আবদুল আউয়াল ঠাকুর
দেশ যখন গণতন্ত্রহীন, নারী যখন সম্ভ্রব হারাচ্ছে, নির্বিচারে যখন শিশু হত্যা হচ্ছে ঘরে ঘরে, যখন স্বজনদের ফিরে আসার কান্নার আওয়াজ বাড়ছে তখন ভেতর থেকেই উঠে আসছে একজন সফল দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম। প্রতিবছরে মতো এবারেও তার শাহাদতের দিনটি পালিত হচ্ছে নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে । চাঁপা কান্না বুকে ধরে রেখে দেশপ্রেমিক জনগণ সমবেত হবেন তার মাজারে। গত কয়েক বছর ধরেই সরকারের কোন কোন মহলে এক ধরনের বাহানা চলছে জিয়ার মাজার সরিয়ে ফেলার। এখন সর্বশেষ লুইকান্টের ম্যাপের কথা উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, এখানে নাকি সচিবালয় হবে তাই জিয়ার মাজার রাখা যাবে না। এ আলোচনা অনেক দীর্ঘ। আজকে এনিয়ে কথা বলতে চাই না। শুধু এটুকু বলা এ এলাকা তো সেই পাকিস্তান আমল থেকেই সেকেন্ড ক্যাপিটাল বলে পরিচিত। অর্থাৎ সাবেক পাকিস্তান আমলেই এ এলাকাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী করতে চেয়েছিল। সে জন্য যে জায়গা তারা নির্ধারণ করে রেখেছিল তা সেখানেই এখনও রয়েছে। নতুনের মধ্যে সেখানে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র। প্রতিবছর সেখানে হচ্ছে বাণিজ্যিক মেলা। এই এলাকাতেই সেনাসমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল সাব জেল । যেখানে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছিল দেশের দুই শীর্ষ রাজনীতিক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। দেশ থেকে রাজনীতি নির্মূল করতে হয়তো সংসদ ভবন এলাকায় এধরনের কারাগার প্রতিষ্ঠার তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ সংসদ ভবনই যেহেতু রাজনীতির নিয়মক শক্তি তাই প্রধান রাজনীতিকদের সেখানে বন্দি রাখার মধ্য দিয়ে হয়তো সংশ্লিষ্টরা রাজনীতিকেই শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। বাস্তবে তা বুমেরাং হয়েছে। ঐসব কুশীলবদের রাজনীতি ফিরিয়ে দিতে হয়েছে বা তারা বাধ্য হয়েছেন। এখন তাদের অনেককেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন। লুই কান্টের ম্যাপ নিয়ে যারা মতামাতি করে জিয়ার মাজার সরানোর সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন বা একটা খোঁড়া যুক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন তাদের কাছে সবিনয়ে এ প্রশ্ন রাখছি রাজধানী ঢাকা কি কার্যত কোনো ম্যাপের আওতায় রয়েছে? নাকি কোনো ম্যাপ কার্যকর করা যাচ্ছে। যেসব দখলদারদের কারণে রাজধানী আজ বাসের অযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে সংশ্লিষ্টরা কি ম্যাপ ধরে ধরে সেসব জমি উদ্ধার করতে পেরেছেন না পারবেন? ঢাকাকে রক্ষা করা আদৌ কি তাদের পক্ষে সম্ভব? দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এক ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর এক বালক বলছে, ভাগ্য ভালো চোখ দুটো বেঁচে গেছে। মনে হচ্ছে যারা শহর রক্ষা করতে ব্যর্থ অথবা ক্রমাগত গ্রাস করছে তাদের ঠেকাতে না পেরেই যেন হঠাৎ করে সংসদ চত্বরের ম্যাপ অনুযায়ী রক্ষার তৎপরতায় নেমেছেন। এটাকি কোনো আইওয়াশ নাকি নতুন দখলের পাঁয়তারা।
কথাটা একটু পেছন থেকে বলা যাক। হয়তো অনেকেরই মনে আছে, এর আগে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছিল তখন বন্যার কথা বলে ক্রিসেন্ট লেকের ভাসমান সেতুটি সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। যে কথা সেতুটি সরিয়ে নেয়ার জন্য বলা হয়েছিল তা যে সত্যি নয় তা প্রমাণিত হয়েছিল। এরপর বিএনপি জোট ক্ষমতায় এসে এখানে স্থায়ী সেতু তৈরি করেছে। জিয়ার মাজারে মানুষের ভিড় বলে বা লিখে বোঝাবার কোনো প্রয়োজন নেই। কোন পীর মনে করে লোকজন সেখানে যায় না। যায় তাদের অব্যক্ত বেদনা প্রকাশের জন্য। কারণ একজন জিয়াউর রহমান যিনি একটি দেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখাচ্ছিলেন।আন্তর্জাতক অঙ্গনের দুর্নাম ঘুচিয়ে একটি গতিশীল জাতিতে পরিণত করার মন্ত্র শিখিয়েছিলেন। আজকের সময় ও সমাজের মানুষের কাছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। আজ প্রতিদিন যেভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত, লাঞ্ছিত হচ্ছে তখন সঙ্গত বিবেচনাতেই জিয়ার কথা মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধায় ভেসে ওঠার কথা। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পদদলিত করে একদলীয় বাকশালের মাধ্যম্যে গোটা জাতিকে যখন বাকরুদ্ধ করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়া তার বিপরীতে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছিলেন। এখনও দেশে যতটুকু বা নামেমাত্র বহুদলীয় গণতন্ত্র রয়েছে এটা মূলত জিয়ার পুন:প্রবর্তিত বহুদলীয় গণতন্ত্রেরই শেষাবস্থা। চলমান গণতন্ত্রের জনক তিনি। বাক-ব্যক্তি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যখন কেবলই নামেমাত্র অবস্থায় গিয়ে পৌঁচেছে তখনও জিয়া আপন মহিমায় উজ্জল। কারণ তিনি মানুষের কথা বলার অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন, যা বাকশালের মাধ্যমে কেড়ে নেয়া হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজে যেমনি একজন গণতন্ত্র মনষ্ক ছিলেন তেমনি গণতন্ত্রকে তিনি নতুন মাত্রা প্রদান করেছিরেন। তিনি বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্র দেশের স্বাধীনতার রক্ষাকরচ। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকলে কথা বলার অধিকার না থাকলে দেশ রক্ষায় সর্বাত্মক অংশগ্রহণ সম্ভব নয় কেবলমাত্র পেশাদার সেনাবাহিনী বা নিয়মিত বেতনভুগদের দিয়ে প্রকৃতপক্ষে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আর জনগণকে সাথে নিতে হলে তাদের সাথে থাকতে হয়। তাদের আবেক অনুভূতি প্রয়োজন অপ্রয়োজনের কথা অনুভব করতে হয়। সে কারণেই তিনি ক্ষমতাকে নিজের বা পরিবারে শ্রীবৃদ্ধির কোনো কাজে না লাগিয়ে দেশের জনগণের পক্ষে লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অনেকে অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারেন করাটাও হয়তো স্বাভাবিক। প্রকৃত বিবেচনায় এটাই সত্যি দেশের উন্নয়নে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে নানামুখী আলোচনা শোনা যায়। বাস্তবতা হচ্ছে, একধরনের আস্থার সংকট দেশকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ স্থবিরতা নেমে এসেছে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও টান পড়তে শুরু করেছে। এই যে আস্থার সংকটের প্রকৃত মাশুল কিন্তু সেই জনগণকে দিতে হয়। যারা প্রকৃত বিবেচনায় নিজেরাই করে কেটে খায়। চলমান যে সংকট তার উৎপত্তি সরকারের নীতি। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের প্রবণতা থেকে ভারতীদের হীনস্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থ বলী দেয়ার মাশুলই দিচ্ছে জনগণ। যে কোনো ঐতিহাসিক গবেষকই স্বীকার করবেন স্বাধীনতাউত্তোর বাংলাদেশে সর্বপ্রথম প্রেসিডেন্ট জিয়াই বহুুদলীয় গণতন্ত্র এবং সহনশীলতার মডেল স্থাপন করেছিলেন। রাজনৈতিক দল গঠনের বেলাতও যেমনি এর ব্যত্যয় ঘটেনি তেমনি ব্যক্তিগত জীবনেও তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিল না। তার রাজনৈতিক বিরোধীদেরও তিনি যেমনি সম্মান করেছেন তেমনি যারা তাকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করতেন তাদেরকেও তিনি সম্মানের চোখেই দেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রক্ষোভের মুখে পড়ে তিনি ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি বরং বুঝতে ও বোঝাতে চেষ্টা করেছেন মূল পরিস্থিতি। রাজনৈতিক অঙ্গনে জোট থেকে দল করতে গিয়ে যারা তার সাথে থাকেনি তিনি তাদের ব্যাপারে কোনো রূঢ়ভাব প্রদর্শন করেননি বরং এটাই যেন স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছেন। তিনি মুসলিম লীগ, ন্যাপ, তফশিলি ফেডারেশনসহ সকল মত ও পথের নেতাকর্মীদের এক প্লাটফর্মে আনার চেষ্টা করেছিরেনÑযার মূলমন্ত্র ছিল দেশপ্রেম। আজ নানাভাবে এনিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও সরকারের নীতি ও কর্মকৌশলে জাতি যখন বিভাজিত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ তখন অবশ্যই ভাববার রয়েছে কোনটি দেশের জন্য অপরিহার্য ছিল। ঐক্য না বিভাজন। অবশ্যই এখানে দেশচিন্তার বিষয়টি রয়েছে। আজকের দিনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদতবার্ষিকীতেও সেভাবনাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কোন স্বার্থ আগে বিবেচনা করতে হবে নিজের দেশের না দলের। স্বাধীনতার পর তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি এদেশে সত্যিকার অর্থে নারীর জাগরণের বিষষটি অনুভব করেছিলেন। নারীদের কল্যাণে যা কিছু সম্ভব সবকিছুই তিনি করেছেন। শিক্ষা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থানে তিনি নারীদের এগিয়ে আসা তথা পথ চলতে আলোকবর্তিকার ভূমিকা পালন করেছেন। আজকের বাংলাদেশে সরকারি দলের বহূনেতাকর্মীদের হাতে মেয়েদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছে। কার্যত এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। কোনো সমাজে নারী যখন লাঞ্ছিত হয় তখন সেই সমাজকেই বর্বর সমাজ বলা হয়। প্রকাশিত রিপোর্টাদি পর্যালোচনা করলে আইয়ামে জাহেলিয়ার সাথে বর্তমান সময়ের খুব একটা ব্যবধান বোধহয় পাওয়া যাবে না। হয়তো পার্থক্য এটুকু যে সেময়ে মেয়ে শিশুদের জীবিত পুঁতে মেরে ফেলা হতো এখন ধর্ষণের পর পুঁতে ফেলা হচ্ছে। বোধকরি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে যা হচ্ছে তার অন্যকোনো উদাহরণ পাওয়া কষ্টকর। সময়ের বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে নারীরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবলয়ে ছিলেন। সামগ্রিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার যে ভয়াবহচিত্র এখন জনগণ এবং আন্তর্জাতক মহল প্রত্যক্ষ করছে সে বিবেচনায় জিয়া তথা বিএনপির শাসনামল ছিল স্বর্গবাসের শামিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর সেই উত্তাল দিনগুলোতে দিশেহারা জাতি যেমনি মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল তেমনি প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামল এখনও প্রশ্নাতীত বিতর্কের ঊর্ধেŸ রয়েছে। একজন শাসকের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সততা সদিচ্ছা আন্তরিকতা একটি জাতিকে কতটা উপরে নিয়ে যেতে পারে এদেশে তার একমাত্র উদাহরণ প্রেসিডেন্ট জিয়া। ঘাতকের বুলেট চোখের সম্মুখ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারলেও মনের ভেতর থেকে কেড়ে নিতে পারেনি। সে কারণেই আজকে দেশের ও দেশের বাইরে লক্ষ-কোটি জনতা যেভাবে হৃদয়ের গভীর থেকে আন্তরিক অভিবাদন জানাবে এবং গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে সেভাবেই আমরাও বলি চোখের সম্মুখে তুমি নেই, হৃদয়ের গভীরে নিয়েছ যে ঠাঁই। তোমাকে সশ্রদ্ধ অভিবাবদ।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন