সরকারি ঘেরাটোপের মধ্যে এবং কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট করে দেয়া পথেই অধিকৃত কাশ্মীর সফর করেছেন ইউরোপের প্রতিনিধিরা। উপত্যকার বাস্তব পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতেই গত মঙ্গলবার সেখানে যায় ২৩ জন ইইউ সাংসদদের এক প্রতিনিধি দল। তারা কাদের সঙ্গে কথা বলবেন, কোথায় কী ভাবে ঘুরবেন, সে সবও কেন্দ্রই ঠিক করে দিয়েছিল বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। তা নিয়ে শাসক দলের অস্বস্তি ছিলই। ‘কাশ্মীরের জনগণ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত’ বলে সফর শেষে প্রতিনিধি দলের মুখপাত্রের দেয়া প্রতিক্রিয়া তাদের অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দিল।
দলের সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার সম্পর্কিত হাই কমিশনার ও মুখপাত্র রুপার্ট কোলভিল বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে, কাশ্মীরে জনগণ দীর্ঘদিন ধরেই মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে। আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন সেখানকার অবরুদ্ধ পরিস্থিতি তুলে ফেলে মানবাধিকার পুনপ্রতিষ্ঠা করেন।’ এক প্রেস বিবৃতিতে কোলভিল জানান, জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের একাধিক জায়গা থেকে কয়েকদিন হল কারফিউ শিথিল করা হয়েছে, কিন্তু এখনও অধিকাংশ জায়গায় তা জারি রয়েছে। মানুষের অবাধ যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মকান্ডের অধিকারে বাধা দেওয়া হচ্ছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ধর্মের স্বাধীনতার ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে এই রিপোর্টও এসেছে যে অস্ত্রধারী জঙ্গি গোষ্ঠী সেখানকার স্থানীয় মানুষদের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে বা স্কুলে যেতে হুমকি দিচ্ছে। জঙ্গিদের দাবি না মানায় স্থানীয়দের ওপর একাধিক সহিংসতা সংগঠিত করা হচ্ছে বলেও আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে।’
বুলেটপ্রুফ গাড়িতে কেন্দ্রের নির্ধারিত কর্মসূচি, কাশ্মীরের নানা প্রান্তে বিক্ষোভ-অশান্তির মধ্যে ডাল লেকে শিকার-বিলাস, বিরোধী সাংসদদের ঢুকতে না দিয়ে বিদেশি প্রতিনিধিদের সাদরে ঘোরানো হচ্ছে— ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাছাই করা সদস্যদের কাশ্মীর ভ্রমণ নিয়ে এমন বহুবিধ প্রশ্ন-বিতর্ক দানা বেঁধেছিল। তবে বিতর্ক এড়িয়ে প্রতিনিধিরা জানিয়ে দিলেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা তাদের উদ্দেশ্য নয়। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সিদ্ধান্তের পক্ষে সওয়াল থেকে শুরু করে ‘কাশ্মীর ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ কিংবা সন্ত্রাস শুধু কাশ্মীরের নয়, বিশ্বের সমস্যা— এ সব বলার মধ্যে দিয়ে দেশের শাসক দলের মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে তাদের কথায়। যদিও একই সঙ্গে প্রতিনিধি দলের এক জন উস্কে দিয়েছেন বিরোধীদের তোলা প্রশ্ন। বিরোধী দলের নেতা-সাংসদদের কাশ্মীরে ঢুকতে দেয়ার পক্ষে সমর্থন দিয়ে ইইউ এমপি নিকোলাস ফেস্ট বলেছেন, ‘যদি আপনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এমপিদের ঢুকতে দেন, তা হলে ভারতের বিরোধী দলগুলিকেও সেই ছাড়পত্র দেয়া উচিত। সুতরাং, কিছুটা হলেও অসামঞ্জস্য রয়েছে। বিষয়টি দেখা উচিত সরকারের।’
কাশ্মীর সফরের উদ্দেশ্যে ভারতে গিয়েছিলেন ২৭ জন ইইউ এমপি। তাদের অধিকাংশই অতি ডানপন্থী বলেই পরিচিত। শুধু মাত্র তিন জন বাম তথা প্রগতিশীল দলের প্রতিনিধি। কিন্তু এই ২৭ জনের মধ্যেও আবার চার জন কাশ্মীর সফর না করেই দেশে ফিরেছেন। ফিরে যাওয়া চার জনের মধ্যে ক্রিস ডেভিস রীতিমতো মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। অভিযোগ ছিল, সরকারি ঘেরাটোপে নয়, নিজের মতো করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন বলেই তাকে কাশ্মীরে যেতে দেওয়া হয়নি। মঙ্গলবার তিনি বলেছিলেন, ‘মোদি সরকারের জনসংযোগ স্টান্টের অংশ হতে আমি আসিনি এবং এমন ভান করতে পারব না যে, সব ঠিকঠাক চলছে। এটা স্পষ্ট যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ভঙ্গ হয়েছে কাশ্মীরে। সারা বিশ্বের বিষয়টিতে নজর দেয়া দরকার।’
আবার এমন অভিযোগও উঠেছে যে সাংবাদিক, ব্যবসায়ীরা এবং কাশ্মীরের একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি দল ইউ ইইউ এমপিদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সেই সুযোগ দেয়া হয়নি। ন্যাশনাল কনফারেন্স দুই সাংসদ অভিযোগ করেছেন, তারা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওই এমপিদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আটকে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশিদের খাতির-যত্ন করে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের সাংসদদের আটকে দেয়ার প্রশ্নে সরকারের সমালোচনা করেছে বিরোধী দলগুলি। এ বার ইইউ প্রতিনিধিরাও তাতে সায় দেয়ায় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের কাশ্মীরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্র অনেকটাই চাপে পড়ল বলেই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। সূত্র: এনডিটিভি, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন