শীতে আমাদের দেশে হরেক রকম শাকসবজি সমাগম হয় বাজারে। এসব শাকসবজি যে শুধু সুস্বাদু তা-ই নয়, রূপচর্চা ও স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। গ্রামবাংলার নারী এখনও রূপচর্চায় তাদের উৎপাদিত শাকসবজি ব্যবহার করে থাকে। আবহমানকাল থেকেই তারা তাদের মুখের শ্রীবৃদ্ধির জন্য শাকসবজি ব্যবহার করে আসছে। শাকসবজি পুষ্টিকর খাদ্য যা খেলে শরীর থাকে সুস্থ সবল এবং দেহে ফুটে ওঠে লাবণ্যতা। নিয়মিত সুষম খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন। সুষম খাদ্য তালিকায় শাকসবজির স্থান অগ্রে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মহিলার দৈনন্দিন সুষম খাদ্য তালিকায় ২৪৫ গ্রাম শাকসবজি থাকা প্রয়োজন। এ পরিমাণ শাকসবজি খেতে পারলে দেহের রূপালাবণ্য পাবে বৃদ্ধি এবং শুষ্ক ও খসখসে ত্বক হয়ে উঠবে ঝকমকে। আমাদের দেশে সব মৌসুমেই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি জন্মে থাকে। বিশেষ করে শীতকালে বহুপ্রকার শাকসবজির আবাদ হয়ে থাকে। শীতের এ সময়ে হাতের কাছে যেসব শাকসবজি পাওয়া যায় তার অনেকটাই রূপচর্চায় ব্যবহার করা যায়। এগুলোর মধ্যে লেটস পাতা, পুদিনা পাতা, লাউ, কাঁচা হলুদ, মুলা, টমেটো, শসা, গাজর, বাঁধাকপি এবং শিম অন্যতম।
শীতের এসব সবজি রূপচর্চায় ব্যবহার করা হলে দেহ হয়ে উঠবে সতেজ ও প্রাণবন্ত।
* লেটুস পাতা : শীতের সময় লেটুস পাতা সালাদ হিসেবে আমরা খেয়ে থাকি। এটি টমেটো, গাজর, পিঁয়াজ, বীট ইত্যাদির সাথে মিশিয়ে খাওয়া পুষ্টিগত দিক থেকে অতি উত্তম। শাক হিসেবেও লেটুস খাওয়া যায়। লেটুসে প্রতি একশ’ গ্রামে আমিষ ২.১ গ্রাম, শ্বেতসার ২.৫ গ্রাম, ভিটামিন-সি ১০ মি:গ্রাম এবং ক্যালসিয়াম আছে ৫০ মি: গ্রাম। নারীর রূপচর্চায়ও লেটুস পাতা ব্যবহার হয়ে থাকে। এককাপ পরিমাণ পরিষ্কার পানিতে কয়েকটি লেটুস পাতা ফুটাতে হবে । এরপর ঠান্ডা করে পানি ছেঁকে নিয়ে তার সাথে আধা চা চামচ গোলাপ পানি মিশিয়ে নিতে হবে। এবারে এ পানি সমস্ত মুখে, গলায় আর হাতে পায়ে লাগিয়ে আধা ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। তারপর অল্প গরম পানিতে হাত, মুখ, গলা ও পা ধুয়ে ফেলতে হবে। এবারে ঠান্ডা পানিতে পুনরায় সমস্ত স্থান ধুয়ে নিলে ত্বক হয়ে উঠবে কোমল ও মসৃণ।
* পুদিনা পাতা : পুদিনা পাতায় পুষ্টিমান রয়েছে খুব বেশি। তরিতরকারী, চাটনী ও বোরহানীতে পুদিনা পাতা দিলে খাবার বেশ স্বাদযুক্ত হয়। নারীর রূপচর্চায় পুদিনা পাতা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রতি একশ’ গ্রাম পুদিনা পাতায় রয়েছে ২.৯ গ্রাম আমিষ, ৯.১ গ্রাম শ্বেতসার, ২৮ মি:গ্রাম ভিটামিন-সি এবং ৮৫ মি:গ্রাম ক্যালসিয়াম। এক মুঠো পরিমাণ পুদিনা পাতা পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে শীলপাটায় বেটে রস বের করে নিয়ে রাতে শোবার সময় এ রস সারা মুখে ভালভাবে মেখে নিতে হবে। এরপর ১০-১৫ মিনিটি পরে প্রথমে হাল্কা গরম পানিতে ও পরে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে নিয়মিত পুদিার রস মুখে ব্যবহার করা হলে ত্বক নরম ও মসৃণ থাকে এবং মুখে ব্রণ বা ছোট ছোট দাগ থাকলে তা দূর হবে।
* গাজর : সুস্বাদু ও পুুষ্টিকর সবজির মধ্যে গাজর অন্যতম। গাজর তরকারী, সালাদ, হালুয়া করে খাওয়া হয়ে থাকে। এর পাতা শাক হিসেবও খাওয়া যায়। প্রতি একশ’ গ্রাম গাজরে রয়েছে ১২.৭ গ্রাম শ্বেতসার, ১৫ মি:গ্রাম ভিটামিন-সি এবং ২৭ মি: গ্রাম ক্যালসিয়াম। নারীর রূপচর্চায় গাজরের রস একটি বিশেষ উপকরণ। মুখের লাবণ্য বৃদ্ধির জন্য একটি গাজর পানিতে ধুয়ে পরিচ্ছন্নতার সাথে পাটায় মিহি করে বেটে এর মধ্যে দু চা-চামচ দুধ এবং এক চা চামচ বেসন মিশিয়ে এই পেস্ট সারামুখে মেখে নিতে হবে। প্রায় ১০-১৫ মিনিটকাল অপেক্ষা করে প্রথমে হাল্কা গরম পানিতে ও পরে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে নিয়মিত গাজরের পেস্ট মুখে মাখলে উপকার পাওয়া যায়।
* লাউ : লাউ একটি উপাদেয় সবজি। শীতকালীন সবজির মধ্যে এটি একটি উৎকৃষ্ট সবজি। লাউ শরীরের জন্য যথেষ্ট উপকারী। এর ডগা, পাতা সবই খাওয়া যায়। লাউ সহজে হজম হয় এবং শরীরকে বেশ ঠান্ডা রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। লাউ নারীর রূপচর্চায়ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ত্বকে পোড়া দাগ পড়লে লাউ-এর রস ব্যবহারে ভাল ফল পাওয়া যায়। লাউয়ে প্রতি একশ’ গ্রামে শ্বেতসার আছে ১৫ গ্রাম এবং লাউশাকে ভিটামিন সি আছে ৯০ মি:গ্রাম আর ক্যালসিয়াম রয়েছে ৮০ মি:গ্রাম। ত্বকের পোড়া দাগ নিবারণের জন্য কয়েক টুকরা লাউ পরিষ্কার পাটায় বেটে রস বের করে নিয়ে দাগ স্থানে সে রস নিয়মিত মাখলে উপকার পাওয়া যায়। গায়ের ছুলি দূরীকরণে এক টুকরা লাউ থেঁতলে নিয়ে ঘষতে হবে। এভাবে নিয়মিত ঘষলে ছুলি দূর হবে। ত্বকের বিভিন্ন দাগ দূর করতে লাউ ব্যবহার করা হলে উপকার পাওয়া যাবে।
* কাঁচা হলুদ : রন্ধনশালায় মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন ও আদার পাশে হলুদ না থাকলে নারীর রন্ধনকার্যে বিঘ্ন ঘটে। হলুদ বাঙ্গালীর নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি মসলা। বিবাহের শুভ অনুষ্ঠানে অর্থাৎ গায়ে হলুদে এই হলুদই হলো মুখ্য। পূজাপার্বনে, সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে, ওষুধ তৈরিতে হলুদের জুড়ি নেই। প্রতি একশ’ গ্রাম হলুদে রয়েছে ৬.৫ গ্রাম আমিষ, ৬৯.৫ গ্রাম শ্বেতসার, ৫.১ গ্রাম চর্বি এবং ৩.৫ গ্রাম খনিজ লবণ। নারীর রূপচর্চায় হলুদ আবহমানকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ত্বকে কাঁচা হলুদের মাস্ক ব্যবহার করা হলে ত্বক হয়ে উঠবে উজ্জ্বল ও মোলায়েম। এর ব্যবহারে ত্বকের সব রকম দাগও উঠে যাবে। কয়েক টুকরা কাঁচা হলুদ এবং কিছু পরিমাণ মসুরের ডাল আলাদাভাবে পরিষ্কার পাটায় ভালভাবে ধুয়ে বেটে নিতে হবে। দু’ চা-চামচ কাঁচা হলুদ বাটার সাথে এক চা-চামচ মসুরের ডাল বাটা মিশাতে হবে। এরপর হলুদ ও ডাল বাটার সাথে বড় দুই চা-চামচ দুধ মিশিয়ে নারীর প্রতিদিন নিয়ম করে মুখে লাগিয়ে আধা ঘণ্টা সময় অপেক্ষা করে প্রথমে হাল্কা গরম এবং পরে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। এতে ভাল উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতিদিন খালি পেটে কিছু পরিমাণ কাঁচা হলুদের রস আখের গুড়ের সাথে মিশিয়ে খেলে হাত-পা ফাটা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং শরীর থাকে মসৃণ।
* মুলা : পুষ্টিবিদরা বলে থাকেন, ‘সবজির চেয়ে শাক ভাল’। সে দৃষ্টিতে মুলা শাক বেশ পুষ্টিকর। শীতের সবজির মধ্যে মুলাই বেশি উৎপাদিত হয়ে থাকে এবং মৌসুমে বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। প্রতি একশ’ গ্রাম মুলা শাকে রয়েছে ১.৭ গ্রাম আমিষ, ২.৫ গ্রাম শ্বেতসার এবং ১৪৮ মি:গ্রাম ভিটামিন-সি। মুলা তরকারি ও সালাদ রূপে খাওয়া হয়ে থাকে। নারীর রূপচর্চায় মুলা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রোদে চলাফেরা এবং কাজ করলে মুখে কালো ছোপ পড়তে পারে। কালো ছোপের হাত থেকে রক্ষা পেতে মুখে মুলা বাটার প্রলেপ লাগানো যায়। এজন্য কয়েক টুকরা মুলা ধুয়ে পরিষ্কার পাটায় বেটে নিতে হবে। এবারে বাটা মুলা মুখে মাখতে হবে এবং আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে প্রথমে হাল্কা গরম ও পরে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে নিতে হবে। এভাবে নিয়মিত ব্যবহার করা হলে উপকার পাওয়া যায়।
* টমেটো : শীতের নানা প্রকার শাক সবজির মধ্যে টমেটো অন্যতম শাক সবজির মধ্যে টমেটো অন্যতম একটি সুস্বাদু সবজি। কাঁচা পাকা উভয় টমেটো খেতে বেশ ভাল লাগে। পাকা টমেটো সালাদ ও সবজিরূপে মৌসুমে ব্যাপকভাবে খাওয়া হয়ে থাকে। টমেটো একটি পুষ্টিকর সবজি ফল। টমেটো দিয়ে স্যুপ, সজ, জ্যাম, জেলী ইত্যাদি তৈরি করা হয়ে থাকে। প্রতি একশ’ গ্রাম পাকা টমেটোতে রয়েছে ৩.৬ গ্রাম শ্বেতসার, ২৭ মি:গ্রাম ভিটামিন সি। স্বাস্থ্য রক্ষায় ও রূপচর্চায় টমেটোর ভূমিকা অনেক। ত্বক শুষ্ক অথবা কালচে হয়ে গেলে। সেখানে টমেটোর রস মাখলে উপকার পাওয়া যায়। এজন্য টমেটো চাকচাক করে কেটে নিয়ে শুষ্ক এবং কালচে হয়ে যাওয়া স্থানে অর্থাৎ মুখ, হাত পায়ে ১৫-২০ মিনিট ভাল করে ঘষে নিতে হবে এবং প্রায় ১৫-২০ মিনিটকাল অপেক্ষা করে প্রথমে হাল্কা গরম এবং পরে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলতে হবে। রোদে পুড়ে রঙ বিবর্ণ হলে চিন্তার কারণ নেই। এজন্য একটি পাকা টমেটো ভাল করে চটকিয়ে পেস্ট বানিয়ে নিতে হবে। এ পেস্টের সাথে আধা কাপ পরিমাণ ঘোল মিশিয়ে ঘাড়, গলা, মুখ, হাতে মালিশ করতে হবে। এরপর ২০ মিনিট অপেক্ষা করে প্রথমে হাল্কা গরম ও পরে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। তাহলে রোদে জ্বলে যাওয়া রঙ মিলিয়ে যাবে। এছাড়া একটি পাকা টমেটোর রস বের করে তার সাথে ৪-৫ ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে মুখ, গলা, ঘাড় ও হাত পায়ে মাখলে উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পাবে।
* বাঁধাকপি : ভাজি হিসেবে বাঁধাকপির জুড়ি নেই। এর পাতা কুচিকুচি করে কেটে শুকিয়ে বহুদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং সেমাইয়ের মত মিষ্টান্ন তৈরি করা যায়। সালাদ হিসেবে তাজা পাতা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রতি একশ’ গ্রাম বাঁধাকপিতে ৬০ মি: গ্রাম ভিটামিন-সি, ৪.৭ গ্রাম শ্বেতসার, ৩১ মি:গ্রাম ক্যালসিয়াম আছে। এটি শরীরের পক্ষে বিশেষ উপকারী। নারীর মুখ কোমল ও মসৃণ রাখতে বাঁধাকপির পেস্ট ব্যবহার করা যায়। এজন্য বাঁধাকপি বেটে রস বের করে পরিমাণমত রস নিয়ে তাতে আধা চা-চামচ ইস্ট, এক চা- চামচ মধু মিশিয়ে গণ পেস্ট বানিয়ে সারা মুখে মেখে ১৫-২০ মিনিটে অপেক্ষা করে প্রথমে হাল্কা গরম ও পরে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। বাঁধাকপির পেস্ট নিয়মিত ব্যবহার করলে মুখের শ্রী বৃদ্ধি পাবে।
* শিম : শিম অন্যান্য সবজির মত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। এটি আমিষের উৎস। প্রতি একশ’ গ্রাম শিমে আছে ৪ গ্রাম আমিষ, ৬.৭ গ্রাম শ্বেতসার এবং ৯ মি:গ্রাম ভিটামিন-সি। ছোট ছেলেমেয়ের মাথার চুল ফেলে দেয়ার পর কেশহীন মাথায় শিম পাতার রস মেখে দিলে চুল ঘনকালো হয়ে উঠে। এটি গ্রাম বাংলার একটি সনাতন চর্চা। এছাড়া পরিমাণমত শিমের রসের সাথে সামান্য কর্পুর মিশিয়ে কটা ধরনের চুলে মেখে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করে মাথা ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলতে হবে। এভাবে নিয়মিত শিমের রস মাখলে চুলের রঙ কালো হয়ে উঠবে এবং মাথায় চুল সুন্দর দেখাবে।
* শসা : শসা একটি মুখরোচক সবজি ফল। শসার সালাদ ছোটবড় সকলেই পছন্দ করে থাকে। লবণ মরিচ দিয়ে শসা খেলে তৃষ্ণা মেটে। শসায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। প্রতি একশ’ গ্রাম শসায় রয়েছে ১.৬ গ্রাম আমিষ, ৩.৫ গ্রাম শ্বেতসার। নারী দেহের নাকের আশপাশ, থুতনী ও কপালে অতিরিক্ত তৈল জাতীয় পদার্থ এসে মুখকে জৌলুসহীন করে তোলে এবং মুখে ব্রণ, একনি ও ব্লাকহেডস দেখা দেয়। এর হাত থেকে বাঁচার জন্য একটি শসা ভালভাবে মিহি করে পরিষ্কার পাটায় বেটে নিয়ে তাতে দু’ চা-চামচ গোলাপ জল এবং এক চিমটি পরিমাণ কর্পুর গুঁড়ো মিশিয়ে মুখ পরিষ্কার করে নিয়ে লাগাতে হবে। এরপর আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে প্রথমে হাল্কা গরম এবং পরে ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে।
মাও: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট,
মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন