জীবনের প্রধান ইঞ্জিন হলো হার্ট। এই ইঞ্জিনকে সুস্থ ও সবল রাখতে পারলে জীবনটিও হয় সুস্থ ও সুন্দর। এখন কথা হলো, কিভাবে এই হার্টকে সুস্থ রাখতে পারি। বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও গবেষকেরা এ নিয়ে দিনরাত কাজ করে চলেছেন। আবিষ্কার হচ্ছে কিভাবে হার্ট সুস্থ রাখা যায়। আমরা সাধারণ মানুষ তাদের নির্দেশিত পদ্ধতি বা নিয়মকানুন অনুসরণ করলে অমর হবো না, তবে সুস্থ সুন্দর দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারি। বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগ সংক্রামক ব্যাধির মতো শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য পরিবেশ, খাদ্যদ্রব্য ও অস্বাভাবিক জীবনযাপন দায়ী। আমরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এই রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারি বহুলাংশে।
আসুন আমরা বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও গবেষকদের সাধারণ পরামর্শগুলো জেনে নিই। মুখের ভেতর পরিষ্কার রাখা-আমরা অনেকেই জানি না যে, মুখের ভেতর অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া কিববিল করে বেড়াচ্ছে। সুযোগ মতো আমাদের আক্রমণ করছে। এ জন্য মুখের ভেতর সব সময় পরিষ্কার রাখতে পারলে অনেক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মুখের ভেতর আছে দাঁত। এসব দাঁত নানা রকমের । উঁচু-নিচু, তেড়াবাঁকা। এই দাঁত আমাদের খাদ্যদ্রব্য চিবাতে সাহায্য করে। এই দাঁতের সাথে হার্টের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক নিয়ে গবেষকেরা গবেষণা করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা দাঁত পরিষ্কার রাখেন, তাদের হার্ট সুস্থ-সজীব থাকে। রোগমুক্ত থাকে। সাধারণত সবাই সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত পরিষ্কার করে। সারা দিন আর দাঁতের যত্ন নেই। চিকিৎসকদের মতে, সুস্থ হার্টের জন্য দুপুরে এবং রাতে ঘুমানোর আগে দাঁত পরিষ্কার বা দাঁত ব্রাশ করা অত্যাবশ্যক। রাতে ঘুমানোর আগে যারা দাঁত ব্রাশ করে মাউথওয়াশ করে ঘুমান, সকালে তাদের দাঁত-ব্রাশের প্রয়োজন নেই। যারা এভাবে দুই বেলা দাঁত ব্রাশ করে, তাদের হার্ট থাকে রোগমুক্ত, সুস্থ ও শক্তিশালী।
দাঁতের সাথে হার্টের সম্পর্ক নিয়ে প্রথমবারের গবেষণা করে ফলাফল প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ জার্নালে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা স্কটল্যান্ডের বারো হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর ওই গবেষণা চালান। এ গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দাঁত ও মুখের যত্ন করেন না, তারা হৃদরোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু যারা নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করেন দুই বেলা, তাদের হৃদরোগের আশঙ্কা ৭০ শতাংশ কম। শুধু তা-ই নয়, প্রতি ছয় মাস অন্তর দন্ত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে মুখ ও দাঁত পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কম। ওরাল বা মুখের ও দাঁতের যত্ন না নিলে আরো ক্ষতিকর দিক রয়েছে। উল্লিখিত গবেষকবৃন্দের আরো পর্যবেক্ষণ করেছেন, যারা দাঁত ও মুখের ভেতর অপরিষ্কার তাদের রক্তে সি রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন এবং ফ্রিবিনোজেন নামক দু’টি উপাদান রয়েছে। এ দুটো উপাদানই শরীরের ভেতর ক্ষত সৃষ্টি করে। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের গবেষক ড.রিচার্ড ওয়াটের গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের মুখে দাঁতের মাঢ়ির সমস্যা আছে তাদের হৃদরোগ ও হার্টের সমস্যা বেশি।
শুধু দাঁত নয়, ধূমপানও হৃদরোগের জন্য দায়ী। মুখের সাথে সমগ্র দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সম্পর্ক রয়েছে। আগের কালে বৈদ্যদের কাছে কোনো কোনো শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে গেলে প্রথম মুখ ও দাঁত পরীক্ষা করত এবং দাঁত তুলে ফেলে দিত। আধুনিক যুগের চিকিৎসকেরা দাঁত তুলে ফেলার পরিবর্তে নিয়মিত দাঁত ব্রাশের পরামর্শ দেন। ২০০৫ সালে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার এক-তৃতীয়াংশ হার্টের অসুখে। আর হার্টের অসুখের মূলে অপরিষ্কার দাঁত ও মুখ। তাই মুখ দাঁত সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। মনে রাখবেন, চার দিকে এখন হৃদরোগ সংক্রামক রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। হৃদরোগ বা হার্টের রোগ অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। তাই রোগ চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ অধিক যুক্তিসঙ্গত। একটু সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করলেই আমরা হার্টের রোগ এড়াতে পারি। সুস্থ হার্ট মানে সুস্থ মানুষ।
গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটামুটি তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিলে আমরা এই জটিল সমস্যা এড়িয়ে চলতে পারি। এগুলো হচ্ছে-
* নিয়মিত ব্যায়াম,
* সুষম খাদ্য গ্রহণ,
*ধূমপান বর্জন ও মানসিক চাপমুক্ত থাকা ও
* সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্য বর্জন।
ব্যায়াম-হার্টকে সবল ও সুস্থ রাখতে ব্যায়ামের বিকল্প নেই। এ জন্য কোনো জিমে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নারী-পুরুষ সবাই ইচ্ছে করলেই ব্যায়াম করতে পারে। শুধু ইচ্ছে থাকাই প্রয়োজন। নিয়মিত নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা বা নামাজ পড়া হার্টের জন্য উপকারী। হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম, হরেক রকম বৈঠক করা যায়। খেলাধুলাও করা যায়। একা একা আবার সঙ্গীসাথী নিয়ে দলবদ্ধ হয়েও ব্যায়াম করা যায়। মুক্তহস্তের ব্যায়াম, বৈঠক করা খুবই সহজ ও আনন্দদায়ক। সাইকেল চালনা, নাচ করা, সাঁতার কাটা প্রভৃতি ভালো ব্যায়াম। মোট কথা শরীরকে উত্তপ্ত করা একান্ত প্রয়োজন। এতে রক্ত চলাচল ভালো হয়। মস্তিষ্ক ও হার্টে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ হয়। যোগব্যায়াম, মুক্তহস্তের ব্যায়াম ও যোগাসনে বিভিন্ন প্রকার রোগব্যাধি ভালো হয়। মেডিটেশনে হার্ট ভালো থাকে। হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। কারণ, মেডিটেশন বা ধ্যানে হার্ট বা হৃদয়-মন চাপমুক্ত হয়। ধমনিতে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। কোনো ব্যায়াম প্রশিক্ষক বা বিশেষজ্ঞের নির্দেশ মোতাবেক ব্যায়াম করলে দ্রুত উপকার পাওয়া যায়।
সুষম খাবার- সুস্থ জীবনের জন্য সুষম খাবারের প্রয়োজন। সুষম খাদ্যের জন্য প্রচুর অর্থবিত্তের প্রয়োজন পড়ে না। সুষম খাবার বলতে আমাদের শরীরের ভেতরকার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুস্থতার জন্য যে খাদ্য প্রয়োজন সেই খাবারকে বোঝায়। যেমন কচুশাক চোখ ভালো রাখে। লালশাক রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়। পেঁপে লিভার ভালো রাখে। আমড়া, কামরাঙা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শাক ও সবজি আমরা তিন বেলা খাই বা খেতে পারি। কিন্তু গোশত যদি তিন বেলা খাওয়া যায়, তাহলে উপকারের বদলে অপকার হয়। তেমনি কোনো ভাজা খাবারই ভালো নয়। আবার সেদ্ধ খাবার উপকারী। ভারতের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কার্ডিয়াক সার্জন ডা: শেঠি বলেন, প্রাকৃতিক ফলমূল সবচেয়ে ভালো খাদ্য এবং তেল সর্বাপেক্ষা খারাপ জিনিস। চর্বি অত্যন্ত ক্ষতিকর। তিনি আরো বলেন, হার্ট সুস্থ রাখতে লবণ, চিনি, চর্বি বর্জন করুন। তেলবিহীন রান্না খান। লাল গোশত বর্জন করুন। ডিমের কুসুম বেশী খাবেন না। পোলাও-বিরিয়ানির পরিবর্তে সাদা ভাত খান। অধিক গরম মসলাযুক্ত খাবার খাবেন না। প্রতিদিন ছয় থেকে আট গ্লাস পানি পান করুন। যেসব সবজি কাঁচা খাওয়া যায়, যেমন শসা, ক্ষীরা, গাজর ইত্যাদি বেশি বেশি চিবিয়ে খান। রান্নায় সয়াবিন, সূর্যমুখী, অলিভ অয়েল ইত্যাদি তেল ব্যবহার করুন। গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া চতুষ্পদ পশুর গোশত না খেয়ে মুরগির গোশত খান। পশুপাখির মগজ, চামড়া, কলিজা, গিলা পরিহার করুন। সর্বপ্রকার কোলা বর্জন করুন। এক বেলা রুটি এবং দুই বেলা ভাত, শাকসবজি ও মাছ খান।
সপ্তাহে এক দিন রোজা রাখুন বা উপবাস করুন। একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখবেন, ধূমপান হার্টের প্রধান শুত্রু। অ্যালকোহল ও মদপানও হার্টের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই সর্বপ্রকার নেশাজাতীয় খাদ্য ও পানীয় বর্জন করুন। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ সব সময় নজরে রেখে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সবুজ রঙের শাকসবজি, কাঁচা ফল ও সবজির সালাদ, ছোলা, বুট, বাদাম, সর্বপ্রকার টক স্বাদের ফল, খোসাসহ পেয়ারা, আপেল, বেদানার রস, আমলকী, কামরাঙা, আমড়া, লেবু, বরই ইত্যাদি বেশি বেশি খাবেন। সব রকমের মাছ, সামুদ্রিক মাছ ও ইলিশ মাছ হার্টের জন্য খুবই ভালো। রান্নায় কম অয়েল, সূর্যমুখী তেল, রাইস বার্ন, অলিভ অয়েল ব্যবহার করবেন। বিদেশী বেশি দামি ফলের চেয়ে দেশী বিভিন্ন ঋতুর ফল অনেক পুষ্টিসমৃদ্ধ ও উপকারী। দৈনিক একটা পাকা কলা খাবেন। তাই বলা হয়-পরিমিত ও নিয়মিত আহার, শারীরিক ব্যায়াম, বিশ্রাম, নিদ্রা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত।
মো. লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন