এইচএমএস মনট্রোজ হরমুজ প্রণালি দিয়ে যাওয়ার সময় একটি ব্রিটিশ ট্যাংকারকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের জলসীমায় নিজেদের জাহাজ চলাচলের উপর হুমকির মাত্রা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ করেছে যুক্তরাজ্য। বলা হচ্ছে, হামলার হুমকি "গুরুতর" পর্যায়ে রয়েছে। ওই এলাকায় চলমান আঞ্চলিক উত্তেজনার মধ্যেই মঙ্গলবার এই পদক্ষেপ নেয়া হয়। বুধবার, ইরানের কয়েকটি নৌযার ব্রিটিশ একটি তেল ট্যাংকারকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলে ব্রিটিশ রয়্যাল নৌবাহিনীর জাহাজ তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। খবর বিবিসি বাংলা
নিজেদের একটি তেল ট্যাংকার ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়েছিল ইরান। তবে, তারা জাহাজ দখলে নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দেশটির পরিবহন বিভাগ বলছে, উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি রয়েছে এমন এলাকায় সব সময়ই যুক্তরাজ্যের জাহাজগুলোকে নিরাপত্তা নির্দেশনা দিয়েছে তারা।
বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদক জনাথন বিয়াল বলেন, হুমকির মাত্রা বলতে বোঝায়, ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে ইরানের জলসীমায় প্রবেশ করতে বারণ করা হয়েছে। উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে হরমুজ প্রণালির দিকে যাওয়ার সময় ইরানের ইসলামি রেভলিউশনারি গার্ড কর্পসের অধীনে থাকা কয়েকটি নৌযান ব্রিটিশ হেরিটেজ ট্যাংকারের গতিপথ রোধ করার চেষ্টা করে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, এইচএমএস মনট্রোজ নামে ব্রিটিশ রণতরী যেটি কিনা বিপির মালিকানাধীন ট্যাঙ্কারকে নিরাপত্তা দিচ্ছিল সেটিকে ইরানের তিনটি নৌযান ও একটি জাহাজের মাঝখান দিয়ে চলতে বাধ্য করা হয়। ইরানের এই পদক্ষেপকে তিনি "আন্তর্জাতিক আইনের অবমাননা" বলে উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো জানায়, এইচএমএস মনট্রোজের বন্দুকগুলো ইরানের নৌকাগুলোর দিকেই তাক করানো ছিলো। সেসময় তাদেরকে পিছু হঠতে বলা হয়। নৌকাগুলো এই নির্দেশনা মেনে নেয়ার কারণে কোন গোলাগুলি হয়নি।
গত সপ্তাহে, জিব্রাল্টারে একটি ইরানি ট্যাংকারকে আটক করতে সহায়তা করে ব্রিটিশ রয়্যাল মেরিন। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করে, ওই ট্যাংকারে করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরান সিরিয়ায় তেল দেয়ার চেষ্টা করছিল। রয়্যাল জিব্রাল্টার পুলিশের মুখপাত্র বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হচ্ছে এমন সন্দেহে গত বৃহস্পতিবার ইরানের তেলের ট্যাংকারের ক্যাপ্টেন এবং প্রধান কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছেন তারা।
তবে তাদের কারো বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনা হয়নি। চলতি মাসের শুরুতে জিব্রাল্টার প্রণালির কাছে ইরানের গ্রেস ওয়ান তেল ট্যাংকার আটকে সহায়তা করে ব্রিটিশ রয়াল মেরিন বিবিসিকে বলা হয়, ইরানি নৌকাগুলোর কবলে পড়ার সময় ব্রিটিশ হেরিটেজ আবু মুসা দ্বীপের কাছ দিয় যাচ্ছিল।
আবু মুসা বিতর্কিত জলসীমায় হলেও এইচএমএস মনট্রোজ আন্তর্জাতিক জলসীমাতেই ছিল। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেনি মরডন্ট বলেন, সরকার এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজনা কমিয়ে "পরিস্থিতি স্বাভাবিক" করতে ইরানের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট আরও বলেন, এই পরিস্থিতি "খুব সতর্কতা"র সাথে পর্যবেক্ষণ করবে।
এদিকে টেরিজা মের অফিসের দাপ্তরিক মুখপাত্র বলেন, সরকার "আন্তর্জাতিক আইন মেনে নৌ চলাচলের স্বাধীনতা বজায় রাখার প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।" মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র ইরানের এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন এবং বলেছেন, এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সাথে মিলে কাজ করা অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। মরগান অরটাগাস বলেন: "নৌ চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষায় এবং এই গুরুত্বপূর্ণ জলপথে বাণিজ্যের মুক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করায় রয়াল নৌবাহিনীর প্রশংসা করছি আমরা।"
যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম রণতরীর কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল জিম ম্যালয় এই ঘটনাকে "বেআইনি হয়রানি" বলে উল্লেখ করেছেন এবং "বাণিজ্যের মুক্ত প্রবাহ" নিশ্চিত করেত রয়াল নৌবাহিনীর সাথে মিলে কাজ করা চালিয়ে যাবে তারা।
ইরান কি বলছে?
ইরানের সংবাদ সংস্থাগুলো বলছে, দেশটির রেভ্যলিউশনারি গার্ড কর্পসের নৌবাহিনী ট্যাংকার আটক প্রচেষ্টার কথা অস্বীকার করছে। তারা দাবি করে, গত ২৪ ঘণ্টায় বিদেশি কোন জাহাজের সাথে মুখোমুখি হয়নি তাদের। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেন, "উত্তেজনা বাড়াতেই" এই দাবি তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। "এই দাবির কোন মূল্য নেই," সংবাদ সংস্থা ফার নিউজকে মিস্টার জারিফ বলেন।
যুক্তরাজ্য-ইরান উত্তেজনা বাড়ছে কেন?
গত জুন মাসে দুটি তেলের ট্যাংকারের উপর হামলার ঘটনায় ইরান অবশ্যই জড়িত যুক্তরাজ্যের এমন মন্তব্যের পর দেশ দুটির সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। উত্তেজনা বাড়ে যখন জিব্রাল্টার প্রণালিতে ব্রিটিশ রয়্যাল মেরিনদের সহায়তায় ইরানের একটি তেলের ট্যাংকারকে আটক করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার ইরানের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, আটকের ঘটনা "যুক্তরাজ্যের অপ্রয়োজনীয় এবং অগঠনমূলক আচরণ"। একইসাথে তিনি ইরানের তেলের ট্যাংকার গ্রেস ওয়ানকে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানান। এর আগে আরেক ইরানি কর্মকর্তা বলেছিলেন, গ্রেস ওয়ান ছেড়ে না দিলে ব্রিটিশ একটি তেলের ট্যাংকার আটক করা উচিত। বুধবার ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি যুক্তরাজ্যকে রয়্যাল নৌবাহিনীর জাহাজকে আরেকটি জাহাজের নিরাপত্তা দেয়ায় দেশটিকে "ভীত" এবং "আশাহীন" বলে উল্লেখ করেন।
রুহানি বলেন, "তোমরা, ব্রিটেন, নিরাপত্তাহীনতার প্রবর্তক এবং পরে তোমরা এর পরিণতিও দেখতে পাবে।" দ্বিতীয় ধাপের সহায়তা হিসেবে এরইমধ্যে রয়্যাল নৌবাহিনীর একটি মাঝারি রণতরী, চারটি মাইন হান্টার এবং একটি রয়্যাল ফ্লিট বাহরাইনের মিনা সালমানে একটি স্থায়ী নেভাল সাপোর্ট ফ্যাসিলিটিতে নোঙর করেছে।
পুনঃনিশ্চয়তা পেতে এটা যথেষ্ট হলেও সংকট কাটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদক জনাথন বিয়াল।
তার মতে, ওই এলাকায় আরো একটি রয়্যাল নৌ জাহাজ পাঠানোর বিষয়ে ভাবতে হবে মন্ত্রীদের। তবে এমন পদক্ষেপ ওই এলাকায় ইরানের সাথে উত্তেজনা আরে বাড়াবে। পররাষ্ট্র বিভাগ বলছে, ওই এলাকায় যুক্তরাজ্যের সামরিক আচরণ বেশ ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তবে তারা উত্তেজনা বাড়ুক এটা চায় না। বিবিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদক বলেন, ইরানের সাথে কোনভাবেই একটি সম্মুখ সমরে যেতে চায় না সরকার।
কিন্তু তারা এটাও অবহেলা করতে পারে না যে, উপসাগরীয় এলাকায় ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজগুলোর চলাচল বেশ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ জাহাজগুলোর জন্য সতর্কতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে তোলার মানে হচ্ছে আসলে ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে হুঁশিয়ার করা যে তারা যাতে ইরানের জলসীমায় না যায়।
এটা একটু অস্বাভাবিক হলেও একেবারেই নতুন কিছু নয়। সরকারের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের ফল এটি। উপসাগরীয় এলাকায় সীমিত সামরিক সুবিধা নিয়ে, রয়্যাল নৌবাহিনীর পক্ষে ব্রিটিশ জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আসলেই কঠিন।
প্রতিদিন, উপসাগরীয় এলাকায় তেল এবং গ্যাস ট্যাঙ্কারসহ যুক্তরাজ্যের ১৫ থেকে ৩০টি বড় জাহাজ চলাচল করে যার মধ্যে প্রতি এক থেকে তিনটা হরমুজ প্রণালি হয়ে যায়।
উপসাগরীয় এলাকায় নৌ চলাচলে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে একটি জোট গঠনের দিকে ঝুঁকছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এখনো সম্ভাব্য অংশীদারদের আহ্বান জানাতে তেমন কিছু করেনি তারা।
২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান বিতর্ক চলতে থাকায় কিছু কিছু দেশ যারা এরইমধ্যে বাহরাইন ভিত্তিক ৩৩ দেশের সমন্বয়ে গঠিত সমন্বিত সামুদ্রিক বাহিনীর অংশীদার, তারা জোটে যেতে অনাগ্রহী হতে পারেন।
ওই এলাকার জাহাজগুলো কি ইরানের জলসীমা এড়াতে পারবে?
হরমুজ প্রণালি যেটি দিয়ে উপসাগরীয় এলাকায় ঢুকতে হয় সেটি খুবই সংকীর্ণ, মাত্র ২১ নটিক্যাল মাইল বা ৩৯ কিলোমিটার। এটি এর সংকীর্ণতম এলাকায় এতোই ছোট যে মাঝ বরাবর ইরান এবং ওমানের জলসীমা মিলিত হয়, একথা জানিয়েছেন বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদক ফ্র্যাংক গার্ডনার। তাই আন্তর্জাতিক জলসীমা নয় বরং প্রবেশাধিকার পেতে ইরান কিংবা ওমানি সীমার উপর দিয়েই যেতে হয়। সম্প্রতি নিজেদের ভৌগলিক সীমার বাইরে ১২ নটিক্যাল মাইল করে জায়গা বাড়িয়েছে দুই দেশ।
প্রণালী ব্যবহারের অধিকারের ভিত্তিতে এই এলাকা দিয়ে জাহাজগুলো অবাধে চলাচল করছে।এটি জাতিসংঘের প্রস্তাবনার একটি অংশ যা জাহাজগুলোকে জিব্রাল্টার এবং মালাক্কা প্রণালীর মতো বিশ্বের চেকপয়েন্টগুলোতে মুক্ত চলাচলের অধিকার দেয়।
হরমুজ প্রণালীতে জাহাজ চলাচলের দুটি চ্যানেল রয়েছে যেগুলো একটা আরেকটার বিপরীত দিকে এবং প্রতিটি ০২ নটিক্যাল মাইল করে প্রশস্ত। এটাকে বলে ট্রাফিক পৃথকীকরণ সুবিধা। ইরান এবং মার্কিন নৌবাহিনী রণতরীগুলো এসব এলাকায় টহল দেয় এবং বিভিন্ন সময়ে অল্পের জন্য মুখোমুখি অবস্থান এড়িয়ে চলতে পেরেছে তারা।
হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ পার হওয়ার পর উপসাগরীয় এলাকায় পৌঁছালে জাহাজগুলোকে আবু মুসা দ্বীপ এবং গ্রেটার ও লেসার তুনবের প্রতিযোগিতামূলক সীমায় সাবধান থাকতে হয়। এই এলাকা ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত আলাদাভাবে দাবি করলেও এটি পুরোপুরি ইরানি বাহিনীর দখলে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন