ইনকিলাব ডেস্ক : ইউরোপজুড়ে ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে ইসলামবিরোধী বিক্ষোভ-সমাবেশ। নিউইয়র্ক, লন্ডন ও মাদ্রিদের পর সর্বশেষ প্যারিসে হামলা হলো। জেহাদি হামলায় তটস্থ, সন্ত্রস্ত ইউরোপ। রাজনৈতিক ইসলামের জঙ্গি, ওয়াহাবি-সালাফি জেহাদ বিপন্ন করে তুলেছে তার সামাজিক সন্তুলন। এতটাই যে, ইউরোপের দেশে দেশে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মুসলিমের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হচ্ছে সন্দেহ, বিদ্বেষ, জাতি-ঘৃণা। যে উদারনীতি অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন ব্যবস্থার কারণে পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে অগণিত মুসলমান কাজের সন্ধানে পশ্চিমে যে যাত্রা শুরু করেছিল, তা সঙ্কুচিত করে পুবের সব দরজা বন্ধ করে দেয়ার দাবি উঠতে শুরু করেছে।
শার্লি এবদোর সদর দফতরে জঘন্য হত্যালীলার প্রতিবাদে প্যারিসের রাজপথে যে ১০ লক্ষ মানুষ পা মেলান, তাদের মধ্যে বহু মুসলমানও ছিলো, যারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এই আক্রমণ সমর্থন করেননি। ঠিক যেমন জেহাদিদের গুলিতে নিহত মুসলিম কনস্টেবল, যিনি ব্যঙ্গচিত্রীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। যে তিন জেহাদি ১৭ জন ফরাসি নাগরিককে হত্যা করে, তারা কেউ প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীও নয়। প্যারিসেই তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, জেহাদি মতে দীক্ষা। প্যারিস ও মার্সাইয়ের বিস্তীর্ণ উপকণ্ঠে প্রসারিত দরিদ্র বস্তিগুলিতে যে ৫০ লাখ মুসলিম বাস করে, এরা তাদেরই অংশ। তাদের দারিদ্র্য, বে-রোজগারি, বিচ্ছিন্নতাবোধ আল-কায়দা ও আইসিস বা আইএস তকমাধারী ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের জেহাদি স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের উর্বর ভূমি। ফরাসি সরকার সে সম্পর্কে অবহিতও ছিলো। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, অন্তত ১৪০০ ফরাসি নাগরিকের ইরাক ও সিরিয়ায় জেহাদে যোগ দিতে যাওয়ার কথা। এদের মধ্যে ৭০ জন ইতিমধ্যে সেখানে নিহত। এই জেহাদিরা সবাই ফ্রান্সে ফিরে এলে কী হবে, তা ভেবেও উৎকণ্ঠার শেষ নেই।
পাশের দেশ বেলজিয়ামে গত সপ্তাহেই পুলিশ বেশ কয়েকটি মুসলিম মহল্লায় হানা দিয়ে সিরিয়া ফেরত দুই জেহাদিকে গুলি করে হত্যা করে। বেলজিয়ামে ৫ লক্ষ মুসলমানের বাস, যারা প্রায় সকলেই উত্তর-আফ্রিকা থেকে অভিবাসী ফরাসিভাষী। শার্লি এবদোর হত্যাকা-ের পরেই জার্মানির বার্লিনে আড়াইশো পুলিশের একটি দল ১১টি বাড়িতে ভোর রাতে হানা দিয়ে দু’জন তুর্কি নাগরিককে গ্রেফতার করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো, তারা ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের যোদ্ধা ও তহবিল সরবরাহ করছে। জার্মানিতে ৪০ লাখ মুসলমানের বাস। এদের অধিকাংশই তুরস্ক থেকে আসা। তারা প্রজন্মপরম্পরায় এখানকার অভিবাসী।
ইসলাম-আতঙ্ক জার্মানিকে যতটা গ্রাস করেছে, আর কোনও ইউরোপীয় দেশকে ততটা নয়। দক্ষিণপন্থী জার্মান তরুণদের সংগঠন পিইজিআইডিএ। পিইজিআইডিএর বাংলা অর্থ হচ্ছে : ‘পশ্চিম দুনিয়ার ইসলামিকরণের বিরোধী দেশপ্রেমী ইউরোপীয়রা’। প্রতি সোমবারই দেশের নানা প্রান্তে ইসলাম-বিরোধী বিক্ষোভ-মিছিল করে চলেছে সংগঠনটি। শার্লি’র উপর হামলার পর ড্রেসডেন শহরে প্রায় ৫০ হাজার জার্মান বিক্ষোভ করে। সেখানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং জার্মানির অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয়। তরুণরা শ্বেতাঙ্গ, নর্ডিক আর্যত্বের দাবিদার, প্রাচ্যদেশীয়দের কাছে রুজি হারাবার ভয়ে শঙ্কিত, উগ্র জার্মান জাত্যভিমানে টগবগে। এদের ভিড়ে মিশে রয়েছে নব্য-নাৎতসিরা। জার্মানদের জন্মহার আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকায় অ্যাঞ্জেলা মার্কেল-এর সরকার অভিবাসনে উৎসাহ দেয়। ২০১৩ সালে ৪ লক্ষ ৩৭ হাজার লোক এ দেশে অভিবাসী হয়। গত বছর ২ লক্ষ আশ্রয়প্রার্থীকে জার্মানি আশ্রয় দিয়েছে, যাদের অনেকেই গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে আগত। এ সবই যুব সম্প্রদায়ের মনে ইসলাম দ্বারা প্লাবিত হওয়ার ভীতি জাগিয়ে তুলেছে। শার্লি-হামলার আগেই নেয়া এক জনমত-সমীক্ষায় এই বিপন্নতাবোধের কথা নথিভুক্ত করিয়েছে দেশের অ-মুসলিম নাগরিকদের ৫৭ শতাংশ।
চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সরকার এই উগ্র মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক। সারা জার্মানি জুড়ে লাখখানেক মানুষ দেশের বহুসংস্কৃতিবাদী ঐতিহ্য ও মুসলিমদের সমর্থনে পাল্টা মিছিল করেন। ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনের নৈশ জমায়েতে হাজির হয়ে মার্কেল ঘোষণা করেন, ইসলামও জার্মানির অংশ এবং ধর্মবিশ্বাসের কারণে কোনও জনগোষ্ঠীকে বহিষ্কৃত করা একটি মুক্ত রাষ্ট্রের মৌল নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এপি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন