামরিক প্রশিক্ষণ ও শান্তিরক্ষার বিষয়ে চীনের সঙ্গে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে আগ্রহী।
প্রতিবছর ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যতজন বাংলাদেশ সফরে আসছেন, মোটামুটি সমান সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে চীনও। গতবছর চীনা সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের সময় একটি চুক্তি হয়, যাতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলা হয়।
জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ, চীন ও ভারত- তিন দেশই শীর্ষ দশে রয়েছে। অবশ্য ভারতের উদ্বেগের মূল কারণ চীনের ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের সম্ভাব্য অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার হয়ে সড়ক যোগাযাগ এবং সামুদ্রিক ‘সিল্ক রুট’ পরিকল্পনার আওতায় চীনের বন্দর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা- এই দুই পরিকল্পনাতেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে দিল্লীর উদ্বেগ রয়েছে। দিল্লী মনে করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বাড়বে। এছাড়া চীন থেকে দুটি ডিজেল-ইলেক্ট্রিক সাবমেরিন ক্রয়ের বিষয়েও দিল্লীর উদ্বেগ রয়েছে। ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চীন ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেই বাংলাদেশের জন্য সুবিধা। তবে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে গভীর সুসম্পর্ক রাখতে চায়। সে কারণেই সুদূর চীনের চেয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে বাংলাদেশের ঝুঁকে থাকাটাই দিল্লীর পছন্দ।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশটির সামরিক বাহিনী এখন নজর রাখছে চীন ও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের অগ্রগতির দিকে, বিশেষ করে নৌবাহিনীর বিষয়ে।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের সাবমেরিন বিক্রির পরিকল্পনায় বাংলাদেশে একটি সাবমেরিন ঘাঁটি তৈরির বিষয় থাকতে পারে, যা হয়তো পরে চীনা সাবমেরিনও ব্যবহার করবে; যেমনটি শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের ক্ষেত্রে হয়েছিল।
ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন লিখেছে, ভারত ও চীন- দুইপক্ষের কাছ থেকেই সুবিধা পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। সমুদ্র ও স্থলসীমা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জটিলতার মীমাংসা হয়েছে গত দুই বছরে। এর কারণ হয়তো এই যে, বাংলাদেশ যাতে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে না যায়, তা নিশ্চিত করতে চাইছে ভারত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন