মাগফিরাত মানে ক্ষমা লাভ করা। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল। তার এক নাম আল গাফুরু। গাফুরুর রাহীম। পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল। রমজানের প্রথম দশদিন রহমতের। মধ্যের দশদিন মাগফিরাতের। শেষ নয় বা দশদিন জাহান্নাম থেকে নাজাতের। দোজখের আগুন থেকে মুক্তির। তবে আল্লাহর রহমত ক্ষমা ও মুক্তির সিদ্ধান্ত কোনো দিনক্ষণ, মাস বা বছরের সাথে আবদ্ধ নয়। তিনি যাকে যখন চান, সব দিতে পারেন। এসব হচ্ছে বিশেষ সুযোগের অফার। দয়ার ছাড়যুক্ত উদার প্যাকেজ।
মাগফিরাত লাভের জন্য তাওবা ইস্তেগফার করা ছাড়া উপায় নাই। আজাব গজব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাই বলে, আসুন তাওবা করি। বলা হয় বেশি বেশি ইস্তেগফার করার কথা। এ দুটো কথার অর্থ মর্ম ও বিশ্লেষণ করা খুব দরকার। এটাও জানা প্রয়োজন যে, রমজানের সময় আমরা ক্ষমা পেলাম কিনা। আমাদের কি মাগফিরাত হবে?
নবী করীম স. বলেছেন, ওই ব্যক্তির চেহারা ধূলিমলিন হোক, যে রমজান পেলো অথচ তার গুনাহ-খাতা মাফ করিয়ে নিতে পারলো না। তিনি আরো বলেন, মানুষ মাত্রেরই ভুলত্রুটি ও গুনাহ খাতা আছে। তবে পাপীদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি যে তাওবা করে।
তাওবা কী, কীভাবে করতে হয়
মাগফিরাত বা ক্ষমা পেতে হলে তাওবা করতে হয়। রমজানে কি আমরা তাওবা করেছি? প্রথমেই বুঝতে হবে যে, তাওবাহ কোনো খেলতামাশা নয়। এটা কোনো প্রচলিত অনুষ্ঠান নয়। তাওবাহ হচ্ছে ১. গুনাহ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সব নাফরমানি থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি। ২. সব ধরনের গুনাহ ও অপকর্ম ছেড়ে দেয়ার সুদৃঢ় ইচ্ছা ও অঙ্গীকার। ৩. বান্দার হক দিয়ে দেয়া। শোষণ উৎপীড়নের ক্ষতিপূরণ দেয়া। ৪. সব হক মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে মুআমালা পরিষ্কার করে নেয়া। ৫. লেনদেন পরিষ্কার করে মানুষের অধিকার বা পাওনা দিয়ে দেয়া।
৬. অনুতপ্ত হয়ে জানা অজানা প্রকাশ্য গোপন ছোট বড় সব গুনাহ থেকে বিরত থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে আল্লাহর কাছে আন্তরিক ক্ষমা প্রার্থনা করা। ৭. জীবনে আচরণগত বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা। এর নাম ‘তাওবাহ’।
এককথায়, জুলুম পাপাচার অপকর্ম চুরি দুর্নীতি গুম খুন লুটপাট সুদ ঘুষ যাবতীয় হারাম কাজ ও কবিরা গুনাহ বন্ধ করে, এসবের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া, তালাফি করা, হকদারকে তার হক ফিরিয়ে দিয়ে এবং পূর্ণাঙ্গ কাফফারা আদায় করে, ভবিষ্যতে আর এসব না করার দৃঢ় অঙ্গীকারের মাধ্যমে সর্বান্তকরণে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার নাম ‘তাওবাহ’ বা প্রত্যাবর্তন। তাওবার শাব্দিক অর্থ প্রত্যাবর্তন।
রমজানে এসব বিষয়ে মনযোগী হওয়া এবং কার্যকর করা হলে মাগফিরাত পাওয়া সহজ হবে। এ মাস সাধারণ ক্ষমা লাভের মাস। মধ্য দশক স্পেশাল অফার ও ডিসকাউন্ট এর সময়। এটি ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে সহজে আল্লাহর কাছে হিসাব দাখিলের সুযোগ। কিছু না করে, মানুষের হক আদায় না করে কেবল মুখে মাফ চাইলে তাওবা হয় না। ব্যক্তিগত সাধারণ গুনাহের জন্য মৌখিক ও আন্তরিক ইস্তেগফার ফলদায়ক। যা আমাদের সদাসর্বদা করতে থাকা উচিত।
অন্যায় অপরাধ পরিত্যাগ ও কৃতকর্মের সংশোধন না করে ‘মাফ চাই’ ‘মাফ করে দাও’ বললেই সবকিছু হয়ে যায় না। শুধু মুখে মাফ চাওয়াকেই ‘তাওবাহ’ বলে না। কেবল জীবন চলার পথে রাতদিন সংঘটিত সাধারণ গুনাহের জন্য মাফ চাওয়ার নামই ‘ইস্তিগফার’ বা ক্ষমা প্রার্থনা। বিশেষ করে আল্লাহর ইবাদতে ত্রুটি এবং সাধারণ গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, দৈনন্দিন ইস্তেগফারের উদ্দেশ্য।
সহজ উচ্চারণে মানুষ ‘তাওবাহ’ শব্দটিকে ‘তওবা’ বা ‘তাওবা’ বলে। তাওবার মতো তাওবা হওয়া চাই। আলেমদের কর্তব্য তাওবার প্রকৃত অর্থ ও মর্ম মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করা।
অর্থহীন মৌখিক তাওবার ডাক, তাওবার মাহফিল নামে সস্তা তাওবার আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে (নাউজু বিল্লাহ) মহান আল্লাহ এবং তার শোষিত অধিকার বঞ্চিত মজলুম বান্দাদের সাথে রসিকতা করা, তাওবার সঠিক পদ্ধতি নয়। তাওবার গুরুত্ব কমানোর মতো এমন অনুষ্ঠান বা হালকা কাজ করা কারো পক্ষেই ঠিক না। যা অনেক সময় না বুঝে বহু মানুষ করে থাকে। এতে তাওবার অর্থ বিকৃতির পাশাপাশি তাওবার নামে এক ধরনের তামাশাও করা হয়। যাতে আরো গুনাহ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। মৃত্যু সন্নিকট হলে কোনোরূপ সমাধান ক্ষতিপূরণ বা ভাবনা চেতনা ছাড়াই একজন হুজুর ডেকে তাওবার বাক্যগুলো পড়ানো হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এ যেন ময়না পাখিকে শেখানে বুলি আউড়ানোর মতো ঘটনা।
আবার প্রকৃত তাওবা করলে মানুষের গুনাহ থাকে না। আল্লাহ অধিক সন্তুষ্ট হলে গুনাহকে সওয়াব দিয়ে পরিবর্তন করে দিয়ে থাকেন। নবী করীম স. বলেছেন, গুনাহ থেকে তাওবাকারী যেন গুনাহমুক্ত মানুষের মতো।
মানুষের উচিত তাওবা ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর পার্থিব গজব, বালা মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আাখেরাতের আজাব হতে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি দুনিয়ায়ও তাওবা ইস্তিগফারের উপকারিতা লাভ করা। ইস্তেগফার করার অনেক মর্তবা। এখানে কিছু দেয়া হলো।
১. অধিক ইস্তিগফারের কারণে প্রচুর বর্ষণ হয়। বাগান ও শস্যে ভালো ফসল হয়। প্রাকৃতিক অবস্থা ভালো থাকে। ২. ইস্তিগফারকারীকে আল্লাহ উত্তম সন্তান, সম্পদ ও জীবিকার দান করেন। ৩. দীনি দায়িত্ব পালন ও ইবাদত বন্দেগী করা সহজ হয়। কর্মজীবন হয় সুখের। ৪. আল্লাহ ও বান্দার মাঝে দূরত্ব ঘুচে যায়। ৫. ইস্তিগফারকারীর চোখে দুনিয়াকে খুব তুচ্ছ করে দেয়া হয়। ৬. ওয়াসওয়াসা দানকারী মানব ও জিন শয়তান থেকে তাকে হেফাজত করা হয়। ৭. ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করা যায়। ৮. আল্লাহর ভালোবাসা অর্জিত হয়। ৯. বিচক্ষণতা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
১০. দুশ্চিন্তা, পেরেশানি দূর হয়। ১১. অভাব ও বেকারত্ব দূর হয়। ১২. আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য অর্জিত হয়। পাপী বান্দার তাওবার কারণে আল্লাহ আনন্দিত হন। ১৩. মৃত্যুর সময় ফেরেস্তারা তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ নিয়ে আসে। ১৪. হাশরের মাঠে মানুষ যখন প্রচ- গরম ও ঘামের মধ্যে থাকবে, তখন ইস্তিগফারকারী থাকবে আরশের ছায়াতলে। ১৫. কিয়ামতের দিন মানুষ যখন অস্থির থাকবে, ইস্তিগফারকারী তখন ডানপাশের মুত্তাকিদের দলে থাকবে। ১৬. মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকা যায়। ১৭. আরশ বহনকারী ফেরেশতাগণও তার জন্য দু’আ করেন।
ইস্তেগফার
ইস্তেগফার অর্থ হল ‘ক্ষমা প্রার্থনা করা’। কোন ভুল করে ফেললে তার জন্য আমরা মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট ক্ষমা চেয়ে থাকি। ক্ষমা চাওয়ার জন্য আমরা সবাই বিশেষ করে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়ি। যা সবার নিকট সহজ ও সহজে উচ্চারিত। আরবি ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ কথাটির বাংলা অর্থ, আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। প্রতি ফরজ নামাজের সালাম ফিরানোর পর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তেন। তিনি বলতেন, তোমরা বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি আমার আল্লাহর কাছে প্রতিদিন ৭০ বার ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকি।
ইস্তেগফার এর মধ্যে উত্তম হচ্ছে, আমি আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তার নিকট তাওবা করছি বা তার অবাধ্যতা ছেড়ে আনুগত্যে ফিরে আসছি। আরবীতে বললে, ‘আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া আতূবু ইলাইহি’। আমরা রমজানের মধ্যভাগসহ পুরো রমজান তাওবা ইস্তেগফার করতে থাকি। আশা করা যায়, আল্লাহ অগণিত মানুষের সাথে আমাদেরকেও মাগফিরাত করে দিবেন। (বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, মুসনাদ আহমদ, সিলসিলা আহাদীস সহীহাহ, আত-তারগীব দ্রষ্টব্য।)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন