লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মঙ্গলবারের জোড়া বিস্ফোরণে দুই বাংলাদেশিসহ কমপক্ষে ১৩৫ জন নিহত ও ৫ হাজার আহত হওয়ার পর মন্ত্রিসভা রাজধানী নগরীতে দু’সপ্তাহের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে এবং রাজধানীর সুরক্ষার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে। মঙ্গলবারের ওই বিস্ফোরণে শহর কেঁপে ওঠে ও বৈরুতের উপকণ্ঠ পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেন, জরুরি শ্রমিকরা বেঁচে থাকাদের সন্ধানে ধ্বংসস্ত‚পে খোঁড়াখুঁড়ি করায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। লেবাননের মন্ত্রিসভা বন্দর কর্মকর্তাদের তদন্তে দোষী ব্যক্তি চিহ্নিত হওয়া অবধি গৃহবন্দি করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
লেবাননের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান বলেছেন, অত্যন্ত বিস্ফোরক রাসায়নিক পদার্থের গুদামে এ বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব একে বিপর্যয় বলে বর্ণনা করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন জানান, ঘটনাস্থলের কাছেই থাকা একটি ওয়্যারহাউজে দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অনিরাপদ অবস্থায় মজুদ ছিল, যা থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেছেন, কোন গুদামে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের মত বিস্ফোরক অনিরাপদভাবে মজুত রাখার বিষয়টি ‘অগ্রহণযোগ্য’। প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের সভাপতিত্বে সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক হয়েছে। বিস্ফোরণের কারণ জানতে তদন্ত চলছে। দায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তির কথা বলেছে দেশটির সুপ্রিম প্রতিরক্ষা পরিষদ। জরুরি তহবিল থেকে ১ বিলিয়ন লিরা বরাদ্দের ঘোষণাও দিয়েছেন লেবানিজ প্রেসিডেন্ট। গতকাল থেকে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হচ্ছে দেশটিতে। নিহতদের মধ্যে মিজান ও মেহেদি হাসান নামের দুই প্রবাসী বাংলাদেশিও রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্দরে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস বিজয়। জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে মেরিটাইম টাস্কফোর্সের অধীনে নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২১ সদস্য আহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর বলে আইএসপিআর জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গুরুতর নৌসদস্যকে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অভ বৈরুত মেডিক্যাল সেন্টার এইউবিএমসি-এ ভর্তি করা হয়েছে। অন্যদের ইউনিফিলের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হেলিকপ্টার/অ্যাম্বুলেন্সযোগে হামুদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে তারা শঙ্কামুক্ত।
উদ্ধারকর্মীরা এখনো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে ভুক্তভোগীদের উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিস্ফোরণে বাড়িহারা হয়েছেন ৩ লাখ মানুষ। শহরটির গভর্নর মারওয়ান আব্বুদ গতকাল বলেন, গৃহহারাদের খাদ্য, পানি ও আশ্রয় প্রদানে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ।
কী হয়েছিল?
মঙ্গলবার বৈরুত স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার ঠিক পরই বিস্ফোরণটি ঘটে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে ধ্বংসস্ত‚পের নিচে বহু মানুষকে আটকা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বিস্ফোরণের আওয়াজ ছিল তীব্র ও কান ফাটানো। ভিডিও ফুটেজে অনেক গাড়ি এবং ভবনকে বিধ্বস্ত দেখা গেছে। বন্দর এলাকা থেকে পাওয়া ভিডিওতে প্রথম বিস্ফোরণস্থল থেকে ধোঁয়ার কুন্ডলি উঠতে দেখা যায়। টুইটারে অনেকে মোবাইল ফোনে তোলা প্রচন্ড বিস্ফোরণের ভিডিও শেয়ার করেন।
টুইটারে পোস্ট করা এ ভিডিওর সাথে বলা হয়, তারা বিস্ফোরণস্থল থেকে ১০ কিমি দূরে থাকেন এবং বিস্ফোরণে তাদের ভবনের কাঁচ ভেঙে গেছে। বিস্ফোরণের প্রভাব ২৪০ কিলোমিটার দূরের পূর্ব ভ‚মধ্যসাগরের দ্বীপ সাইপ্রাসেও অনুভ‚ত হয়েছে। সেখানকার মানুষ মনে করেছিল, আশেপাশে ভ‚মিকম্প হয়েছে। বিস্ফোরণের অভিঘাতে যে সমস্ত ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সদর দফতরও রয়েছে। লেবাননের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন বাবদা প্যালেসেরও ক্ষতি হয়েছে।
প্রথম বিস্ফোরণের পর আরেকটি আরও বড় বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় আশপাশের ভবনগুলো ঢেকে যেতে দেখা যায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বিস্ফোরণ এত শক্তিশালী ছিল যে, তার মনে হয়েছিল তিনি মারা যাবেন। হাসপাতাল আহতদের ভিড়ে উপচে পড়েছে বলে জানা গেছে।
একজন গণমাধ্যমকর্মী জানিয়েছেন, নিকটবর্তী হাসপাতালে এত আহত মানুষকে আনা হয়েছে যে, সেখানে স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বৈরুতের হাসপাতালগুলিতে তিল ধারণের জায়গা নেই। তাই জখম অনেককেই বাইরে অন্যান্য হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দমকল কর্মীরা অনেক স্থানে আগুন নেভাতে হিমশিম খেয়েছেন। বিস্ফোরণ ঘটেছে একটা স্পর্শকাতর সময়ে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাফিক হারিরিকে ২০০৫ সালে হত্যা মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে এ সপ্তাহেই। গাড়িবোমা বিস্ফোরণে জনাব হারিরির হত্যায় চারজন সন্দেহভাজনের মামলার রায় জাতিসংঘের একটি ট্রাইব্যুনালের দেবার কথা আগামীকাল।
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া
বৈরুত বিস্ফোরণে বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বহু দেশ লেবাননকে তাদের সমর্থন প্রস্তাব করেছে। এখন পর্যন্ত হামলার কোনো তথ্যপ্রমাণ না পাওয়া গেলেও বৈরুত বিস্ফোরণকে ‘টেরিবল এটাক’ বা ভয়াবহ হামলা বলে আখ্যায়িত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে ‘গ্রেট’ কিছু জেনারেলের। তারা তাকে বলেছেন, এ বিস্ফোরণ ঘটেছে ‘এ বোম্ব অব সাম কাইন্ড’ বা কোনো এক রকম বোমা দিয়ে। বৈরুত বিস্ফোরণ নিয়ে হোয়াইট হাউজে ব্রিফিংকালে তিনি এসব মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, লেবাননকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র। তার ভাষায়, তাদেরকে সাহায্য করতে আমরা সেখানে থাকবো। একে মনে হচ্ছে এক ভয়াবহ হামলা।
লেবাননের এমন ঘটনাকে হতাশাজনক বলে অভিহিত করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেন, যেভাবে পারি সাহায্য, সমর্থন দিতে প্রস্তুত আছে যুক্তরাজ্য। ফরাসি ও আরবি ভাষায় টুইট করেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। তিনি বলেছেন, ফরাসি ‘এইড’ বা সাহায্য এরই মধ্যে যাত্রা শুরু করেছে। তিনি বলেছেন, তার দেশ লেবাননের পাশে আছে। অন্যদিকে যৌথ এক বিবৃতি দিয়েছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা বলেছে, মেডিকেল মানবিক সাহায্য দেয়ার জন্য লেবাননের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ইসরাইল।
অনিরাপদ মজুদ ছিল ২৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের
বৈরুতের এক গুদামে মজুদ করা ছিল বিস্ফোরক অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। দু’এক কেজি নয়, পুরো ২৭৫০ টন। অনিরাপদ অবস্থায় তা রাখা হয়েছিল। এ তথ্য আর কারো নয়, লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের। দৃশ্যত ওই গুদাম থেকেই বৈরুতে ‘পারমাণবিক বোমা’ হামলার মতো বিস্ফোরণ ঘটেছে। আগুনের সংস্পর্শে এলে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটে আগুন ধরে যায়। এ থেকে বিস্ফোরণ ঘটে। তখন তৈরি হয় বিষাক্ত গ্যাস। এর মধ্যে রয়েছে নাইট্রোজেন অক্সাইড ও অ্যামোনিয়া গ্যাস। এত বিষাক্ত এবং বিস্ফোরক পদার্থের এত বিশাল মজুদ কেন অনিরাপদ অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল- এ নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর এক্ষেত্রে কী দায়িত্ব পালন করেছে তাও স্পষ্ট নয়। তবে বিস্ফোরণ নিয়ে তদন্ত চলছে। এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কীভাবে, কোথা থেকে ওই বিস্ফোরণের সূত্রপাত। তবে প্রেসিডেন্ট আউনের কথায় এ ইঙ্গিত মেলে যে, ওই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের গুদাম থেকেই বিস্ফোরণের সূত্রপাত। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বহুবিধ ব্যবহার আছে। তবে কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক স্যার তৈরিতে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এছাড়া এটি বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অত্যন্ত দাহ্য বলে এর নিরাপদ মজুদের বিষয়ে কঠোর নিয়মকানুন আছে। এর মধ্যে যে স্থানে এই রাসায়নিক পদার্থ রাখা হবে তা আগুন থেকে পুরোপুরি নিরাপদ থাকতে হবে। আগুন যাতে একে স্পর্শ করতে না পারে সে জন্য এর সংরক্ষণাগার হতে হবে একদম ‘ফায়ার-প্রুফ’।
বিচারের আওতায় আনা হবে জড়িতদের : হাসান
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বৈরুত বন্দরে বড় একটি বিস্ফোরণের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে। মঙ্গলবার রাতেই জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে দিয়াব বলেন, আজ যা ঘটেছে তা জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। এ বিপর্যয়ের সঙ্গে জড়িতদের মূল্য দিতে হবে।
তদন্ত কমিটি গঠন
বিস্ফেরণের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বন্দর কর্মকর্তাদের গৃহবন্দি করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা। তারা জানিয়েছে, তদন্তের পর দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে কোন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গৃহবন্দি করে রাখা হচ্ছে তা জানা যায়নি। ২০১৪ সালে অ্যামোনিয়া নাইট্রেট গুদামজাতকারী দায়িত্বশীলদের নজরদারিতে রাখবে সামরিক বাহিনী। সূত্র : এনএনএ, আল-জাজিরা, রয়টার্স ও বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন