নারী ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের অনলাইন প্লাটফর্ম ‘উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যক নারী ই-কর্মাস উদ্যোক্তা তৈরি ও দেশীয় পণের বিকাশ ঘটিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করে চলেছে ফোরামটি। এখানে নারী উদ্যোক্তারা পণ্য কেনাবেচা থেকে শুরু করে নেটওয়ার্কিং, নানা বিষয়ে কর্মশালা ও প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারছেন। ফলে নতুন করে চাহিদা তৈরি হচ্ছে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় পণ্যগুলোর। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।
২০১৭ সালের অক্টোবরে যাত্রা শুরু করে উই। এটি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সবাই নিজ জেলার পণ্য বা তাঁদের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। প্লাটফর্মে যারা যুক্ত আছেন, যারা কাজ করছেন তারা সম্পূর্ণ স্থানীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। ফলে প্রতিটি জেলার প্রায় হারানো পণ্যগুলোও নতুনভাবে পরিচিতি পাচ্ছে। অনলাইন প্লাটফর্মটিতে দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছে এমন উদ্যোক্তার সংখ্যা দশ লাখ ছাড়িয়েছে। এছাড়া প্লাটফর্মটিতে দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী নতুন উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
জানা যায়, উই এখন দেশীয় গণ্ডি পেরিয়ে আগামী জানুয়ারি নাগাদ বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। বিশ্ববাসীর কাছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড পৌঁছে দিতে এবং বাংলাদেশি পণ্যের সুনাম ও আন্তর্জাতিক বাজার তৈরিতে এখন নজর দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী এমন দশ লক্ষাধিক নারীকে একত্রিত করতে পেরেছে উই। তবে এখানে অনেক পুরুষ উদ্যোক্তাও সক্রিয়। যারা প্রায় দেড়শ দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। ইতোমধ্যে উদ্যোক্তাদের তিনশ জন দেশীয় পণ্য বিক্রি করে লাখপতি খেতাব কুড়িয়েছেন। অর্থাৎ তাদের কেউ কেউ প্লাটফর্মটিকে ব্যবহার করে ২০ লাখ, কেউ ১৫ লাখ, কেউ ১০ লাখ আবার কেউবা লাখ টাকা করে আয় করেছেন।
মজার বিষয় হলো, প্লাটফর্মের সদস্যরা নিজেরাই ক্রেতা আবার নিজেরাই বিক্রেতা। তারা মূলত একে অন্যের পণ্য কেনাবেচা করছেন। আর এভাবেই ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মাঝে গড়ে উঠেছে যুতসই বন্ধন। যার যেই বিষয়ে দক্ষতা ও প্রতীভা রয়েছে সে সেটাকেই কাজে লাগিয়ে উই এর সাহায্যে নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাচ্ছেন।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উই প্লাটফর্মে যে কেউ যুক্ত হতে এবং পোস্ট দিতে পারেন। পণ্য বিক্রির আগে কিংবা পরে কাউকে কোনো চার্জ বা কমিশন দিতে হয় না। এটিই মূলত উইয়ের দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ। এছাড়া উইতে বিক্রির থেকেও ই-কমার্স নিয়ে শেখার ও জানার দিকে গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। বর্তমানে প্লাটফর্মটি থেকে মাসে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার উদ্যোক্তা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। এর অংশ হিসেবে আগামী ২৪ ও ২৫ অক্টোবর নারী ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের নিয়ে অনলাইন সামিটের আয়োজন করেছে উই।
এদিকে, বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারীতে দেশের ক্ষুদ্র-মাঝারি ও বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ধ্বস নেমেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা অনেক ক্ষুদ্র-মাঝারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। ঠিক তখনও আশার আলো দেখিয়েছে উই ফোরাম। নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছে। করোনায় লকডাউনে নিজেদের অলস সময়কে কাজে লাগিয়ে দেশের বহু নারী নিজেদের সফল অনলাইন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন, কাজ করছেণ দেশীয় পণ্য নিয়ে। তারা হারিয়ে যাওয়া পণ্যগুলোকে নতুন করে সামনে এনে নতুন করে চাহিদা তৈরি করতে পেরেছেন।
প্লাটফর্মটি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারীতে যখন সবাই বেকার সময় কাটিয়েছে তখন ২৪ ঘণ্টা কাজ করেছে ফোরামের সাথে যুক্ত নারী উদ্যোক্তারা। এই সময়টায় তারা ২শ দেশীয় পণ্য উদ্যোক্তাকে সামনে আনার চেষ্টা করেছেন। তাদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করেছেন। এসময় প্রচুর মেম্বার প্রশিক্ষণের জন্য যুক্ত হয়েছেন। অন্যান্য সময়ের তুলনায় করোনাকালে নারী উদ্যোক্তারা অনেক বেশি অগ্রগতি লাভ করেছে বলে তারা জানান।
নারী ই-কমার্স উদ্যোক্তারা হরেক রকম দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। তবে এদের বেশিরভাগ পোশাক-আশাক ও খাদ্য আইটেম নিয়ে কাজ করছেন। উদ্যোক্তাদের নিজেদের তৈরি করা এসব পণ্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন ও বিপণণে সহায়তা করছে উই। এজন্য প্রচুর কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইউ প্লাটফর্ম থেকে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা দেশীয় পণ্যের কেনাকাটা করতে পারছেন। তাদের কাছ থেকে ভালো অর্ডারও পাওয়া যাচ্ছে। তারা নিজেরা ব্যবহার করছেন এবং আপনজনদের উপহারসামগ্রীও পাঠাচ্ছেন। বিদেশ থেকে অর্ডার আসায় উদ্যোক্তারাও উৎসাহিত হচ্ছেন।
উই এর ফাউন্ডার ও প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা ইনকিলাব অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমরা এখন মূলত দেশীয় পণ্য রপ্তানি করা নিয়ে বেশি কাজ করছে। উদ্যোক্তারা যাতে উই এর মাধ্যমে রপ্তানি করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আগামী বছরের শুরু থেকেই রপ্তানি শুরু হবে। আমাদের লক্ষ্য উদ্যোক্তাদের তৈরি স্থানীয় পণ্য বিশ্বের সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’কে গোটা বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া।’’
তিনি বলেন, ‘‘ই-কর্মাস ব্যবসার জন্য পণ্যের ছবি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উই সেই জায়গাটা নিয়ে কাজ করছে। দেশীয় পণ্যকে ইন্টারনেটে প্রকৃত রূপে তুলে ধরতে ফটোগ্রাফির ওপর কর্মশালা করানো হচ্ছে।’’
নিশা বলেন, ‘‘আমাদের মেইন উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমাদের দেশীয় যে পণ্যগুলো আছে সেগুলোকে একদম সামনে নিয়ে আসা এবং মাঠ পর্যায় থেকে উঠিয়ে আনা। কারণ অনেক পণ্যেই দেখা যাচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো যেন না হারায় বিলুপ্ত না হয়ে যায়। সেই ধরনের প্রোডাক্টগুলো নিয়ে যেন মানুষ কাজ করতে পারে, মূলত সেই জায়গাটাতে আমরা ফোকাস করছি। পাশাপাশি নারী উদ্দোক্তারা যেন তাদের স্কিল ডেভেলপ করতে পারে এজন্য বিভিন্ন ট্রেনিং, ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তাদের ভেতর থেকে সেই স্কিলগুলো বের করে আনা হচ্ছে।’’
উই দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘‘অনেকে আছে সমস্ত রান্না পারে, কিন্তু সে জানে না তার এই রান্নার উদ্যোগ নিয়েই তার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারে। যখন তারা আমাদের এই পোস্টগুলো, ডিসকাশনগুলো দেখে তখন কিন্তু অনেকেই ইনসপায়ার্ড হয়। সে কারণে আমরা নারী উদ্দোক্তাদের যারা খাবার রিলেটেড কাজ করে তাদের জন্য কুকিংয়ের ওয়ার্কশপ করায়। সেগুলো দেখে তারা নিজেদের ভিতরে কিছুটা চেইঞ্জ যাতে আনতে পারে।’’
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে নিশা বলেন, ‘‘যারা নতুন উদ্দোক্তা হবেন তারা হুট করে শুরু করে দিবেন না। প্রথমে আপনারা সময় নিয়ে দেখবেন বুঝবেন মার্কেটটাকে স্টাডি করবেন। সেই সাথে আমাদের গ্রুপে যদি যুক্ত থাকেন তাহলে সবাইকে বলি আপনারা একশ দিন অবজারভ করেন। মিনিমাম তিন মাস আপনারা অবজার্ভ করে দেখবেন আসলে কোন প্রোডাক্টটা নিয়ে কাজ করলে আপনার জন্য ভালো হবে। আমরা সবাইকে বলি, তিন মাস আপনারা সময় নেন, প্রত্যেকটা পোস্ট পড়েন ওয়ার্কশপগুলোতে এটেন্ড করেন। তখন আপনি নিজেই জেনে যাবেন আসলে আপনার কোন ধরনের পন্য নিয়ে কাজ করা উচিত বা কোন ক্ষেত্রে কি কি করা উচিত।’’
দেশে নারী উদ্যোক্তা তৈরি ও দেশীয় পণ্যের বিকাশে বেশি বেশি কর্শমালা আয়োজনের পাশাপাশি সরকারের কাছে ট্রেড লাইসেন্সের ফি কমানো এবং উদ্যোক্তাদের সহজে সহায়তা তহবিল সরবরাহ করার দাবি জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন