এরদোগান একজন তুর্কি ব্যবসায়ী হিসেবে ইয়ালসিনডাগকে চিনতেন এবং তিনি তুরস্কের সংবাদমাধ্যমের সাথে একটি প্রচারে এরদোগানের জামাতাকে সহযোগিতা করেছিলেন। ট্রাম্প পরিবারের সাথে তার সম্পর্কের কারণে, এরদোগান রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হিসাবে ইয়ালসিনডাগকে নিয়োগ করেন, যারা আঙ্কারার পক্ষে ওয়াশিংটনের কাছে তদবির করে।
ব্যবসায়িক গোষ্ঠীটির আগের চেয়ারম্যাান ছিলেন একিম আল্পটেকিন। তিনি অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল মাইকেল টি ফ্লিনের পরামর্শক সংস্থাকে ৫ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ প্রদান করেছিলেন, যিনি ট্রাম্পের প্রথম জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা হয়েছিলেন। সংস্থাটির প্রসিকিউটররা বলেছেন, আলপটেকিন তুর্কি সরকারের তদবির করার জন্য ফ্লিনকে অর্থ প্রদান করছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তদবির চালানোর বিধি লঙ্ঘনের জন্য তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছিল এবং তদন্তকারীদের কাছে মিথ্যাচারের জন্য তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পরে তুর্কি-ইউএস বিজনেস কাউন্সিলের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পাওয়া ইয়ালসিনডাগ নিয়মিত ওয়াশিংটনে যাওয়া-আসা শুর করেন। কাউন্সিলটি প্রথমবারের মতো ওয়াশিংটনের ট্রাম্প হোটেলে বার্ষিক সম্মেলন করেন। হোটেলটিকে লাখ লাখ ডলার আয় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তিনি ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ‘বক্তা’ হিসাবে নিয়ে আসতেন।
চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে, ইয়ালসিনডাগ ক্যাপিটল হিল এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন। সেখানে কেবল বাণিজ্য নীতি নয়, অন্যান্য বিষয়া নিয়েও আলোচনা হয়। স্টেট ডিপার্টমেন্টের বৈঠকে উপস্থিত একজন ব্যক্তি জানান, তিনি পেনসিলভেনিয়া ভিত্তিক নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে হস্তান্তর করার জন্য জোর দের, এরদোগানের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের অভ্যুত্থান প্রচারণার জন্য যাকে অভিযুক্ত করেছিল তুরস্ক। তিনি তুর্কি ব্যাংকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার বদলে কিছু জরিমানা করে বিষয়টি গোপনে সমাধান করতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেন; রুশ অস্ত্রের বিকল্প হিসেবে তুরস্কের কাছে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির পক্ষে যুক্তি দেখান এবং সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুর্কিদের অভিযান করতে বাধা না দিতে বলেন। তুরস্ক মস্কোর সাথে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে যেতে পারে বলে স্পষ্ট হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মুহুর্তে আপনার সেরা বন্ধু হিসাবে তুরস্ক বিবেচনা না করলেও, দীর্ঘদিনের একটি মিত্র হারানো লজ্জার বিষয় হবে।’
এরদোগানের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকের ছেলে ৪১ বছর বয়সী আলবায়রাক ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে নিউ ইয়র্কেই থাকতেন। তিনি তুরস্কের অন্যতম বৃহত্তম দল ক্যালিক হোল্ডিংয়ের আমেরিকান বিভাগে কাজ করার সময় পেসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তিনি ২০০৪ সালে এরদোগানের কন্যা ইসরাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তিন বছর পরে তাকে কালিকের প্রধান নির্বাহী মনোনীত করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে এরদোগান আলবায়রাককে সংসদে একটি আসন জিততে সহায়তা করেছিলেন এবং তাকে জ্বালানি মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। তবে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এরদোগানের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর একটি অংশের অভ্যুত্থান চেষ্টার পরে আলবায়রাকের প্রভাব আরও অনেক বেড়ে যায়। অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়ার পরে এরদোগানের চালানো শুদ্ধি অভিযানের নেতৃত্ব দেন আলবায়রাক। তিনি দ্রুত অর্থমন্ত্রীর ভ‚মিকায় উন্নীত হন। তিনি এত প্রভাব বিস্তার অর্জন করেছিলেন যে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ কয়েকজন তাকে ‘শ্যাডো প্রিমিয়ার’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি তুর্কি সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করেছিলেন, যার বেশিরভাগ অংশ এখন তার ছোট ভাই সেরহাত আলবায়রকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। (দুই ভাইয়ের উভয়েই ইয়ালসিনডাগের সাথেও কয়েক বছর নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন।) একই সাথে, অনর্গল ইংরেজী বলতে পারার কারণে তিনি ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্কেরও প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। তার মিশনের মধ্যে ছিল গুলেনের প্রত্যর্পণ অনুসন্ধান করা, যিনি এরদোগান বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের প্ররোচনার জন্য অভিযুক্ত হন। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে, তুরস্কে গুলেনের প্রত্যর্পণ করাতে আলবায়রাক নিউ ইয়র্কে ফ্লিনের সাথে দেখা করেছিলেন। এই প্রচেষ্টার ফলে ফ্লিন এবং আল্পটেকিনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছিল।
তুরস্কের জ্বালানী মন্ত্রী ও এরদোগানের জামাতা আলবায়রাক ২০১৮ সালে ট্রাম্পের জামাতা কুশনারের সাথে হোয়াইট হাউসে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা করতে প্রথম বৈঠক করেন। গত সেপ্টেম্বর মাসেও ৫ দিনের সফরে তুরস্ক এসেছিলেন কুশনার। এরদোগান জামাইদের বৈঠককে সম্ভাব্য মোড় হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তবুও ট্রাম্প রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা হ্রাস করায় তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ‘উস্কানিমূলক’ মন্তব্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘ট্রাম্প তার জামাইকে তুরস্কে অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে কথা বলতে পাঠিয়েছিলেন, আমি তাকে মেনে নিলাম, তিনি আমার জামাইয়ের সাথে বসে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন।
রাশিয়ার ক্ষেপনাস্ত্র কেনা নিয়ে মার্কিন আসন্ন নিষেধাজ্ঞার পটভ‚মিতে, তিন জামাতা ইয়ালসিনডাগের নেতৃত্বে ওয়াশিংটনে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর একটি সম্মেলনে অংশ নেন। কুশনার বাকি দুইজনকে ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই বৈঠক আঙ্কারার রাজনীতিতে আলবায়রাককে প্রশংসিত করেছিল এবং তিনি তুর্কি সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, ট্রাম্প রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে ‘বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি’ দেখিয়েছেন। এর মাত্র দু›সপ্তাহ আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স আঙ্কারাকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন যে রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের ফলে ন্যাটোর অভ্যন্তরে তুরস্কের অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে। জুলাইয়ে প্রথম রুশ ক্ষেপণাস্ত্র তুরস্কে পৌঁছালে সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটি একটি দ্বিপক্ষীয় বিবৃতি জারি করে ট্রাম্পকে ‘আইনের প্রয়োজন অনুসারে নিষেধাজ্ঞার পুরোপুরি প্রয়োগ করার’ আহ্বান জানিয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন যে নিষেধাজ্ঞাগুলি আসছে। তবে এরদোগানের একজন মুখপাত্র তুর্কি সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আলবায়রাকের সাথে ওভাল অফিসের বৈঠকের পরে ট্রাম্প তার সব শক্তি ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা আটকানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।’ জুলাইয়ের শেষের দিকে, ট্রাম্প সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন