ভারতের আসাম রাজ্যে যে মুসলিমরা নিজেদের সেখানকার ভূমিপুত্র বলে মনে করেন, শুধুমাত্র তাদের জন্য একটি অনলাইন সেন্সাস বা আদমশুমারির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে।
আসামের তথাকথিত ‘দেশজ’ মুসলিমদের একটি বড় সংগঠন এই উদ্যোগের পেছনে আছে, যাতে ক্ষমতাসীন বিজেপিরও প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ওই সংগঠন ইতোমধ্যেই অসমিয়া ভাষী মুসলিমদের কাছ থেকে ‘এনআরসি-র ধাঁচে’ তথ্য সংগ্রহর কাজও শুরু করে দিয়েছে। তবে রাজ্যের মুসলিম সমাজের নেতারা অনেকেই এই পদক্ষেপকে আসামের বাংলাভাষী ও অসমিয়াভাষী মুসলিমদের মধ্যে আরও একটা বিভাজন সৃষ্টির কৌশল হিসেবেই দেখছেন।
বস্তুত আসামের দেশজ মুসলিমদের মধ্যে প্রধানত তিনটি জনগোষ্ঠী আছে, আপার আসামের গোরিয়া ও মোরিয়া এবং লোয়ার আসামের দেশি মুসলিম।এই দেশজ মুসলিমদেরই অন্তত তিরিশটি সংগঠন মিলে যৌথভাবে গঠন করেছে ‘জনগোষ্ঠীয় সমন্বয় পরিষদ’, যার প্রধান আহ্বায়ক হলেন সৈয়দ মুমিনুল আওয়াল। তিনি আসামে ক্ষমতাসীন বিজেপির একজন প্রভাবশালী নেতা, রাজ্যের সংখ্যালঘু কমিশনেরও চেয়ারম্যান তিনি।
গত সপ্তাহেই আসামে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে, তার দিনকয়েক পরেই পরিষদ দেশজ মুসলিমদের জন্য এই তথ্য সংগ্রহ বা সেন্সাসের কথা ঘোষণা করে। সৈয়দ মুমিনুল আওয়াল বলেন, ‘এই অনলাইন জরিপে রাজ্যের গোরিয়া, মোরিয়া ও দেশি মুসলিমরা একটি নির্দিষ্ট পোর্টালে তাদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদি পরিচয়পত্র এবং গ্রামের মোড়ল বা শহরের পৌর বোর্ডের দেয়া প্রশংসাপত্র আপলোড করে নিজেদের নথিভুক্ত করতে পারবেন।’
১৫ এপ্রিল থেকে এই পোর্টাল কাজ শুরু করেছে, চালু হয়েছে একটি টেলিফোন হেল্পলাইনও। আসামের সংবাদমাধ্যমে এই পদক্ষেপকে একটি ‘মুসলিম এনআরসি’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, তবে আওয়াল তার সঙ্গে একমত নন। তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, ‘এটা কখনওই মুসলিম এনআরসি নয় - বরং এটা হল গোরিয়া, মোরিয়া ও দেশি মুসলিমদের মধ্যে চালানো একটি জরিপ। যেখানে আগামী তিন মাস ধরে স্বেচ্ছায় নিজেদের তথ্য জমা দেবেন।’ তিনি বলেন, ‘রাজ্যের প্রতিটি রাজস্ব সার্কলে কতজন দেশজ মুসলিম আছেন, সেই ডেটাবেস তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য। আসামের সব ইসলাম ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠীকেই এক মুসলিম ব্র্যাকেটে ফেলে দেয়া হয়, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ একটা দেশে মুসলিম - শুধু এই ধর্মীয় পরিচয়টা তো কাম্য হতে পারে না।’
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আসামের অন্তর্ভুক্তির আগে থেকেই যে মুসলিমরা সেখানে বসবাস করেছেন, তাদের বংশধররাই আসামের দেশজ মুসলিম বলে স্বীকৃত। এখন বেসরকারি উদ্যোগে তাদের জন্য আলাদা সেন্সাস বা ডেটাবেস তৈরির উদ্যোগকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে রাজি নন নাগরিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির কর্ণধার হাফিজ রশিদ চৌধুরী। তবে তিনি স্বীকার করছেন এটা অহমিয়া ও বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে অবশ্যই বিভেদ সৃষ্টি করবে।
হাফিজ রশিদ চৌধুরী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘দেখুন সেন্সাস বা আদমশুমারি তো কখনও বেসরকারি বা প্রাইভেট সংগঠন করতে পারে না। আর সরকারের এখানে সরাসরি কোনও ভূমিকাও নেই। তারপরও এই সংগঠন যে সার্ভে-টা করতে চাইছে, বিটুইন-দ্য-লাইনস পড়তে গেলে সেটার একমাত্র লক্ষ্য দাঁড়ায় অসমিয়া মুসলিম ও বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করা।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এ রাজ্যের মুসলিমরা সার্বিকভাবে নিজেদের একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবেই দেখি। তার মধ্যে আবার আসামের মুসলিম, বাঙালি মুসলিম, হিন্দিভাষী মুসলিম, উর্দুভাষী মুসলিম - এভাবে ভাগ করাটা কখনওই কাম্য নয়। তারপরও বেসরকারিভাবে কেউ চাইলে সার্ভে করাতেই পারে। তার হয়তো বৈধতা থাকবে না, কিন্তু সেটা সামাজিকভাবে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারবে।’
গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির অধ্যাপক বর্ণালী চৌধুরী আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, রাজ্যের বাঙালি মুসলিমদের পরের প্রজন্মও যেভাবে অসমিয়া শিখে নিয়েছে তাতে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ফারাক করা খুবই কঠিন হবে। তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আসামের অভিবাসী বাঙালি মুসলিমরা, বিশেষত যারা নদীর চরাঞ্চলে বসবাস করেন তারা কিন্তু অসমিয়া সংস্কৃতিকে বহুদিন আগেই আত্মস্থ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘তারা অনেকেই এখানে নও-অসমিয়া বা নব্য অসমিয়া নামেও পরিচিত। ফলে দেশজ মুসলিমদের আলাদা ডেটাবেস তৈরির চেষ্টা নিখুঁত হওয়া একরকম অসম্ভব। কারণ যে অভিবাসীরা একবর্ণও অসমিয়া বলতে পারতেন না, তাদের তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম প্রজন্ম কিন্তু অসমিয়া মাধ্যম স্কুলে পড়ছে, আসামের ভূমিপুত্রদের চেয়েও তারা কোনও অংশে কম অসমিয়া নন।’
বিজেপি আসামে তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরলে তারা নতুন করে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা 'সংশোধিত এনআরসি'-র কাজ শুরু করবে। সেই প্রক্রিয়ায় যাতে অসমিয়া-ভাষী মুসলিমরা সুরক্ষিত থাকেন, এই অনলাইন সেন্সাস সেটা নিশ্চিত করার একটা চেষ্টা বলেও মনে করছেন অনেক পর্যবেক্ষক। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন