সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

গাজা যুদ্ধ : সামনে একটি পথই খোলা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৫ জুন, ২০২১, ৭:১৬ পিএম

শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও হোসে রামোস-অরতা


শুক্রবার (৪ জুন) নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ওয়াল স্ট্রিট ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ এটি। শনিবার (৫ জুন) লেখাটি পাঠিয়েছে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ইউনূস সেন্টার থেকে। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং ১৯৯৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয়ী ও পূর্ব তিমুরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-অরতার এই লিখিত বক্তব্য ওয়াল স্ট্রিট ইন্টারন্যাশাল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

‘আমরা সবাই মানুষ। আমাদের পরিবার আছে, সম্ভবত সন্তান এবং নাতি-নাতনিও আছে। বন্ধুবান্ধব আর প্রতিবেশীতো আছেই। আমরা ভিন্ন ভিন্ন জাতির, নৃগোষ্ঠীর। আমাদের বিশ্বাসও ভিন্ন। আমরা সবাই চরম দারিদ্র্য ও যুদ্ধ দেখেছি, দেখেছি হত্যা ও মৃত্যু—প্রত্যক্ষভাবে অথবা সংবাদ মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের অনুভূতি অভিন্ন। সহমর্মিতা আমাদের ব্যক্তিসত্তা ও ডিএনএ’র অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানবসত্তার এই বৈশিষ্ট্যটি সম্পূর্ণ রুদ্ধ না করে দিলে গাজায় বিগত সপ্তাহগুলোতে যা ঘটে গেলো তা দেখে প্রবলভাবে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও অসহায় বোধ না করাটা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।’

লেখাটিতে বলা হয়, গাজার অধিবাসীদের ওপর এই অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হলো পৃথিবীর বুকে মানবসৃষ্ট সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দুর্যোগগুলোর একটি। বোমার গন্ধ মিলিয়ে যাওয়ার পর দু’পক্ষই যখন বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত, তখন আমাদের সবাইকে এ প্রশ্ন করতে হচ্ছে, আমরা এখন কী করবো?’ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড, যার অধিকাংশই অনুর্বর। পৃথিবীর প্রাচীন তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের পয়গম্বরদের জন্মস্থান এটি। যে কারো পক্ষে এমনটি ভাবাই স্বাভাবিক যে, এই তিনটি শক্তিশালী ধর্মের প্রজ্ঞার ফসল হিসেবে এই স্থানটি ঐক্যের স্বর্গভূমি হওয়ার কথা। কিন্তু এটি পরিণত হয়েছে পৃথিবীর নরকে; অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের অশ্রম আর রক্তে সিক্ত ভূমিতে।

আর কোনও সংঘাত এত বেশি প্রাজ্ঞজনের চিন্তা, জ্ঞান ও ধ্যান খরচ করেনি। গত শতকে আর কোনও সংঘাত এত বেশি ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ও ‘রোড ম্যাপ’ সৃষ্টি করেনি; যাদের রচয়িতা ও পরিকল্পনাকারীরা কখনও কখনও অকালপক্কভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। মিথ্যা আশাবাদ সৃষ্টি করেছেন, যা ভঙ্গ হয়েছে হতাশা আর ক্ষোভে। ফিলিস্তিনিদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে তাদের নিজেদেরই নেতারা, তাদের প্রতিবেশী অন্যান্য আরব দেশগুলোর শাসকরা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমরা এই মাত্র আরেক দফা ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করলাম যা চালিয়েছে ইসরায়েল, এমন একটি রাষ্ট্র যার কোনও বিবেকবোধ আছে বলে মনে হয় না। যারা বিশ্বাস করে, এই এলাকায় তাদের ঈশ্বরপ্রদত্ত অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা রয়েছে। এই এলাকায় পারমাণবিক সমরাস্ত্রের তাদেরই একচ্ছত্র অধিকার আছে। হামাসের রকেটগুলো বিশ্বের চতুর্থ সামরিক শক্তি ইসরাইলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিমান ও পদাতিক বাহিনীর সামনে সহজেই ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার প্রধান গ্রহীতায় পরিণত হয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা ও মিসাইল প্রতিরক্ষা তহবিল হিসেবে ১৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (চলতি অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি-অসমন্বিত ডলারে) সরবরাহ করেছে। ২০২১ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের জন্য অতিরিক্ত ৩.৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সামরিক অর্থায়ন এবং ৫০০ মিলিয়ন ডলার মিসাইল প্রতিরক্ষা সহায়তা চায়। মার্কিন বাজেটের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ পায় ইসরায়েল, আফগানিস্তানের পরেই যার স্থান। যার অন্তর্ভুক্তিতে তারা পায় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র, উন্নততর মিসাইল প্রতিরোধী প্রযুক্তি এবং সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান।

বাগাড়ম্বর ও মুষ্টি আস্ফালন বাদ দিলে ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য কার্যত কোনও বৈদেশিক হুমকি নেই। ইরানকে সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা যায়, কিন্তু ইসরায়েলের ২০০ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবিলায় পরমাণু অস্ত্রহীন ইরান দুর্বল এক শক্তি। হামাস যে রকেটগুলো ছুড়েছে, যার প্রায় সবই ইসরায়েলের ‘আয়রণ ডোম’ ধ্বংস করেছে। ইসরায়েলের সমরশক্তির তুলনায় কোনও ট্যাংকসজ্জিত সেনাবাহিনীর দিকে বালকের পাথর ছোড়ার নামান্তর এটি। এরপরও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে; যা তারা অর্ধশতাব্দী আগে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে চালিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সংঘাতটি শুরু হয়েছে সবচেয়ে পবিত্র মুসলিম স্থান আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। এর ফলে শত শত মানুষ আহত হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি দীর্ঘ প্রচারণার সর্বশেষ চালমাত্র। এই আগ্রাসনকে আরও বেশি অযৌক্তিক মনে হবে এ কারণে যে, গাজার জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশেরই বয়স ১৪ বছরের নিচে।

যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশীদার এবং এই সমস্যার সমাধানে তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাইডেন প্রশাসনকে ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু মারাত্মক ভুলের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে, যেগুলো নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একটি পোড়ামাটি যুদ্ধের সবুজ সংকেত ও লাইসেন্স হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। এই ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন হবে সাহস, প্রজ্ঞা ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থনের। এই সমস্যা সমাধানের পথটিকে শুরু হতে হবে সব পক্ষকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলোকে মেনে নিয়ে। শক্তিশালী রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট কোনও জোটেরই কোনও রাষ্ট্র বা পক্ষকে এই মানদণ্ডগুলো লঙ্ঘনের দায়বদ্ধতা থেকে সুরক্ষা দেওয়াটা উচিত হবে না। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলো যা স্লবোদান মিলেসোভিচ বা ওমর আল-বশিরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে, তা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য না হওয়াটা হবে অর্থহীন।

স্বশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে কাউকে জোরপূর্বক বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ থেকে শুরু করে গাজায় ঘরের এককোণে লুকিয়ে কাঁপতে থাকা ১০ বছরের কোনও বালিকার শোয়ার ঘরে মিসাইল ছুড়ে মারার উন্মাদনার এই চলমান নাট্যশালার প্রতিটি সংঘাতই ১৯৬৭ সালের সীমান্তরেখার ভিত্তিতে একটি দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের যৌক্তিকতা ও আশু প্রয়োজনকে আবারও সমর্থন করছে। এছাড়া আর একমাত্র যে সমাধানটি রয়েছে তা হলো ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র, যেখানে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যাগরিষ্টতার স্বীকৃতি থাকবে। এছাড়া আর কোনও বিকল্প সামনে খোলা নেই।

এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো হবে গাজায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলির অবাধ প্রবেশ এবং অবকাঠামো ও মানুষের জীবনের যে নিরর্থক হানি ও ক্ষতি সাধিত হয়েছে তার পুনর্নির্মাণ এবং ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। মানবতা এবং মানুষের প্রতি আমাদের সার্বজনীন সহমর্মিতা এটাই প্রত্যাশা করে।

লেখকদ্বয়: প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ২০০৬ এবং হোসে রামোস-অরতা, নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ১৯৯৬ ও প্রেসিডেন্ট, পূর্ব তিমোর ২০০৭—২০১২, অনুবাদ: কাজী নজরুল হক, ইউনূস সেন্টার

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
Abdullah ৫ জুন, ২০২১, ৭:৫১ পিএম says : 0
আর একমাত্র যে সমাধানটি রয়েছে তা হলো ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র" উপযুক্ত দুই নোবেলজয়ী এ কথাটির মাধ্যমে প্রমাণ করলেন যে,তাঁরা হলেন পশ্চিমা বিশ্ব ও ইহুদিদের দালাল
Total Reply(0)
Dadhack ৫ জুন, ২০২১, ১০:০৬ পিএম says : 0
Our all so called muslim rulers are murtard and taghut as such kafirs are killing us mercilessly, our murtard, taghut ruler also killing us mercilessly, they don't have any human qualities, they are not human or animal, according to Qur'an they are lowliest lowliest lowliest. May Allah wipe out them and replace Human being who will avoid any kind of aggression to each other.
Total Reply(0)
Sheikh MD.Alamgir ৬ জুন, ২০২১, ৮:৫৩ এএম says : 0
Israel hold unlimited power in comparison to Arab Country because all Powerful western country Blindly support Israel.Only Almighty Allah can solve it.
Total Reply(0)
সোহেল মালিক ৬ জুন, ২০২১, ৮:৫১ পিএম says : 0
ইজরাইল নামক কোন দেশের অস্তিত্ব নাই ওরা দখলদার জুলুমবাজ সন্ত্রাসী মুসলমানদের হত্যাকারী
Total Reply(0)
GAUTAM DEY ৬ জুন, ২০২১, ১১:৩৮ পিএম says : 0
Why God have sent us in the world we dont know ...if we knew the actual pupose of life than such incidents never happened through out the world.we are just killing killing and killing nothing more.Thus oneday our beautiful world will be destroy.Namaste
Total Reply(0)
মো: হায়দার আলী মল্লিক ৭ জুন, ২০২১, ৭:৫৯ এএম says : 0
পশ্চিমা সক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এর একমাত্র সমাধান করতে পারে ।
Total Reply(0)
Harun or Rashid ৭ জুন, ২০২১, ২:০৫ পিএম says : 0
All right in her coment. dr. Muhammad unuse
Total Reply(0)
Nannu chowhan ৮ জুন, ২০২১, ৬:২০ এএম says : 0
Mr.Haunur rashid if you have no idea of english word or sentences also how to spell better you learn first,then you post your comment in public,thanks
Total Reply(0)
মুহাম্মদ আলী হোসেন ৮ জুন, ২০২১, ৮:৫১ এএম says : 0
দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো সমস্যা সমাধানের রাস্তা নেই।
Total Reply(0)
আমি মনে করি ইউনুস সাহেব রা সঠিক বলেছেন
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন