তুরস্ক ও সিরিয়ায় ঘটে গেল ভয়াবহ ভূমিকম্প। এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে শুধু তুরস্কেই তিন সহ¯্রাধিক ভবন মাটির সাথে মিশে গেছে বলে জানা গেছে। নিহত হয়েছে দশ সহ¯্রাধিক। আহতের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের অন্যতম হলো ভূমিকম্প। কিন্তু কেন এ ভূমিকম্প কিংবা ভূমিধস হয়ে থাকে? এ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
ভূমিকম্প হওয়ার কারণ : আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, ভূ-অভ্যন্তরে স্থিত গ্যাস যখন ভূ-পৃষ্ঠের ফাটল বা আগ্নেয়গিরির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে তখন সেই গ্যাসের অবস্থানটি ফাঁকা হয়ে পড়ে আর পৃথিবীর উপরের তলের চাপ ওই ফাঁকা স্থানে দেবে গিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখে। তখনই ভূ-পৃষ্ঠে প্রবল কম্পনের অনুভব হয়, যা ভূমিকম্প নামে পরিচিত। সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকেÑ ১. ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ পরিবর্তন জনিত কারণে, ২. আগ্নেয়গিরি সংঘটিত হওয়ার কারণে ও ৩. শিলাচ্যুতি জনিত কারণে।
আল্লামা ইবনু কাইয়িম র. বলেন, মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুমতি দেন। ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তখন এ ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে। তারা মহান আল্লাহর নিকট তওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মোনাজাত করে। আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হতো, তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলত, ‘মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করেছেন।’
ভূমিকম্প বিষয়ে পবিত্র কোরআনের ‘যিলযাল’ নামে স্বতন্ত্র একটি সুরা নাজিল করা হয়েছে। মানুষ শুধু কোনো ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয় এবং ভূতত্ত্ববিজ্ঞানও এ কার্যকারণ সম্পর্কেই আলোচনা করে থাকে।
এ প্রসঙ্গে সতর্ক করে প্রিয়নবি হজরত মুহাম্মদ সা. বলেন, ‘যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে; কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে, কিন্তু তা আত্মসাৎ করা হবে (অর্থাৎ যার সম্পদ সে আর ফেরত পাবে না); জাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে; ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে; একজন পুরুষ তার স্ত্রীর বাধ্যগত হয়ে মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে; বন্ধুকে কাছে টেনে নেবে আর পিতাকে দূরে সরিয়ে দেবে; মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে শোরগোল (কথাবার্তা) হবে; যখন সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসকরূপে আবির্ভূত হবেÑ সে সময় তোমরা অপেক্ষা করো রক্তিম বর্ণের ঝড়ের (এসিড বৃষ্টি), ভূকম্পনের, ভূমিধসের, রূপ বিকৃতির (লিঙ্গ পরিবর্তন), পাথর বৃষ্টির। তখন সুতো ছেঁড়া (তাসবিহ) দানার ন্যায় একটির পর একটি নিদর্শনগুলোর জন্য অপেক্ষা করো।’ (তিরমিজি, হাদিস নং ১৪৪৭)
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, ৫৯)
তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম।’ (সুরা আনয়াম, ৬৫)। সহিহ বুখারির বর্ণনায় বিখ্যাত সাহাবি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘যখন তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম’ আয়াতটি নাজিল হলো, তখন রাসুল সা. বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’
শায়খ ইস্পাহানি র. এ আয়াতের তাফসির করে বলেন, ‘এর ব্যাখ্যা হলো, ভূমিকম্প ও ভূমিধসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া (পৃথিবীতে ভূমিকম্প হওয়া)।’
ভূমিকম্প কেয়ামতের একটি আলামত : রাসুল সা. বলেছেন, তখন পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফেতনা প্রকাশ পাবে এবং খুনখারাবি বাড়বে, তোমাদের সম্পদ এতো বাড়বে যে, উপচে পড়বে। (বুখারি, হাদিস নং ৯৭৯)। বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে, তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি। এগুলো দিয়ে তিনি তার বান্দাদের সাবধান করে থাকেন। কার্যত এগুলো মানুষের পাপ ও অপরাধের ফল। আল্লাহ বলেন, ‘যে বিপদ আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শুরা, ৩০) ।
কয়েক বছর আগে নেপালে ভূমিকম্প হলে সেখানকার হিন্দু ধর্মীয় নেতৃবন্দ বলেছিলেন, বহু পূর্বেই আমরা অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার আধিক্য দেখে সবাইকে সাবধান করেছিলাম। অন্যায় ও পাপাচার বৃদ্ধি পাওয়ায় ভগবান ক্ষুব্ধ হয়ে ভূমিকম্পরূপে শাস্তি পাঠিয়েছেন। ভারতের মন্দিরে আতশবাজি বিস্ফোরণে শতাধিক ভক্ত নিহত ও প্রায় তিনশ’ গুরুতর আহত হওয়ার পেছনেও পাপাচারে মানুষের সীমালঙ্ঘনকে দায়ী করেছেন ধর্মীয় নেতারা। বছর কয়েক আগে কেদারনাথে প্রবল বন্যায় বহু হতাহতের জন্যে মানুষের পাপ ও সীমালঙ্ঘনকেই দায়ী করা হয়। ইহুদি ও খ্রিষ্ট ধর্মেও এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত।
ভূমিকম্প হলে করণীয় : আপদ-বিপদ, সুখশান্তি সর্বাবস্থায়ই প্রত্যেক মুসলমানকে আল্লাহর ওপর ভরসা করা উচিত। বিশেষত দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প প্রভৃতি মুসিবতের সময় খুবই আন্তরিকভাবে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা উচিত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনত এবং (আল্লাহকে) ভয় করত, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা (আমার নবিকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।’ (সুরা আরাফ, ৯৬)। তাই যখন কোথাও ভূমিকম্প হয় অথবা সূর্যগ্রহণ কিংবা ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে অতি দ্রুত তওবা করা। তার কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা। মহান আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন