হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সাগরের নোনা পানিকে সুপেয় পানিতে পরিণত করার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি শক্তিদক্ষ বা সাশ্রয়ী মূল্যের নয় বলে তা এগোয়নি। তবে কেনিয়াতে গিভপাওয়ার নামে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের নব নির্মিত একটি কারখানা সৌরশক্তি ব্যবহার করে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নেমেছে।
গত বছরের জুলাই থেকে উপক‚লীয় কিয়ুনগা এলাকায় চালু হওয়া এই লবণমুক্তকরণ ব্যবস্থা প্রতিদিন ১৯ হাজার ৮০০ গ্যালন (৭৫ হাজার লিটার) সুপেয় পানি উৎপাদন করতে পারে যা ২৫ হাজার মানুষের জন্য যথেষ্ট। গিভপাওয়ারের প্রেসিডেন্ট হায়েস বার্নার্ড বলেন, আপনাকে সাগর থেকে পরিমাপ করা টেকসই পন্থায় পানি টেনে আনার একটি পথ বের করতে হবে।
বার্নার্ড আশা প্রকাশ করেন যে এ ব্যবস্থাটি উন্নত করার এবং যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য বিশ্বব্যাপী একই ধরনের কারখানা খোলার আশা করেন। ইউনিসেফ ও হু’র মতে, বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মানুষের নিরাপদ খাবার পানিতে প্রবেশাধিকার নেই। ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা পানি সঙ্কটাক্রান্ত এলাকায় বাস করবে। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন, ভারতের চেন্নাই ও চীনের বেইজিংয়ের মত নগরীগুলো ইতোমধ্যেই তীব্র পানি সঙ্কটের সম্মুখীন।
মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ
২০০৬ সালে এলন মাস্কের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত সোলার-প্যানেল কোম্পানি সোলারসিটির অলাভজনক শাখা হিসেবে ২০১৩ সালে গিভপাওয়ার চালু করেন বার্নার্ড। ২০১৬ সালে সোলারসিটি টেসলার সাথে একীভ‚ত হয়। কিন্তু তার স্বল্পকাল আগে বার্নার্ড গিভপাওয়ারকে নিজস্ব সংস্থা হিসেবে পৃথক করে নেন।
অলাভজনক সংস্থা উন্নয়নশীল বিশ্বে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সৌরশক্তি ব্যবস্থা নির্মাণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। গিভপাওয়ার-এর ওয়েবনাইটের তথ্য অনুযায়ী তারা দুই হাজার ৬৫০টি স্থানে সোলার গ্রিড প্রতিষ্ঠা করে। প্রধানত স্কুল মেডিক্যাল ক্লিনিক ও গ্রামগুলোতে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়।
তবে স্কুলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাক আর না থাক, সুপেয় পানির স্বল্পতা বহু মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের তথ্য মতে, আফ্রিকা ও এশিয়ায় নারী ও মেয়ে শিশুরা পানি সংগ্রহের জন্য প্রতিদিনে গড়ে ৩.৭ মাইল হাঁটে। পথের এই দূরত্ব তাদের লেখাপড়ার শক্তি ও সময় কেড়ে নেয়।
বার্নার্ড বলেন, তাই আমরা চিন্তা করলাম যে পরবর্তী কাজ হবে পানিকে তাদের কাছে নিয়ে আসা। এ চিন্তা থেকেই ধারণাটি আসে। আমরা তাদের জন্য অত্যন্ত সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যকর ও টেকসই পানি সরবরাহ করতে পারব? এবং এটা পরিমাণে?
পানি লবণমুক্তকরণ প্রযুক্তি নতুন নয়। কিন্তু তার জন্য উচ্চ-শক্তির পাম্প ব্যবহার ও বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ব্যয় হয় যা খুবই ব্যয়বহুল। গিভপাওয়ার যে সোলার-মাইক্রো গ্রিড ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে তাতে প্রতিদিন ২০ হাজার গ্যালন টাটকা সুপেয় পানি উৎপাদন করা যেতে পারে। এটা নির্ভর করে জ্বালানি মজুদের টেসলা ব্যাটারির উপর। এতে দুটি সমান্তরাল পাম্প ব্যবহার করা হয় যাতে এ ব্যবস্থা সার্বক্ষণিক চালু থাকে। এমনকি একটি পাম্প মেরামত করা হলেও। স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতি এক লিটার পানির জন্য এক সেন্টের এক চতুর্থাংশ দিতে হয়।
বিশ্বের পানি সঙ্কট
সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীদের ধারণা যে উপক‚লীয় এলাকায় নোনা পানি বেশি পরিমাণে সুপেয় পানির উৎসগুলোতে অনুপ্রবেশ করবে। এ পরিস্থিতি কিয়ুনগাতে প্রকল্পিত নয়। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া চলমান খরা অধিবাসীদেরকে লবণাক্ত পানির ক‚প থেকে খাবার পানি খেতে বাধ্য করেছে। যদিও তাতে কিডনি অকেজো হয়ে যেতে পারে।
কিয়ুনগার অধিবাসী মোহাম্মদ আতিক গিভপাওয়ার প্রকল্প সম্পর্কে বলেন, ক‚পের নোনা পানি ব্যবহার করা যায় না। তাতে স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। বার্নার্ড বলেন, এ সব মানুষের জন্য এ এক ভয়াবহ সমস্যা। বাচ্চাদের শরীরে ঘা। লবণাক্ত পানিতে কাপড় দোয়ার ফলে এ ঘা দেখা দিয়েছে।
সৌরশক্তিতে লবণাক্ততা মুক্তকরণ
গিভপাওয়ারের প্রথম প্রকল্প কিয়ুনগা কারখানা প্রতিষ্ঠায় খরচ হয় পাঁচ লাখ ডলার এবং সময় লাগে একমাস। সংস্থা আশা করছে যে এ ব্যবস্থা থেকে তারা প্রতিবছর এক লাখ ডলার আয় করতে পারবে। অন্যান্য স্থানে সৌর শক্তি কারখানা প্রতিষ্ঠায় এ অর্থ ব্যয় হবে। বার্নার্ডের চেষ্টা হচ্ছে আগামীতে কারখানা নির্মাণের ব্যয় এক লাখ ডলার নামিয়ে আনা।
বর্তমানে এ প্রকল্পের তহবিল আসছে কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত অনুদান থেকে। ব্যাংক অব আমেরিকা গত বছর আড়াই লাখ ডলার প্রদান করে।
ভবিষ্যতে বার্নার্ড ছোট, মড্যুলার-স্টাইল সোলার লবণ বিমুক্তকরণ ইউনিট চালু করবেন যাতে সিঙ্গল পাম্প এবং তিনটি টেসলা ব্যাটারিসহ ১৫ কিলোওয়াট সোলার গ্রিড ব্যবহার করা হবে। গিভপাওয়ার একত্রে এ ব্যবস্থার নাম রাখতে পারে লাইক লেগোস।
বার্নার্ডের টিম হাইতির দ্য লা গোনেভ দ্বীপপুঞ্জ ও কেনিয়ার মোম্বাসায় পরবর্তী প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। তিনি এ বছরের মধ্যেই এগুলো চালু করতে চান। গিভপাওয়ার কলম্বিয়াতেও অনুরূপ প্রকল্পের স্থান খুঁজছে।
এ সব স্থানে গিভপাওয়ারের এক প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুপেয় পানি বিতরণ করা। বার্নার্ড আশা করছেন যে স্থানীয় মানুষ ও কোম্পানি পানি বিতরণে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করবে। হাসপাতাল, স্কুল বা হোটেলগুলো প্রতিদিন পানির জন্য মূল্য দেবে। তিনি আরো আশা করেন যে কিছু ব্যবসামুখী স্থানীয় ব্যক্তিরা পানি কিনবে ও অন্যান্য শহরে তা বিক্রি করবে।
বার্নার্ড বলেন, ষাটের দশকে মেয়েরা দুধ বিক্রি করত। তারা এখন সে ভাবে পানি বিক্রি করবে। বিষয়টি কৌতুককর মনে হলেও পানি বিক্রি মেয়েদেরই কাজ।
বার্নার্ড বলেন, লবণমুক্তকরণ কারখানা কিয়ুনগার অর্থনীতিতে নতুন করে গতি সঞ্চার করেছে। একদল মহিলা সেখানে লবণমুক্ত পানিতে কাপড় ধোয়ার ব্যবসা শুরু করেছেন। এক ব্যক্তি ট্যাঙ্ক ভর্তি পানি নিয়ে আশপাশে বিক্রি করছেন।
বার্নার্ড বলেন, মহিলারা পানি বিক্রি করে অর্থ আয় করছে আর তাদের মেয়েরা স্কুলে ক্লাস করছে- এ রকম দৃশ্য দেখতে কী সুন্দরই না লাগবে!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন