বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লাইফস্টাইল

রমজানে স্বাস্থ্য সুরক্ষা

| প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০২১, ১২:১৪ এএম

ধর্মপ্রাণ মুসলমান রমজান মাসে রোজা রেখে, ইবাদত বন্দেগি করে, তারাবির নামাজ পড়ে পরম করুনাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত কামনা করেন। এ মাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিশেষ রজনী হচ্ছে পবিত্র লাইলাতুল কদর, যে রাতে পবিত্র কোরআন শরিফ নাজিল হয়েছে। সুতরাং এ মাসের পরিপূর্ণ সিয়াম সাধানার জন্য সুস্বাস্থ্য অত্যন্ত প্রয়োজন।

রোজা রাখলে আমাদের শরীরের সঞ্চিত দুষিত বস্তু বের হয়ে যায় ও শক্তি ক্ষয় হয়ে চর্বি ভাঙতে থাকে। এজন্য রমজানে প্রত্যেকটি মুসলমানের উচিত কিভাবে স্বাস্থ্য ঠিক রেখে রোজা পালন করা যায় সে দিকে গুরুত্ব দেওয়া।
রোজা পালনের জন্য এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য যা করা প্রয়োজন-

* রোজার সময় ১৫ ঘণ্টা উপবাস থাকতে হয় এ জন্য ইফতার, ইফতার পরবর্তী আহার এবং সেহরির খাবার সুষম হতে হবে।

* যেসব খাবার সহজে হজম হয় সেগুলো গ্রহণ করা ভালো।
* বেশি ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।
* ফাস্টফুড, জাংকফুড, চিপস, পিজ্জা, রঙিন পানীয় পরিহার করা ভালো।
* প্রচুর পরিমাণে পানীয়, তাজা ফলের রস এবং লেবুর শরবত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
* লাল গোস্ত, চর্বিযুক্ত চিংড়ি মাছ, বড় মাছের মাথা গ্রহণ না করা ভালো।
* মদ্যপান, ধূমপান, তামাক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ পরিত্যাজ্য।
* যাদের গা খুব বেশি ঘামে তাদের ওরাল স্যালাইন বা ডাবের পানি খাওয়া বাঞ্ছনীয়।
রোজার সময় যেসব রোগবালাই হতে পারে

* রোজার প্রাক্কালের সবচেয়ে প্রথম যে সমস্যা তৈরি হয় তা হল ঘুম না হওয়া, বা কম হওয়া বা অনিদ্রা বা ইনসোমনিয়া। সাধারণত সেহরি খাওয়ার কারণে প্রথমদিকে স্বাভাবিক ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে। এটা সাময়িক একটা সমস্যা এবং পর পর কয়েকদিন রোজা রাখলে এটা শরীরে ধাতস্থ হয়ে যাবে। তবে যদি কারও এটা প্রায়ই উপস্থিত থাকে তবে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ঔষধ ঘুমের জন্য খাওয়া যেতে পারে।

* ইফতারির সময় বেশি ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত খাবার, রঙিন খাবার গ্রহণের ফলে বুক জ্বালপোড়া করা, অম্ল ঢেঁকুর ওঠা বা এসিডিটি পেটে ব্যথা হতে পারে। যাদের আগে থেকে পেপটিক আলসার ডিজিজ আছে তাদের এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শম মতো অ¤øনাশক ওষুধ খেতে হবে। ওষুধ ইফতার, ইফতার পরবর্তী খাবার বা সেহরির মাঝখানে গ্রহণ করা যেতে পারে।

* রোজার প্রথমদিকে আরেকটি প্রধান অসুবিধা হল কোষ্ঠকাঠিন্য বা কনসস্টিপেশন। এটা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় যাদের তামাক, সিগারেটজাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস আছে এবং যারা পানি ও ফলের রস কম গ্রহণ করে থাকে। এসব ব্যক্তিরা প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, তাজা ফলমূল খেলে এবং প্রচুর পানি এবং ফলের রস গ্রহণ করলে এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। ক্ষেত্র বিশেষে কিছুসংখ্যক ব্যক্তির বেলায় চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ গ্রহণ করা যেতে পারে।

* কোনো কোনো রোজাদারদের বেলায় বদহজম পাতলা পায়খানা ও আমাশয় হতে পারে। এগুলো সাধারণত অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পানি, ফলের রস এবং খাবারের কারণে হয়ে থাকে। এসব খাবার ও পানীয় আক্রান্ত ব্যক্তির হাত থেকে খাবারে সংক্রমিত হয়। এজন্য ইফতারি ও অন্যান্য খাবার ও পানীয় কেনার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন এগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং এর পরই এগুলো ক্রয় করে গ্রহণ করতে হবে। বেশি পরিমাণে ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি বা বদহজম হলে ডাক্তারের পরামর্শমতো ওরাল স্যালাইন ও অন্য ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।

* রোজাদারের কোনো কোনো সময় তীব্র গরম এবং ঘামের কারণে অতিরিক্ত লবণ শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পরে। এর সঙ্গে হিট স্ট্রোক হয়ে রোগী মূর্ছা যেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গায়ে চুলকানি, র‌্যাশ ইত্যাদিও হতে পারে। কোনো কোনো রোজাদারের ক্ষেত্রে মাংসপেশির ক্র্যাম্পও হতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে ঠান্ডা কোনো জায়গায় শুয়ে বিশ্রাম করতে হবে, প্রচুর পরিমাণ ওরাল স্যালাইন খেতে হবে এবং প্রয়োজনে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারে।

* ডায়েবেটিসের রোগীরা কী রোজা রাখতে পারবে।
ডায়াবেটিস একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। সীমিত খাবার গ্রহণ, মুখে খাবার ডায়াবেটিস বড়ি এবং ইনসুলিন সময়মতো গ্রহণ করা এবং শারীরিক বা কায়িক পরিশ্রম বেশি করা, মিষ্টি, শর্করা এবং চর্বিজাতীয় খাদ্য কম গ্রহণ বা পরিহার করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কাজেই বেশিরভাগ ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখার ব্যাপারে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রয়োজনে ইফতারির সময়, সেহরির সময় রক্তে সুগারের পরিমাণ নির্ণয় করে ওষুধ অ্যাডজাস্ট করে নিতে হবে। যেসব ডায়াবেটিক রোগীর জটিলতা আছে যেমন হৃদরোগ, কিডনি ফেইলুর আছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শমতো এবং রোগের ধরন ও গভীরতা থেকে নির্ধারণ করতে হবে যে সে রোজা রাখতে পারবে কিনা।

সাধারণত সেহরি ও ইফতারের পর চা কফি খাওয়া অনুচিত। কারণ চা কফির ক্যাফেইন অনেক সময় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। নিয়ম মেনে রোজা রাখার পরেও এসব সমস্যা হতে থাকলে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সেবন করলে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব।

মাথা ব্যথ্যা, দূর্বলতা ও প্রেসার কমে যাওয়া-দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে প্রায় সবারই মাথাব্যাথা, দূর্বলতা, ক্লান্তি চলে আসে। এর অন্যতম কারণ হল, সেহরি ও ইফতারে তরল এনার্জেটিক খাবার গ্রহণ না করা এবং কিছু উত্তেজক খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা। তরল খাবারের মধ্যে দুধ, স্যুপ, ফলের জুস, লেবুর শরবত এবং পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পান করতে হবে। খাবারের লবণের পরিমাণ কমে গেলেও এমনটা হতে পারে। তবে অবশ্যই চা কফি, মসলাযুক্ত ও টকজাতীয় খাবার গ্রহণ না করা বাঞ্ছনীয়। কারণ সেহরিতে চা কফির ক্যাফেইন সারাদিন পিপাসা লাগার অন্যতম কারণ।

অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ গ্রহণ করে যে কেউই রোজা রাখতে সক্ষম। খুব বেশি অসুস্থ, গর্ভবতী মা ও দুগ্ধ প্রদানকারী মা, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী, মানসিক রোগী এদের রোজা না রাখাই ভালো।

অনেকেই ভাবেন হার্টের সমস্যায় রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমাদের জেনে রাখা ভালো হার্টের যে কোন রোগ হলেই রোজা রাখা যাবে না এমনটি ধারণা করা সম্পূর্ণ ভূল। তবে হার্টের রোগীদের অবশ্যই ভালভাবে রোজা রাখার জন্য মানসিক চিন্তা, এ্যাংজাইটি, উদ্বিগ্নতা, অত্যধিক ইমোশন ত্যাগ করতে হবে। নিয়ম মানার পরেও যদি সমস্যা হতে থাকে এবং সমস্যাটি দীর্ঘদিনের হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ভাল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।

বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মাদের ক্ষেত্রে রোজা অনেকেই ভাবেন বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় রোজা রাখা যাবে না কারণ দুধ শুকিয়ে যাবে। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা। তবে স্তনদানকারী মাকে অবশ্যই সহজে হজম হয় এমন খাবার প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।

রিওমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে রোজা রিওমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীরাও চিন্তামুক্ত হয়ে রোজা রাখতে পারেন। কারণ সম্প্রতি ইরানিয়ান একটি রিসার্চে বের হয়েছে ৪৬-৫০ বছরের আর্থ্রাইটিসের রোগীরা রোজা রাখলে ল্যাবরেটরি ইনভেস্টিগেশন উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি লাভ করে।

স্ট্রেস, ডিপ্রেসন, এ্যানজাইটি রিলিভার স¤প্রতি ইরানিয়ান ও সুইডিস গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন ২৯-৩০ দিনের রোজা এবং প্রতিমাসে ২-৩টি রোজা পালন করলে স্ট্রেস, ডিপ্রেসন, এ্যানজাইটি অনেকাংশে কমে যায়।

মহান আল্লাহ রোজা রাখার বিধান দিয়েছেন তার বান্দাদের কল্যাণের জন্য। সারাদিন না খেয়ে থাকার নামই রোজা নয়। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, “নিশ্চয়ই নিয়মানুবর্তিতার সহিত তোমাদের উপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে।” সুতরাং নিয়ম শৃঙ্খলার সহিত রোজা পালনই এর মূল ভিত্তি। তথাপি বর্তমানে নিয়ম মানার পরেও অনেকেই বিভিন্ন ধরনের রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন, অনেকেই আবার রোগ নিয়ে কিভাবে রোজা রাখবেন সেই চিন্তয় আছেন।

এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক ও খাদ্যের সচেতনতা। এসব সচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যার জন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে অনেক সমস্যারই সমাধান সুন্দরভাবে করা সম্ভব। কারণ মনে রাখতে হবে সুস্থতাই জীবন। শৃঙ্খল জীবনযাপনই সুস্থতার মুলভিত্তি। আর শৃঙ্খলার জন্যই রোজা এবং রোজাই আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম মাধ্যম।

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সম্পাদক ও প্রকাশক,দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
কো-চেয়ারম্যান : হোমিও বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
ই-মেইল. drmazed96@gmail.com
মোবাইলঃ০১৮২২৮৬৯৩৮৯

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন